মৌসুমী ভৌমিক। এক কথায় স্বনামধন্য। বাঙালির কাছে নতুন করে তাঁর পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন সম্ভবত নেই খুব একটা। একাধারে সংগীতশিল্পী, গীতিকার, লেখক, গবেষক এবং আর্কাইভিস্ট। বহু দশক ধরে তাঁর গানের সঙ্গে পরিচিত বিশ্বের অগণিত সংগীতপ্রেমী। এছাড়াও দীর্ঘদিন ধরে করে চলেছেন ‘ট্রাভেলিং আর্কাইভ’-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ (লিংক: https://thetravellingarchive.org)। কাজ নিয়ে, সময়কে দেখা নিয়ে, আগামীর পরিকল্পনা নিয়ে বঙ্গদর্শন.কম-এর মুখোমুখি মৌসুমী ভৌমিক।
রাজর্ষি : আপনার গান ‘নাগরিক বিচ্ছেদী গান’ হিসেবে কিছু জায়গায় চিহ্নিত করা হয়েছে। এই নামটি সম্পর্কে আজকে দাঁড়িয়ে আপনার বক্তব্য কী? যেমন একটা সময়ে কিছু গানকে ‘জীবনমুখী গান’ হিসেবে ট্যাগ দিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেরকমভাবেই কি আপনি এটাকে দেখছেন? না এই নামটিকে এবং প্রসঙ্গটিকে আপনি অন্যভাবে দেখছেন?
মৌসুমী : এই নামটি প্রথম কবি-সাংবাদিক ফারুক ওয়াসিফ ব্যবহার করে। ও এভাবেই বলে আমার গান সম্পর্কে। এটা দু-হাজার আঠেরো সালের কথা, ফারুক আমায় প্রথম আলোর জন্য ইন্টারভিউ করছিল। দু-হাজার বাইশে আমি একটা অনুষ্ঠান করেছিলাম আসির আরমানদের সঙ্গে। তখনও ফারুক ফেসবুকে এই কথাটাই লিখেছিল। এখন কী বলবে অবশ্য জানা নেই! তবে এই বলার কারণে একটা বিশেষ তকমা এঁটে যায় আমার গায়ে, এটা আমার মনে হয় না। জীবনমুখী গান-এর সঙ্গে এটার কোনও তুলনা চলে না।
জীবনমুখী’র ক্ষেত্রে একটি জন্রকে চিহ্নিত করে বাজারে বিক্রির জন্যে এরকম একটি নাম তৈরি হয়। এমনিতেও সেই সময়ে, অর্থাৎ নয়ের দশকে, গানের ক্ষেত্রে অনেক কিছু হয়েছে, তার বিভিন্নতা বিবিধতা পুরো মাত্রায় ছিল। সিঙ্গার-সংরাইটার বা ব্যান্ডের একটা বিশেষত্ব হলো তার নিজস্বতা, তার ইন্ডিভিজুয়াল চরিত্র যা তার লেখায়, সুরে আর গায়নে ফুটে ওঠে। সময়ের ছাপ থাকলেও সময়ের ভিতরে সে একক। কিন্তু সেটাকে সেভাবে না দেখে একটা ‘ক্লাব’ করে দেওয়া, একটা ব্র্যাকেটের মধ্যে ভরে দেওয়ার প্রবণতা ছিল ওই ট্যাগের ভিতরে। এখন, ব্যক্তিগতভাবে আমার সম্পর্কে বললে, আমি তো জীবনমুখী নামকরণের সঙ্গে নিজেকে একেবারেই মেলাতে রাজি নই। জীবনমুখী বলার মধ্যে আসলে এক ধরনের বোধহীনতা ছিল বলে আমি মনে করি। কিন্তু ‘নাগরিক বিচ্ছেদী গান’ যখন ফারুক বলছে তখন সে কিন্তু ভেবেছে কথাটা নিয়ে। এটা ও ওর মনন আর শ্রবণের জায়গা থেকে বলছে। ফলে, এই দুই নামকরণের মধ্যে তফাৎ রয়েছে।
জীবনমুখী নামকরণের সঙ্গে নিজেকে একেবারেই মেলাতে রাজি নই। জীবনমুখী বলার মধ্যে আসলে এক ধরনের বোধহীনতা ছিল বলে আমি মনে করি।
