‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি আন্তর্জাতিকভাবে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়টির স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রির স্বীকৃতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাজ্যে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা আবু বক্কার সম্প্রতি সিঙ্গাপুরে কর্মরত অবস্থায় এমপ্লয়মেন্ট পাস নবায়নের জন্য আবেদন করেছিলেন। দেশটির নিয়ম অনুযায়ী শিক্ষাগত যোগ্যতার জন্য নির্ধারিত ১০ নম্বরসহ মোট ৪০ নম্বর পেলে পেশাজীবীরা এমপ্লয়মেন্ট পাস পান। তবে তার আবেদনের প্রেক্ষিতে সিঙ্গাপুরের জনশক্তি মন্ত্রণালয় জানায়, যুক্তরাজ্যের মানদণ্ডে ঢাবির স্নাতকোত্তর ডিগ্রি কেবল স্নাতকের সমমান, আর স্নাতক ডিগ্রিকে ধরা হচ্ছে ফাউন্ডেশন কোর্স হিসেবে। ফলে তিনি নির্ধারিত কোনো নম্বরই পাননি।
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, আবেদনকারী চাইলে শুধু স্নাতক ডিগ্রির ভিত্তিতে আপিল করতে পারেন। তবে সে ক্ষেত্রে বেতন, বৈচিত্র্য ও স্থানীয় কর্মসংস্থানে অবদানের হিসাব ধরে ৪০ নম্বর পূরণ করতে হবে।
এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরাও। সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষ তাদের ডিগ্রিকে ‘ডিপ্লোমা’ হিসেবে বিবেচনা করছে, যার ফলে তারা চাকরির ভিসা নবায়নের পয়েন্ট থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
একই ধরনের পরিস্থিতির কথা জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডসহ বিভিন্ন দেশে স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা।
যুক্তরাজ্যে পঠনরত মোহাম্মদ ইউনুস বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর ডিগ্রিকে এখানে সমমান হিসেবে ধরা হয় না। বিশেষত সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষার্থীদের পিএইচডি করার আগে আবারো স্নাতকোত্তর কোর্স সম্পন্ন করতে হয়।’
শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মান নিশ্চিত না করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি, কারিকুলাম আন্তর্জাতিক মানে হালনাগাদ না করা এবং আন্তর্জাতিক অ্যাক্রেডিটেশন সংস্থার সঙ্গে চুক্তির অভাবই এই সংকটের মূল কারণ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এসএম হাফিজুর রহমান বলেন, ‘ঢাবির শিক্ষার্থীরা বিশ্বজুড়ে মেধার পরিচয় দিচ্ছেন। ডিগ্রিগুলোকেও আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়। সিঙ্গাপুরে কেন ভিন্ন মূল্যায়ন হলো তা পরিষ্কার নয়। তবে সামগ্রিকভাবে আমাদের উচ্চশিক্ষায় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। গবেষণা ও অবকাঠামোগত ঘাটতি, ওয়েবসাইটে নিয়মিত তথ্য হালনাগাদ না করা এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির অভাব এর মধ্যে অন্যতম।’
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যা ১৭১। এর মধ্যে সরকারি ৫৬ এবং বেসরকারি ১১৫টি। কিন্তু কিউএস ও টাইমস হায়ার এডুকেশন প্রকাশিত সর্বশেষ বিশ্ব বিশ্ববিদ্যালয় র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠানই সেরা ৫০০–র মধ্যে জায়গা পায়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৫৮৪তম স্থানে, আর গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ৮০০ থেকে ১ হাজারের মধ্যে।
অ্যাক্রেডিটেশনের অভাব
২০১৮ সালে উচ্চশিক্ষার মান নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল প্রতিষ্ঠিত হলেও সাত বছর পেরিয়ে গেলেও তারা এখনো কোনো অ্যাক্রেডিটেশন সনদ দেয়নি। মাত্র পাঁচটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদন এখনো প্রক্রিয়াধীন।
কাউন্সিলের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মেসবাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘দেশে শিক্ষার মান আশানুরূপ নয়। আমরা আন্তর্জাতিক অ্যাক্রেডিটেশন সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমঝোতা করেছি এবং বিভিন্ন কর্মশালা করছি। তবে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অ্যাক্রেডিটেশন বাধ্যতামূলক করা হলে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে।’
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
সম্প্রতি ডেনমার্কের উচ্চশিক্ষা ও বিজ্ঞান মন্ত্রণালয়ও বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের মান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আটটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা দেশটির শিক্ষাব্যবস্থায় মানিয়ে নিতে পারছেন না এবং অন্যান্য দেশের শিক্ষার্থীদের তুলনায় খারাপ ফল করছেন। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ভবিষ্যতে ভিসা প্রদানে কঠোর শর্ত আরোপ করা হতে পারে।
সাবেক ভিসির মতামত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও সাবেক ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এসএমএ ফায়েজ বলেন, ‘ঢাবির শিক্ষার্থীরা বিশ্বজুড়ে ভালো করছে। তবে কিছু দেশে পিএইচডির আগে তাদের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে শিক্ষার্থীদের স্নাতকোত্তর কোর্স করানো হয়। এটি শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই নয়, অন্য দেশগুলোর ক্ষেত্রেও ঘটে।’
তিনি আরও বলেন, ‘রাজনৈতিক কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ানো হলেও প্রয়োজনীয় মান নিশ্চিত করা হয়নি। কিছু বিশ্ববিদ্যালয়কে বন্ধও করা যাচ্ছে না, কারণ অনেক শিক্ষার্থী সেখানে ইতিমধ্যেই অধ্যয়ন করছে। ফলে সংকট থেকে যাচ্ছে।’
এ বিষয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদের মন্তব্য পাওয়া যায়নি।