
মো. তবারুকুল ইসলাম
একটু বিস্তারিত না বললে আয়োজনটির অনন্যতা ও বিশালত্বের কিছুই বুঝানো যাবে না।
দূর থেকে দেখলে মনে হবে কোন বিয়ে বাড়ির আয়োজন, কিংবা প্রচলিত কোন আলোকসজ্জা। কিন্তু আসল ঘটনা এর ধারে কাছেও না। এটি রীতিমত এক অগ্নিকাণ্ড! আগুন নিয়ে খেলা! আগুনের শৈল্পিক প্রদর্শনী।
নির্মম, নিষ্ঠুর, ভয়াবহ, ধ্বংসাত্মক, নিয়ন্ত্রণহীন ও চরম ভীতিকর আগুনেরও যে বহুমাত্রিক, নান্দনিক রূপশোভিত, উপভোগ্য মায়াবী দিক রয়েছে- এ আয়োজন না দেখলে তা অজানাই থেকে যেত। দক্ষ, অভিজ্ঞ, নিপুণ কারিগরের ভাবনা ও পরিকল্পনায় লেলিহান আগুনও পোষ মানে। বশে থাকে। প্রজ্জ্বলিত হয় শান্ত, স্থির ও নিয়ন্ত্রিত অসংখ্য অগ্নিশিখায়।
আগুন জ্বলছে জলের ফোয়ারায়, জ্বলছে ঘূর্ণিয়মান চাকায়, আগুন জ্বলছে লোহার কাঠামোতে ঝুলানো থোকায় থোকায়। কোনো কোনো কারিগরকে দেখলাম- বড়সড় এক লোহার চাকা ঘুরিয়ে ভীষণ মনযোগে-মমতায় যেন অগ্নিশিখায় নাচন তুলছেন। শান্ত দীপ্ত শিখা কখনো ধীরে ধীরে বেড়ে অস্বাভাবিক উচ্চতায় দাউ দাউ করে জ্বলছে। কখনো ধীরে ধীরে কমে একেবারেই নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। পরক্ষণেই আবার ধাপ্ করে ছাড়ছে বিশাল এক ফুলকি। অথবা কেবলই কালো ধোঁয়ার কুন্ডলী। পুরো আয়োজনের বিভিন্ন প্রান্তে ছিলো বিচিত্র সুর ও সঙ্গীতের মিতালী। সবমিলিয়ে এই অগ্নিসজ্জার শৈল্পিক উপস্থাপনা- রূপ, ঝলক, ধোঁয়া, গন্ধ ও উষ্ণ আভা একেবারেই অপার্থিব।
ডকল্যান্ড এলাকায় অবস্থিত ‘সিটি হল’ নামে পরিচিত লন্ডন মেয়র অফিসের সামনের ও পাশের বিস্তৃত খোলা ময়দানজুডে স্থলে ও জলে কাল রাতে দেখে এলাম এই অনন্য আয়োজন। যা ছিলো দুই নিশি আয়োজনের শেষ নিশি।
কেবল জাহাজনির্ভর বৈদেশিক বাণিজ্যের আমলে এই ডকল্যান্ড ছিলো লন্ডনের অর্থনীতির প্রাণ। সময়ের পরিবর্তনে বিশ্বের বৃহত্তম ডকগুলো পড়ে ছিলো অকেজো। এক সময়ের কোলাহলপূর্ণ জনপথ হয়ে পড়ে জনমানবশূন্য। দীর্ঘ বিরতির পর পতিত ডকল্যান্ড আবারো জেগে উঠেছে। তবে ভিন্ন রূপে- ভিন্ন অবয়বে। অট্টালিকা, এয়ারপোর্ট ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় ডকল্যান্ড এখন আবারো লন্ডনের অর্থনীতির অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। সম্ভবত একারণেই লন্ডন পরিচালনার মূলকেন্দ্র ‘সিটি হল’ সেন্ট্রাল লন্ডন ছেড়ে এখানটায় স্থিত হয়েছে।
এই ঘুরে দাঁড়ানোর মৌলিক শক্তি কিন্তু একই রয়ে গেছে- বৈশ্বিক সংযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্য আর বহু জাতি, ধর্ম ও বর্ণের মানুষের বৈচিত্র্যপূর্ণ সহাবস্থান।
ডকল্যান্ডের ইতিহাস ও এর ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প তুলে ধরতেই এই আগুন নিয়ে খেলা। কারণ অগ্নিশক্তি নিজেই বিনাশ ও পুনর্জাগরণের মূর্ত প্রতীক।
আগুনের জাদু ও ভাস্কর্য–নির্ভর ইনস্টলেশনের জন্য জগৎখ্যাত ফরাসি শিল্পসংগঠন ‘কোম্পানি কারাভোস’ (Compagnie Carabosse) এটি পরিবেশন করে। প্রদর্শনীটির নাম দেয়া হয়েছে – Rekindling
ফরাসি এই শিল্পদলের মন্সিয়ানা হচ্ছে- তারা খোলা আকাশের নিচে শহরের রাস্তা, উদ্যান, দুর্গ বা প্রাচীন স্থাপত্যকে রূপান্তরিত করে এক রহস্যময় অগ্নিলোকের মঞ্চে।