এখন নাগরিক যদি বলেন তাহলে, আমি তো একটা নগরেরই মানুষ। একই সঙ্গে নাগরিক বলতে তো একরকম কিছু বোঝায় না। নাগরিক বলে তো কোনও একটা নির্দিষ্ট টেমপ্লেট নেই। নাগরিক অনেক রকম হয়। নগরের ভিতরে কতরকম নগর, কতরকম মানুষ, ব্যক্তি, কৌম সমাজ, একক মানুষ, একলা মানুষ কত কিছুই তো আছে। আমি একটা শহরে বড়ো হয়েছি, গ্রামে বড়ো হইনি। ফলে একভাবে নগর আমার জীবনে প্রবেশ করেছে। কিন্তু সেই নগর কলকাতা না। বাংলার কোনো অঞ্চলও না। আমার এক বন্ধু আছেন, আহমেদ ময়েজ, লন্ডনে থাকেন, ওঁর দাদা, অর্থাৎ ঠাকুরদার লেখা একটি গান ছিল – ‘নগরবাসী রে, আমি নগরে নগরে ঘুরিলাম’, সেদিক থেকে দেখতে গেলে আমরা হয়তো সেই ধরনের একটা যাত্রা করেই চলেছি। ব্যক্তিগতভাবে আমার জীবন আসলে যাত্রা বা ট্র্যাভেলিং-এর পাকে পাকে জড়ানো। সেই জায়গা থেকে নাগরিক। আর বিচ্ছেদ যদি বলেন, এখন বিচ্ছেদী গান বলতে কোন বিচ্ছেদকে বোঝায়? বিচ্ছেদী গানের একটা ধারা আছে। সে ধারাতে এই বিচ্ছেদের অনুভবটা সবচেয়ে স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে। এই বিচ্ছেদ, কার থেকে বিচ্ছেদ? কীসের বিচ্ছেদ? মানে, এই বিচ্ছেদ কি এক ধরনের বিচ্ছিন্নতাও? এক ধরনের এলিয়েনেশন? অথবা এই বিচ্ছেদ কি আসলে এক ধরনের অ্যাবসেন্স এবং একটা প্রেজেন্সের আকাঙ্ক্ষা? একটা কোথাও কাউকে চাওয়া, কিছুকে চাওয়া? এই সবই হয়তো আমার গানে আছে। আছে বৈকি! আমার গানে অপেক্ষা তো একটা থাকে। ফলে এই নির্দিষ্ট তকমাটা আমার খারাপ লাগে না। আমার অসুবিধা হয় না। আমি এটাকে এইভাবে দেখি না যে কোনও একটা জন্রর মধ্যে আমাকে ফিট করে দেওয়া হচ্ছে।
রাজর্ষি : এইখান থেকেই আমি পরের প্রশ্নে আসি, আপনি অপেক্ষা, বিচ্ছেদের কথা বলছেন। এটা একদমই আমার ব্যক্তিগত মনে হওয়া, যে আপনার গানে কি একটা অ্যাবসার্ডিটির ভাব রয়েছে?
মৌসুমী (হেসে): একটা লেখা পড়েছিলাম অনেকদিন আগে। আর্টিস্ট আর ক্রিটিকের মধ্যে তফাৎ হচ্ছে আর্টিস্ট একভাবে কাজটা করে আর ক্রিটিক তারপর তার মতো করে কাজটার বিশ্লেষণ করে! এখন আমাদের কাজ হচ্ছে একটা কিছু করা আর আপনাদের কাজ হচ্ছে সেটা বিশ্লেষণ করা! আপনার যদি মনে হয় যে আমার কাজের মধ্যে এক ধরনের অ্যাবসার্ডিজ়ম আছে, তাহলে সেটা আপনার মনে হতেই পারে। আমি অত তাত্ত্বিক মানুষ নই। যদি অ্যাবসার্ডের অর্থের জায়গা থেকে ভাবি, যে, কিছু একটা আমাকে করে যেতে হবে, কিন্তু তার ভিতরে একটা অর্থহীনতার বোধ কাজ করবে, একটা ‘মিনিংলেসনেস অফ এভরিথিং’, আমি বলবো আমার কিন্তু সবকিছুকে অর্থহীন লাগে না। এই যে প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বাঁচা আমার অর্থহীন মনে হয় না। আমার বেশ ভালোই লাগে বাঁচতে। কিন্তু কোনও লক্ষ্যে, কোনও গন্তব্যে আমি কি পৌঁছচ্ছি? হয়তো না। আমি হয়তো সিসিফাস-সম, ঠেলে যাচ্ছি পাথর এবং তা গড়িয়ে আসছে। আবার ঠেলছি। কিন্তু আমার