নতুন কোনো শিল্প স্থাপন, ব্যবসা সম্প্রসারণ কিংবা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ-এসব কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে দেশে। পরিস্থিতি এতটাই সংকটাপন্ন যে, বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণ প্রবৃদ্ধি ইতিহাসের সর্বনিম্নে নেমে এসেছে, যা দেশের অর্থনীতিতে এক গভীর স্থবিরতার সংকেত বহন করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জুলাই মাসে বেসরকারি খাতের ব্যাংক ঋণ স্থিতি কমেছে প্রায় ৫ হাজার ৫৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ, ঋণ প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) একে ঐতিহাসিকভাবে সর্বনিম্ন বলে আখ্যায়িত করেছে।
ব্যবসায়ীদের অনাগ্রহ, উচ্চ সুদহার, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং ব্যাংকগুলোর রক্ষণশীল নীতিই এই পতনের পেছনে মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
ইস্ট কোস্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজম জে চৌধুরী বলেন, ‘ব্যবসা সম্প্রসারণ নয়, আমরা বিদ্যমান ব্যবসা কীভাবে বাঁচিয়ে রাখব, সেটাই এখন মূল ভাবনার বিষয়।’
বেসরকারি খাতে উদ্যোক্তাদের এই মনোভাবের পেছনে রয়েছে ব্যাংক ঋণের অপ্রাপ্যতা, সুদের উচ্চ হার এবং সরকারের সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগের অভাব। উচ্চ সুদে সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগকেই এখন অধিকাংশ ব্যাংক নিরাপদ ও লাভজনক মনে করছে। ফলে বেসরকারি খাতে নতুন ঋণ বিতরণ কার্যত বন্ধ।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘বেশিরভাগ ব্যাংক এখন সরকারি বন্ডেই বিনিয়োগ করছে। উদ্যোক্তারাও ঋণ নিতে চাইছেন না।’
সরকারি উন্নয়ন ব্যয়েও দেখা যাচ্ছে উদ্বেগজনক স্থবিরতা। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ২.৩৯%, যা আগের বছরের তুলনাতেও কম। কাঠামোগত সমস্যা ও কার্যকর তদারকি না থাকায় সরকারি প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন ব্যাহত হচ্ছে।
দেড় বছরের বেশি সময় ধরে কোনো নতুন কোম্পানি আইপিওর মাধ্যমে তালিকাভুক্ত হয়নি। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের আগ্রহ কম, তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা স্থির, আর উৎপাদন খাতের সম্প্রসারণ বিনিয়োগও নগণ্য—গত এক বছরে মাত্র ১২টি কোম্পানি মোট ২,১১৩ কোটি টাকার সম্প্রসারণ বিনিয়োগ ঘোষণা করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক গত তিন অর্থবছর ধরে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করছে। নীতি সুদহার ৫% থেকে বাড়িয়ে ১০% পর্যন্ত উন্নীত করা হলেও, মূল্যস্ফীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসেনি। বরং এ নীতির প্রভাবে সুদহার বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৬%, যা বিনিয়োগের বড় প্রতিবন্ধকতা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ, সুদহার স্থিতিশীলতা, ব্যাংক ও পুঁজিবাজার সংস্কার, এবং সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে গঠনমূলক সংলাপের প্রয়োজন। তা না হলে, শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সবকিছুই মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে।