
।। মো. হরমুজ আলী।।
১৮০৫ সালের ট্রাফালগার যুদ্ধের স্মরণি এই স্কোয়ার, ব্রিটিশ নৌবাহিনীর সেনানায়ক নেলসন এর নেতৃত্বে ফরাসি ও স্প্যানিশদের পরাজিত করার গৌরবগাঁথা হয়ে লন্ডনের কেন্দ্রস্থলে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। যদিও পর্যটকদের কাছে এটা কেবলই দৃষ্টিনন্দন মিলনকেন্দ্র আর বৃটিশদের গৌরবময় ইতিহাসের স্বাক্ষী, বাঙালিদের কাছে তার থেকেও একটু বেশি।
পঁচিশে মার্চ একাত্তরের কালো রাত্রিতে হানাদার পাকিস্তানিরা যেদিন ঘুমন্ত বাঙালির উপর পাশবিক হত্যাযজ্ঞ শুরু করে, সেদিন থেকেই যুক্তরাজ্যের অভিবাসী বাঙালি ঐ পাশবিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠে; এর একটা প্রেক্ষাপটও ছিলো। আয়ুবশাহীর অবৈধ ক্ষমতা দখলের শুরু থেকে পুরো ষাটের দশক জুড়ে যুক্তরাজ্যের বাঙালিরা এই দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। বিশেষকরে বঙ্গবন্ধু মুজিবকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসানোর পর থেকে এই বিরোধিতা আরো গতি পায়, যার ফলশ্রুতিতে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্যার টমাস উইলিয়াম কিউসিকে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো সহ বিশ্ব জনমত গঠনে প্রবাসীরা উদ্যোগী হন। তারপর ‘৭০ এর নির্বাচন ও বিশেষকরে ‘৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাজ্যই ছিলো আমাদের দ্বিতীয় ফ্রন্ট; যা মুজিবনগর সরকার ও জাতিরপিতা মুজিব বারবার কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেছেন এবং আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রেও প্রবাসীদের অবদান লিপিবদ্ধ আছে।
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ছিলো প্রবাসী বাঙালিদের জন্য নির্ঘুম উৎকণ্ঠা, আর বিশ্ব জনমত গঠনে ক্লান্তিহীন আন্দোলন-সংগ্রামের কাল। এই সংগ্রামের ইতিহাসে ১লা আগষ্ট ‘৭১ এক মাইলফলক হয়ে আছে। সেদিন যুক্তরাজ্যের প্রতিটি শহর (যেখানেই বাঙালিদের বসবাস ছিল) থেকে সেন্ট্রাল লন্ডনের ঐতিহাসিক ট্রাফালগার স্কোয়ারমুখী মানুষের ঢল নামে। হাজার-হাজার বাঙালির ‘স্টপ জেনোসাইড’ আর ‘রিকগনাইজ বাংলাদেশ’ শ্লোগানে পশ্চিম লন্ডনের আকাশ সেদিন মুখরিত ছিল। এবং ঐদিনের পর থেকে দেশে-বিদেশে পাকিস্তানি আর তাদের দোসরদের মনস্তস্ত্বে যে ধস নামে তা আর পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়নি।

একই ট্রাফালগার স্কোয়ার, সময়ের ব্যবধান ৫৪ বছর ১ মাস ১৫ দিন। একই চেতনা, একই উৎকণ্ঠা আর একই প্রত্যয়ে ট্রাফালগার আবারো জ্বলে উঠলো। এবারকার লক্ষ্যবস্তু দখলদার ‘অশরীরী পাকিস্তানি’! যারা তিরিশ লক্ষ শহীদ আর দু’লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমে অর্জিত স্বাধীনতা আর মুক্তিযুদ্ধকে চ্যালেঞ্জ করেছে, চ্যালেঞ্জ করেছে রক্তের আকরে লেখা বাহাত্তরের সংবিধান, জাতীয় সঙ্গীত, পতাকা আর বঙ্গবন্ধুকে; এই দেশি-বিদেশি কূটচালের বিরুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি জেগে উঠেছে, উচ্চকণ্ঠ হয়েছে প্রতিবাদে। যুক্তরাজ্যের এমন শহর খুঁজে পাওয়া দুস্কর হবে যেখান থেকে মানুষ ট্রাফালগারে জড়ো হয়নি! মুক্তিযোদ্ধা, কবি, সাংবাদিক-সাহিত্যিক, রাজনৈতিক কর্মী, কে-না এসেছেন এই অবৈধ দখলদার ইউনুস গংদের বিরুদ্ধে এবং মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের পক্ষে আওয়াজে শরিক হতে। অশীতিপর প্রবীণ থেকে কিশোর-তরুণ, সকলের কণ্ঠে একই আওয়াজ – জয়বাংলা। অপুর্ব প্রাণচাঞ্চল্যে এমনও মানুষকে দেখা গেছে যারা একাত্তরে আগষ্টের ১ তারিখের সেই ঐতিহাসিক মিছিলেও শরিক ছিলেন।
পৃথিবীতে এমন কোনো সরকার খুঁজে পাওয়া যাবেনা, যে সরকারের কোনো না-কোনো ব্যর্থতা বা স্খলন নেই; উন্নত বিশ্ব থেকে শুরু করে অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশ, সকল দেশ এবং সরকারের ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য। কোনো সরকার যখন মানুষের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হবে তখন নির্বাচনের মাধ্যমে এমনকি গণ অভ্যুত্থানেও সেই সরকার পরিবর্তন হতে পারে। কিন্তু কখনোই সেই জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য বা জাতীয় অর্জনের জায়গাগুলোতে আঘাত করার কোনো নজির নেই। যখনই এমনটা প্রতিভাত হবে, তখনই বুঝতে হবে যে এখানে সরকার পরিবর্তনের নামে লুকায়িত এজেন্ডা বাস্তবায়নের ষড়যন্ত্র কাজ করছে; যেমনটা হয়েছে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তথাকথিত জুলাই-আগষ্টের অভ্যুত্থানের আড়ালে! লেখার কলেবর দীর্ঘায়িত না করেও বলা যায় যে যদি অশুভ ষড়যন্ত্র না থাকতো তাহলে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, বীরশ্রেষ্ঠ, বঙ্গবন্ধু, মুজিবনগর সরকার, রবীন্দ্রনাথ, বেগম রোকেয়া, জয়নুল আবেদীন, ধানমন্ডির ৩২ থেকে শুরু করে এমন কিছু নেই যা একাত্তরকে ধারণ করে আর দখলদারদের রোষানলে পড়েনি! সুতরাং, ১৫ সেপ্টেম্বরে, খুবই পরিস্কারভাবে এবং উচ্চকণ্ঠে প্রবাসী বাঙালি জানিয়ে দিয়েছেন – এটা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ, আমাদের জাতীয় অর্জনগুলোকে অপমানিত করে, অস্বীকার করে পার পাওয়া যাবেনা। বিজয়ী বাংলাদেশকে বিজিত পাকিস্তানের আদর্শিক রাষ্ট্রে পরিণত করা যাবেনা। ট্রাফালগারের এই দৃঢ় অঙ্গীকার আর সুউচ্চ উচ্চারণ যে দখলদারদের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে তা ইতোমধ্যেই দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। একাত্তরের আগষ্ট আর পঁচিশের সেপ্টেম্বর, টেমসের দোলায়িত তরঙ্গে আজ একাকার হয়ে গেছে।
লেখক: রাজনীতিবিদ ও সমাজকর্মী লন্ডন, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