এই পাথর ঠেলতে খারাপ লাগে না। আর আমার মনে হয় ‘আর কীই বা দিতে পারি’র মতো আর কীই বা করতে পারি আমি? আর কীই বা করার ছিল আমার? আমি আর কীই বা করতে পারতাম? এই সবকিছু কেন করছি, সে কথা আমার কখনওই মনে হয় না যে, সেটা কিন্তু নয়। তবে আমার কাছে ‘পারপাস’ এর থেকে ‘প্রসেস’টা বেশি জরুরি। উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যের থেকে প্রক্রিয়াটা আমাকে অনেক বেশি প্রাণ দেয়। কীসের জন্য বলতে পারি না, কিন্তু আমার জীবনকে ভালোই লাগে। আমি তো আসলে রান্নাঘরে কাজ করতেও খুব পছন্দ করি। কিছু না করতেও খুব পছন্দ করি। এমনি বসে থাকতেও পছন্দ করি। এমনিতে আমার ভিতরে যে বিষাদ আছে সেটা আছে। কিন্তু সেই বিষাদটাও আমার খারাপ লাগে না।
রাজর্ষি : বেশ। আচ্ছা, আপনি সবসময় মানুষের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। সেটা গানের মাধ্যমে হোক অথবা সরাসরি রাস্তায় নেমে হোক। এনআরসি সিএএ বিরোধী আন্দোলনের সময়ে একটা গানে কবীর সুমনের সঙ্গে আপনার একটি ভিডিও এখনও বেশ ভাইরাল। বারবার বিভিন্ন সময়ে আপনাকে জনগণের মধ্যে দেখা গেছে। এবার আপনি একভাবে মানুষকে মানুষের মধ্যে থেকে দেখেছেন। মানুষের মধ্যে কি কোনো পরিবর্তন আপনি লক্ষ করছেন? কোনও ম্যাসিভ চেঞ্জ? মানুষের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে শিল্পীরা একদম সরাসরিভাবে যোগদান করছেন, কোনো বিশেষ ছাতার তলায় না এসে নিজেদের আইডেন্টিটি বর্তমান রেখেই। সেইখান থেকে কি কোনো পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছেন? আগামীর স্বর কি খুঁজে পাচ্ছেন আপনি এর মধ্যে? নাকি মনে হচ্ছে কোথাও গিয়ে কিছু একটা ঘাটতি থেকে যাচ্ছে?
মৌসুমী : প্রথমত, এই ‘মানুষ’ এবং ‘আমি’, দুটো জিনিস আলাদা না। শিল্পী বলে আমি নিজেকে আলাদা কিছু মনে করি না। আমি যা করি নিজের তাগিদে করি। রাস্তায় অনেক মানুষের মধ্যে আমিও একজন। কোনও একটা পার্টিকুলার মোমেন্টে হয়তো একজনকে দেখতে পাওয়া যায় রাস্তায়। একটু চেনা হয়ে গেলে তাকে বেশি আইডেন্টিফাই করে লোকে। এখন সবার হাতে ক্যামেরা, ছবি তোলে, ভিডিও করে। তারপর সেসব পোস্ট করে। এতে আমার কোনওই হাত নেই। কিন্তু আমাকে যারা চেনে, ছোটোবেলা থেকেই চেনে, তারা জানে আমি এরকমই। এর মধ্যে তো আমি বিশেষ কিছু করিই না। আপনি বললেন যে, সুমনের সঙ্গে আমার ভিডিও ফুটেজ ভাইরাল হয়েছে। এই ভাইরাল হওয়া আমার জন্য কোনো বিশেষ তাৎপর্য রাখে না। সুমনের সঙ্গে আমি সেদিন পার্ক সার্কাসে ঘটনাচক্রে এনআরসি সিএএ বিরোধী অবস্থানে উপস্থিত ছিলাম। আমাদের বন্ধুদের যাবার কথা ছিল, দেখলাম সুমনও এসেছেন। সুমনের প্রসঙ্গে বলতে গেলে, অনেক কম বয়স থেকে আমি সুমনকে চিনি। গান শিখেছি ওঁর কাছে। এখন অত যোগাযোগ নেই। কিন্তু উনি আমার