রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশে যে আশঙ্কার পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তা দিনকে দিন আরও গভীর হয়ে পড়ছে। ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মামলার বাণিজ্য, মব সন্ত্রাস ও সরকারি দল এনসিপি সংশ্লিষ্ট কিছু চক্রের চাঁদাবাজিসহ ব্যবসায়ীদের প্রতি সরকার খড়গহস্থ হওয়ায় দেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ খাত গভীর সংকটে পড়েছে।
গত ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে একাধিক ব্যবসায়ী গ্রুপ ও শিল্প প্রতিষ্ঠান হয়রানির শিকার হচ্ছে। কোথাও চলছে ভুয়া মামলার হুমকি, কোথাও জোর করে চাঁদা আদায়ের চেষ্টা, আবার কোথাও শ্রমিকদের উস্কে দিয়ে কারখানায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে। বেক্সিমকো গ্রুপের ১৬টি কারখানা বন্ধ করে সম্পদ লুটপাট করা হয়েছে, গাজী গ্রুপের কারখানার মালামাল লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে গ্রুপটিকে ধ্বংস করা হয়েছে। এস আলম গ্রুপের সম্পদও লুটপাট হয়েছে। গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন বহু ব্যবসায়ী।
এমন আতঙ্কজনক পরিস্থিতিতে অনেক ব্যবসায়ী দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। ফলে, একদিকে যেমন বিনিয়োগে স্থবিরতা, অন্যদিকে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, যা অর্থনীতির জন্য ভয়ানক অশনিসংকেত।
বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু স্পষ্টভাবে বলেন, শুধু টাকা থাকলে হয় না, বিনিয়োগের জন্য নিরাপদ ও স্থিতিশীল পরিবেশ লাগে। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের অনুপস্থিতিতে বেসরকারি খাতের উন্নতির কোনো সম্ভাবনাই নেই।
গাজীপুর, আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামের পোশাকশিল্প জোনগুলোতে সম্প্রতি শ্রমিক অসন্তোষকে ইন্ধন দিয়ে সহিংসতা ছড়ানো হয়।
বিজিএমইএ’র তথ্যমতে, আগস্টের ঘটনায় চার শতাধিক কারখানা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে।
একজন শিল্প মালিক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমার ৩০ বছরের ব্যবসা এক রাতেই শেষ হয়ে গেল। দিনের পর দিন নিজে কারখানায় পাহারা দিয়েছি, কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। পরিকল্পিতভাবে হামলা ও আগুন দেওয়া হয়েছে।
বিভিন্ন সূত্রের দাবি, ড. ইউনূসের কিংস পার্টি খ্যাত এনসিপির স্থানীয় পর্যায়ের কিছু নেতা ও সহযোগী গোষ্ঠী এই অস্থিরতা কাজে লাগিয়ে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জোর করে চাঁদা আদায়ের চেষ্টা করছে। চাঁদা না দিলে বা রাজনৈতিক আনুগত্য না দেখালে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে, কিংবা শ্রমিকদের উস্কে দিয়ে হামলার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। জামায়াত-বিএনপিও এই চাদাবাজি ও মব সন্ত্রাসে যুক্ত রয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সফিকুল ইসলাম খান সবুজ বলেন, গত আগস্ট থেকেই একটি অসাধুচক্র মামলা বাণিজ্যে নেমেছে। তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা করছে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনছে।
ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক ও আস্থাহীনতার কারণে নতুন বিনিয়োগ কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি জুলাই মাসে মাত্র ৬.৫২%, যা স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধির চেয়ে অনেক কম। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি কমেছে ২৫%। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৩.৯৭%, আগের বছরের তুলনায় কম। বেসরকারি বিনিয়োগ কমে দাঁড়িয়েছে জিডিপির ২২.৪৮%, আগের বছরে যা ছিল ২৩.৫১%। দেশে বেকারের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ লাখ ৩০ হাজার।
আস্থা ফিরিয়ে আনাই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরি বলেন, নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না, ঋণগ্রহণ কমে গেছে, কাঁচামালের আমদানি কমছে। এগুলো সবই আস্থাহীনতার প্রতিফলন। নির্বাচিত সরকার না এলে এই অবস্থা থেকে উত্তরণ অসম্ভব।
বিআইআইএসের গবেষণা পরিচালক ড. মাহফুজ কবির বলেন, সরকারকে তার কাজের মাধ্যমে দেখাতে হবে যে তারা ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে চায়। তা না হলে কোনোভাবেই অর্থনীতির চাকায় গতি ফেরানো সম্ভব নয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবসায়ীদের আস্থায় ফেরাতে বিভিন্ন আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। বাণিজ্য উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে ব্যবসায়ী নেতারা একটি হয়রানিমুক্ত পরিবেশ ও দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালার দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু ব্যবসায়ীদের মতে, শুধু প্রতিশ্রুতি নয়, জরুরি ভিত্তিতে বাস্তবায়ন দরকার।
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, মিথ্যা মামলা ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে অনেক ব্যবসায়ী দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। আমরা সরকারকে বারবার বলছি, এগুলো দ্রুত সমাধান না হলে পোশাক খাতসহ বেসরকারি খাতে ধস নামবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি বেসরকারি খাত। কিন্তু মামলা বাণিজ্য, মব সন্ত্রাস ও রাজনৈতিক চাঁদাবাজি ব্যবসায়ীদের মধ্যে ভয় ও অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, একটি নির্বাচিত, জবাবদিহিমূলক সরকার, আইনশৃঙ্খলার উন্নয়ন, নীতিনির্ধারণে স্থিতিশীলতা এবং হয়রানিমুক্ত ব্যবসা পরিবেশ নিশ্চিত না হলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়।