বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে তার ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুতর সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকিং খাত, নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) এবং শেয়ারবাজার—অর্থনীতির এই তিনটি প্রধান স্তম্ভই চরম অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে। খেলাপি ঋণের দুষ্টচক্র, দুর্বল নিয়ন্ত্রণ, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, দুর্নীতি এবং নিম্নমানের কোম্পানির আধিপত্যের কারণে অর্থনীতি একটি বিপজ্জনক অবস্থায় পৌঁছেছে, যা ভবিষ্যতের জন্য অনিশ্চয়তা আরও গভীর করছে।
ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের জাল
শিথিল নীতি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং দুর্নীতির কারণে ব্যাংকিং খাত খেলাপি ঋণের ভারে জর্জরিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, জুন মাসের শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ৬ লাখ কোটি টাকা। এছাড়াও, আরও ৩.১৮ লাখ কোটি টাকার গোপন খেলাপি ঋণ প্রকাশের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এর মধ্যে ১.৭৮ লাখ কোটি টাকা মানি লোন কোর্টে আটকে আছে, ৮০,০০০ কোটি টাকা বাতিল করা হয়েছে এবং ৬০,০০০ কোটি টাকা আদালতের স্থগিতাদেশের আওতায় রয়েছে। ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো (সিআইবি) আপডেট করার পর এই পরিমাণ ৯ লাখ কোটি টাকায় পৌঁছাতে পারে।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে সরকার নতুন ব্যাংকিং কোম্পানি আইনের খসড়ায় “ইচ্ছাকৃত খেলাপি” সংজ্ঞাটি বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করেছে। খসড়ায় বলা হয়েছে, ইচ্ছাকৃত খেলাপি চিহ্নিত করা জটিল এবং বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তবে ২০২৩ সালের সংশোধিত আইনে প্রতিটি ব্যাংককে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের তালিকা তৈরি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, “পূর্ববর্তী সরকারের আমলে ঋণের নামে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে। অনেক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধ করেননি। এ কারণে নতুন খসড়ায় এই সংজ্ঞা বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।”
বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, প্রকৃত খেলাপিদের হিসাব প্রকাশ করা হলে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের চিহ্নিত করা সম্ভব। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মঈনুল ইসলাম বলেন, “ঋণ পুনঃতফসিল, বাতিল এবং সুদ মওকুফের সংস্কৃতি ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্যের উন্নতি করে না, এমনকি কাগজে-কলমে খেলাপি কমলেও। যা ঘটছে তা প্রকাশ করতে হবে। এটি দীর্ঘমেয়াদে ব্যাংকিং খাতের জন্য উপকারী হবে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বৃহত্তর স্বচ্ছতার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেন, “এখন থেকে কোনো তথ্য গোপন রাখা হবে না। সব খেলাপি ঋণ প্রকাশ করা হবে এবং কঠোরভাবে আদায়ের প্রচেষ্টা চালানো হবে।”
এশিয়ার সবচেয়ে দুর্বল ব্যাংকিং ব্যবস্থা
এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) সম্প্রতি জানিয়েছে, বাংলাদেশ এশিয়ায় সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণের পরিমাণে শীর্ষে রয়েছে। ২০২৪ সালে দেশের মোট বিতরণকৃত ঋণের ২০.২% খেলাপি হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ২৮% বেশি। এডিবি বাংলাদেশকে এশিয়ার “সবচেয়ে দুর্বল ব্যাংকিং ব্যবস্থা” হিসেবে বর্ণনা করেছে।
তুলনামূলকভাবে, ভারত, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কা সংস্কারের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কমাতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “নিয়ম যত কঠোর হবে, খেলাপি ঋণের সংখ্যা তত বাড়বে। ভারতের মতো সাহসী সংস্কার ছাড়া এই সংকটের সমাধান হবে না।”
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, “রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ না করা এবং বিচার ব্যবস্থা শক্তিশালী না করা পর্যন্ত এই সমস্যার সমাধান হবে না।”
এনবিএফআই খাত ধসের দ্বারপ্রান্তে
নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা আরও ভয়াবহ। এ খাতে মোট ঋণের ৮৩% খেলাপি হয়ে পড়েছে, যা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যত ধসের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
শেয়ারবাজারে ধস
শেয়ারবাজারে ৩৮% পতন হয়েছে, এবং অর্ধেক কোম্পানির শেয়ারমূল্য ১০ টাকার নিচে নেমে গেছে। নিম্নমানের কোম্পানির আধিপত্য এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থার অভাব এই পতনকে ত্বরান্বিত করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বচ্ছতা, কঠোর নিয়ন্ত্রণ, এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধের মাধ্যমে এই সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব। তবে এর জন্য দ্রুত এবং সাহসী পদক্ষেপ প্রয়োজন। অন্যথায়, অর্থনীতির এই তিন স্তম্ভের অবনতি দেশকে আরও গভীর সংকটের দিকে ঠেলে দেবে।