গুরুজন। উনি গান গাইছেন, আমায় ডাকলেন, আমিও তখন তাঁর সঙ্গে গলা মিলিয়ে একটা দুটো গান গাইলাম। সেই মুহূর্তটা সুন্দরই ছিল, অনেক দিন পর একসাথে। তারপর উনি চলে গেলেন আর আমরা বন্ধুবান্ধবরা আলাদা করে গান গাইলাম। কারণ আমরা তখন সবাই ভাবছিলাম কী করবো। আমাদের পক্ষে তখন ঘরে থাকাই সম্ভব ছিল না, তাই আমরা সবাই রাস্তায় ছিলাম। এর মধ্যে কোনও বিশেষত্ব একেবারেই নেই।
আমি যে রোজ বসে রেওয়াজ করছি, গান গাইছি, এমনটা নয়। তবে এক ধরনের ‘নিশ্চিন্তি’ আমার আছে যে গান জিনিসটা আছে আমার সঙ্গে, আমি না গাইলেও আছে।
মানুষ এবং শিল্পী, এই দুটো ক্যাটেগরি অনেকের ক্ষেত্রে পৃথকভাবে কাজ করতে পারে, কিন্তু সেটা আমার ক্ষেত্রে কাজ করে না। আজকের সময়ে আমার যদি কিছুর জন্যে মনে হয় যে আমাকে রাস্তায় নামতে হবে তবে আমি নামবো আর আমার যদি মনে হয় আমি ঘরে থেকে কিছু করতে পারছি তাহলে আমি সেটাও করবো। আর যদি মনে হয় যে এটা খুবই বিপজ্জনক, তখন আমাকে ভাবতে হবে আমি কতটা করতে পারবো আর কতটা পারবো না। আমার জায়গায় আর কেউ হয়তো অনেক বেশি পারবে। অনেক কথাই আজকাল ভেবে বলতে হয়। সময় তো অবশ্যই পাল্টেছে। একটা ত্রাসের সময় চলছে। এবং অবিশ্বাসের। কে যে কোথায় কীসের জন্যে মামলা করছে বোঝাই যাচ্ছে না, হ্যারাসমেন্টের পরিমাণটা চূড়ান্ত একটা জায়গায় রয়েছে। কে যে কখন কাকে ক্যান্সেল করে দিচ্ছে, তাও বোঝা যাচ্ছে না।
কিন্তু তার পরেও বলবো, মানুষের কথাই যদি বলেন, মানুষ তো লড়াই করছে। লড়ছে না এরকম তো নয়। সে সাহস তো দেখাচ্ছে। সবাই একই সময়ে সক্রিয় হবে, বা একটা সময় সক্রিয় ছিল বলে সারাটা সময় থাকবে, এরকমটা হয়তো নাও হতে পারে। কিন্তু লড়াইটা থামে না। মনে হয় থেমে গেছে, আসলে থামে না। সব সময় সব কিছু দেখতে পাওয়া যায় না। আমার একজন সিনিয়র দাদা তথা বন্ধু বলতেন, ভারি চমৎকার লাগে আমার কথাটা, যে আসলে বিপ্লব একটা দরজা জানালা খোলা ঘরের মতো। কেউ ঢুকবে, কেউ বেরোবে, কিন্তু ঘরটা আছে। ঘরটা থাকে।
রাজর্ষি : বুঝতে পেরেছি। আমার পরের প্রশ্নটা একটি পুরোনো সাক্ষাৎকারের সূত্রে আসছে। বাংলাদেশে দেওয়া আপনার একটি সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছিলেন যে, ‘অনেকে রাগ করতে পারে, তাও বলছি যে, কলকাতা অনেকাংশে মৃত। কিন্তু বাংলাদেশ এখনও একটা গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে’। এক্ষেত্রে আপনি এই কথাটিও বলেছিলেন যে বাংলাদেশের সার্বিক পরিপ্রেক্ষিতে আপনার একটা ভালোলাগা কাজ করে। তবে তারপর এখন একটা অনেক বড়ো ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ চলেছে, এখনও চলছে। আজকের দিনে, আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে আপনি কলকাতা এবং বাংলাদেশকে কীভাবে দেখছেন?
মৌসুমী : বাংলাদেশে আমি গত তিরিশ বছর ধরে যাই। আমার কাজের জগৎ যতখানি কলকাতা, তার থেকে কম তো নয়ই, হয়তো বা একটু বেশিই বাংলাদেশ। ফলে আমি দেখছি যে একটা ভাঙাগড়ার দেশ ভাঙাগড়ার ভিতর দিয়েই চলেছে। সেখানে এখন আর এক রকমের মুহূর্ত তৈরি হয়েছে। সেখানে অজস্র ধারা রয়েছে। বাংলাদেশকে আমি কীভাবে দেখছি সেটা এক কথায় বলা খুব কঠিন। এবার যদি কলকাতার কথা বলি, সার্বিকভাবে দেখুন, শিক্ষকদের যে আন্দোলন, শিক্ষকদের উপর যে জুলুমটা চলছে অথবা ডাক্তারদের যে আন্দোলনটা হল, নানাকিছু হয়ে চলেছে। এই শহরে, এই রাজ্যেই তো হচ্ছে। যুদ্ধ নিয়ে একটা আলোড়ন তৈরি হল, কিছু মানুষ বলার চেষ্টা করলো যুদ্ধ আসলে সমাধান নয়, অন্য কোনও পথও থাকতে পারে, তার মানে কিন্তু এটা নয় যে তারা বলছে পেহেলগাঁও ঠিক ছিল। এই কথা বলার জন্য তাদের আক্রমণ করা হল। অনেক কিছুই কলকাতায় চলছে, কিন্তু সে অর্থে বিপুল ব্যাপক কোনো আন্দোলন নেই এখন এই শহরে। যা হচ্ছে মানুষ কিছু বিশেষ বিশেষ পকেটে, ছোটো ছোটো আকারে করছে, দ্বীপের মতো করছে, কানেক্ট করার চেষ্টা করছে। কিন্তু বিরাট কোনো ঘটনা ঘটছে তেমনটা হয়্তো না। ফলে, মৃত হয়তো একটু বেশিই বলা হয়ে গিয়েছিল তখন, তবে সেটা ২০১৮-তে বলেছিলাম, হয়তো আমার হতাশার মাত্রা সেদিন চড়ে ছিল। কিন্তু তারপরেই এই শহর ২০১৯-২০’র ভিতর দিয়ে গেছে । সেই সময়ের জোশ আজ আবার নেই। তবু কলকাতা মৃত অবশ্যই না। হয়তো ক্লান্ত। হয়তো অনেক মানুষ নির্লিপ্ত। সার্বিকভাবেই বিশ্বজুড়ে মানুষ এখন নির্লিপ্ত। এবং অনেকেই খুব নিষ্ঠুর। তবু ছোটো ছোটো দ্বীপের মধ্যে কাজ হয়ে চলেছে। এই শহরেও মানুষ কিছু করে না এরকমটা নয়, তারা করে চলেছে। আর জি কর আন্দোলনের সময়ে তো স্পষ্ট করেই দেখা গেল কত মানুষ রাস্তায় নামলো, আন্দোলন করলো। তাদেরকে ঘটনাটা ধাক্কা দিয়েছে, নাড়া দিয়েছে। এমন মানুষ যারা কখনও মিছিলে হাঁটেনি, তাদেরও মনে হয়েছে যে কিছু করা দরকার। এটার অনেক কারণ থাকতে পারে। এটা ডাক্তারদের আন্দোলন না হয়ে অন্য কিছু হলে বিষয়টা এতটা বৃহৎ হত কি না বলা যায় না।
কলকাতায় অনেককিছুই হচ্ছে, কিন্তু তার সঙ্গে তুলনীয় নয় বাংলাদেশের পরিস্থিতি। বাংলাদেশের পরিস্থিতি আসলে এখন অন্য জায়গাতে রয়েছে। সেই জায়গাটায় নানান রকমের আকাঙ্ক্ষা, নানান অবদমিত আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পাচ্ছে, আবার একই সঙ্গে নতুন করে অনেক আকাঙ্ক্ষাকে চেপে দেওয়ার ব্যাপার দেখা যাচ্ছে, তার বিরুদ্ধে আবার উঠে দাঁড়ানোর ঘটনাও দেখছি। সেখানে মানুষের এখন ক্লান্ত হওয়ার কোনও অবকাশ নেই। বাংলাদেশে এখন আমি যা দেখি সেখানে সব বয়সের মানুষরা আছে। আমি নিঝুম নামে একটি মেয়েকে চিনি। ছোট্ট একটা মেয়ে, টুয়েলভের পরীক্ষা দিয়েছে, মাগুরাতে বাড়ি, সেই মেয়েটা থেকে শুরু করে কফিল আহমেদ, আনু মুহাম্মদ, এদের যদি ভাবি বা আরও সিনিয়রদের যদি ভাবি, এরা সকলেই চেষ্টা করে যাচ্ছে, লড়ে যাচ্ছে। এটার মধ্যে একটা অসম্ভব ‘টেকটনিক শিফট’-এর ব্যাপার রয়েছে। আমাদের এখানেও একটা কম্পন চলছে, সব সময় তা হয়তো টের পাওয়া যায় না, এই আর কি…
রাজর্ষি : গানের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে সোশ্যাল মিডিয়া, ইউটিউব এমনকি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সও এত বড়ো একটা অংশ গ্রাস করছে, এই পরিস্থিতিতে ইন্ডিপেন্ডেন্ট সিঙ্গার-সংরাইটারদের অবস্থান এবং ভবিষ্যৎ আপনি কীভাবে দেখছেন?
মৌসুমী : এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য আমি উপযুক্ত মানুষ নই। আমি ঠিক জানি না এই বিষয়ে। অনেক বিষয়েই আসলে কিছুই জানি না। আমার বাবা মা’র অসম্ভব ইচ্ছায় এবং প্রকৃতির নিয়মে আমি মোটামুটি গান গাইতে পারি, কিন্তু গান নিয়ে অত কথা বলার মতো মানুষ নই। অনেকের থাকে না যে, গায়ক সত্তাটা বা পার্সোনা’টা অনেক বড়ো হয়ে ওঠে! সেটা আসলে আমার ক্ষেত্রে নয়। এটা সেটা নানান কাজের মধ্যে গানও গাই। আমি যে রোজ বসে রেওয়াজ করছি, গান গাইছি, এমনটা নয়। তবে এক ধরনের ‘নিশ্চিন্তি’ আমার আছে যে গান জিনিসটা আছে আমার সঙ্গে, আমি না গাইলেও আছে। গান, গান লেখা, গান গাওয়া নিয়ে সেভাবে খুব বেশি ভাবি না।
শুরুতেই যেমন বলছিলাম, সিঙ্গার-সংরাইটারের মধ্যে তার ব্যক্তিত্বের ছাপটা একটা বড়ো ব্যাপার। আমাকে যদি বলেন, এখানে এখন আমি কি খুব বেশি সেটা দেখতে পাচ্ছি? তা কিন্তু না। আমার কানে তেমন রিমার্কেবল কিছু তো এসে পৌঁছচ্ছে না। হতে পারে যে আমি একটু একলা একলা থাকি, এবং এটা আমার লিমিটেশন। আমি যেখানে বেশি মিশি সেখানে বেশি শুনতে পাই, এমনও হতে পারে। বাংলাদেশে অনেকের সঙ্গে আমার গান গল্প হয়, হয়তো বেশিই হয় এখানকার তুলনায়। আসির আরমান যেমন। বা মাহা মির্জা। আবারও বাংলাদেশের কথা বলে ফেলছি। এবার এই এপ্রিল মাসে আমি ওপারে খনার মেলায় গিয়েছিলাম। মানে আলাদা করে যাবো বলে যাইনি, পৌঁছে গিয়েছিলাম। কফিল আহমেদরা একটা মেলা করছেন কিছু বছর ধরে, নেত্রকোণায়। সেখানে আমি এই বছর ছিলাম। কত জন এসেছিল, কত চমৎকার গান গাইছিল তারা। তার পরে একদিন ঢাকায় কৃষ্ণকলির বাড়িতে আমরা সবাই বসেছিলাম। কৃষ্ণকলি ইসলামের বাড়িতে। সেখানেও শুনলাম। তা যেটা বলছিলাম, আমার মনে হলো নতুনরা অনেকেই চমৎকার সিঙ্গার-সংরাইটার। সহজিয়ার রাজু, চিৎকারের পদ্ম। আসলে হয়তো ওরা অত নতুন না, আমি শুনিনি বলে আমার কাছে নতুন মনে হচ্ছিল। অনেক গান ওরা হয়তো গত কুড়ি বছর ধরে গাইছে। সবাই ইন্ডিভিজুয়াল, তাদের মধ্যে এক ধরনের ব্যক্তিগত শিল্পীর ছাপ আছে সেইসব সিঙ্গার-সংরাইটারদের মধ্যে।
আগে আমরা যখন গান প্রকাশ করেছি তখন কোম্পানির একটা ব্যাপার ছিল। আমরা কোম্পানিকে দিলাম, তারা আমাদের ঠকালো, হয়ে গেল গল্প শেষ। কিন্তু এখন সময়টা এমন যে তোমার ঠকে যাওয়ার দায়িত্বটা তোমাকেই নিতে হবে।
আমি অবশ্যই জানি যে কলকাতার একটা শ্রোতা গোষ্ঠির কাছে সাত্যকি, বর্ণ অনন্য ব্যান্ড, অর্ক মুখার্জি, এরা আজকের অত্যন্ত জরুরি শিল্পী। সাত্যকি আমার প্রিয়জন। তার প্রতি আমার পক্ষপাতিত্বও বেশি তাই। আরো অনেক ব্যান্ড আছে, পুরোনোরা নতুন গানের অ্যালবাম করছে, যেমন চন্দ্রবিন্দু। আমি জানি। অথবা শুনি ডোলিমান। অনেক একক শিল্পীও উঠে আসছে দেখি সমাজ মাধ্যমে, অনেক তরুণ শিল্পী। আমার ধারণ ক্ষমতার সীমাবদ্ধতায় সবার কথা ভালো করে জানা হয় না। আসলে, কোনো সময়ই ফাঁকা পড়ে থাকে না। কথাটা হচ্ছে, সময়ের ভিতর থেকে কোন গাছ জন্ম নেবে, তা সময় জানে আর সেই গাছ কতদূর যাবে, সে কথা ভবিষ্যৎ বলবে।
আর একটা কথা হলো, বাংলা গানের সিঙ্গার-সংরাইটার বললে এপার ওপার অপার, সবটাই ভাবতে হবে। আমি হয়তো বন্ধুদের কথাই বলে ফেলছি। ফলে, ধরা যাক লন্ডনে সোহিনী আলম। ও আছে, ওদের ‘ক্ষ’ বলে ব্যান্ড আছে, সেও এই সময়েরই কাজ। বাংলায় কাজ। যাঁরা মূলত নিজের লেখা সুর করা গান গাইছেন, তাঁদের কথাই বললাম। বাকি তো বাংলার নানা ধারার কতই গুণী শিল্পী রয়েছেন, আর তাঁদের গান মানুষ তো খুবই ভালোবেসে শোনেন। মস্ত মস্ত হল-ভরা অনুষ্ঠান হয়।
আরও একটা কথা আসলে আমি বলতে চাই। এই যে, সবার গান সমান সামনে আসে না, সবাই সমান সামনে আসতে চায়ও না। এই নিজেকে দেখানোর চরম সময়েও এমন মানুষ আছে যারা আড়ালেই থাকে। তাদের গান শুনে নিতে হয়। উৎপল বসুর কথা যদি ধরা যায়। ওর নাম কে জানে? ওর বিপজ্জনক সাঁকো গানটা যদি ভাবি, এমন গান ক’টা শুনেছি? ক’জন শুনেছেন এই গান? সাত্যকির একটা রেকর্ডিং আছে ইউটিউবে, সেও অবশ্যই ওর ‘মিলন হবে কত দিনে’র মতো লোকে শুনবে না। ফলে, শুধু যা দেখা যাচ্ছে, আর ভিউয়ারশিপের সংখ্যা, তা দিয়ে বিচার করলে জানা হবে না গান আসলে হচ্ছে, না কি হচ্ছে না।
রাজর্ষি : আপনি এখন আপনার নতুন অ্যালবাম নিয়ে কিছু ভাবছেন?
মৌসুমী : এই সব করা সত্যিই আমার দ্বারা খুব একটা হয়ে উঠছে না। আমি খুব ভাগ-হয়ে-থাকা একজন মানুষ। এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকি। আমার অনেকগুলো গান রেকর্ড করা আছে। এখানে কিছু গান সাত্যকির সঙ্গে আমি রেকর্ড করছি গত দু-বছর ধরে, লন্ডনে আমি অলিভারদের সঙ্গে কিছু কাজ করেছি। এখন সেগুলো যে কীভাবে প্রকাশ করবো ভেবে পাই না। আজকাল একটা অন্য ঝামেলা আছে, সবই নিজে নিজে করতে হয়। এটা চাপের ব্যাপার। আগে আমরা যখন গান প্রকাশ করেছি তখন কোম্পানির একটা ব্যাপার ছিল। আমরা কোম্পানিকে দিলাম, তারা আমাদের ঠকালো, হয়ে গেল গল্প শেষ। কিন্তু এখন সময়টা এমন যে তোমার ঠকে যাওয়ার দায়িত্বটা তোমাকেই নিতে হবে। ফলে ঠকে যাই অনেক সময়ে।
আমি আসলে পেরে উঠি না, সময়ে আমি কুলোতে পারি না। কিন্তু আমার করা উচিৎ। আমার আট দশটা, বা তারও বেশি কিছু গান তৈরি হয়ে রেকর্ডেড অবস্থায় পড়ে রয়েছে, কিন্তু আমি পেরে উঠছি না। আমি তো আসলে অন্যান্য অনেক কাজই করি। আমার গান নিয়ে কাজ বা গানের বাইরেও শব্দ এবং শ্রবণ নিয়ে কাজ চলে, তার সঙ্গে সঙ্গে গান চলে। এগুলো আমি করেই চলি। তার ক্ষেত্রগুলো খানিক ভিন্ন, এরকম অ্যালবাম হিসেবে হয় না। ধরুন গতবছর একটা এক্সিবিশনে আমি, দিবাকর সাহা এবং আরও দুজন মিলে আমাদের তৈরি করা একটা বড়ো সাউন্ড ইনস্টলেশন সেটা নিয়ে গোয়ায় সেরেন্ডিপিটি আর্ট ফেস্টিভালে গিয়েছিলাম। তার আগে বার্লিনে ডিস্টোপিয়া সাউন্ড আর্ট ফেস্টিভালে আমি একটা রেকর্ডেড সাউন্ডের সঙ্গে লাইভ পারফর্মান্স করেছিলাম। সামনে আমার আরও একটা এক্সিবিশন আছে, তার জন্য আমি কম্পোজিশনের কাজ করছি অন্যদের সঙ্গে। এ-ও আমার এক রকমের গান গাওয়া, সুর শ্রবণ নিয়ে থাকা।
রাজর্ষি : আপনি যে ‘ট্র্যাভেলিং আর্কাইভ’-এর কাজটি করছেন এত বছর ধরে, সেটা সাধারণ মানুষের কাছে কতটা পৌঁছাচ্ছে বলে আপনার মনে হয়?
মৌসুমী: দেখুন, কাজটা মানুষের জন্য খোলাই রয়েছে। আবারও প্রশ্নটা থেকে যায়, সাধারণ বলতে কাকে আমি বোঝাচ্ছি? কিছু মানুষ তাদের ব্যক্তিগত আগ্রহ থেকে এই কাজগুলো শোনে। অনেক মানুষ এগুলো শুনবে এমনটা আশাও করি না আমি। কিন্তু মানুষ চাইলে সেটা শুনতে পারে, আমাদের আর্কাইভে অবারিত দ্বার। এখন মানুষ শুনবে কি না সেটা মানুষের উপর নির্ভর করছে। যদি বলেন, ‘ট্র্যাভেলিং আর্কাইভ’ সম্পর্কে মানুষ জেনেছে কি না, আমি বলবো, ধীরে ধীরে জানছে। আমি কোনোদিন কাউকে গিয়ে বলিনি – আমার সম্পর্কে লেখো। এখনকার সময় শুধু বলছি না, এসব আগেও করতে হত, প্রেসকে গিয়ে বারবার বলতে হত, পাবলিসিটি নেটওয়ার্কিং-এর দিকে নজর দিতে হত, এগুলো আমি কোনওদিন করিনি, করবও না। এগুলো করার সময় বা ইচ্ছা কোনওটাই আমার নেই । বলতে পারেন আমি একটু উন্নাসিক, হয়তো তাই-ই। শেষে আবারও বলছি, ‘ফর মি দা প্রসেস ইজ় মাচ মোর ইম্পরট্যান্ট দ্যান দা পারপাস’, গন্তব্যের থেকে যাত্রাটা অনেক বেশি জরুরি, তাই কাজ করে যেতে হবে, আমি এটাই মনে করি।