কবির য়াহমদ
“প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের প্রতি বিশ্বনেতাদের পূর্ণ সমর্থন” —প্রথম আলোর এই শিরোনাম দেখে প্রতিবেদনে আগ্রহ জন্মালো। দেখি তো—এ বিশ্বনেতারা কারা?
সংবাদটা বাসস’র। বাসস মানে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা; অর্থাৎ সরকারি বার্তা সংস্থা। প্রথম আলোসহ অনেকগুলো গণমাধ্যম এটাকে গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছে।
সংবাদ পরিবেশনটা এমন যে—“প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং তাঁর অন্তর্বর্তী সরকারকে পূর্ণ সমর্থন জানাতে গতকাল শুক্রবার নিউইয়র্কে তাঁর হোটেল স্যুটে একত্র হন বিশ্বের বিভিন্ন প্রভাবশালী নেতা। তাঁরা বাংলাদেশকে এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সহযোগিতা ও পরামর্শ দেওয়ার অঙ্গীকার করেন”।
চমকিত হলাম। স্রেফ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সমর্থন জানাতে এই বিশ্বনেতারা একত্রিত হয়েছেন। অন্য কোন উদ্দেশ্য নাই তাদের। তারা একত্রিত হয়েছেন সেখানে যেখানে মুহাম্মদ ইউনূস আমেরিকায় যে হোটেলে উঠেছেন।
চমকের আরও বাকি আছে। প্রতিবেদনে লেখা—“বিভিন্ন নেতা অন্তর্বর্তী সরকারকে দেশ পুনর্গঠন ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দেন। তাঁদের একজন বলেন, ‘আমরা আপনার সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত। যেকোনো পরামর্শ বা সহায়তা প্রয়োজন হলে জানাবেন'”।
‘তাদের একজন বলেন’ বলে যে কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ—এটা দেখে চোখে জল এসে পড়ার মতো অবস্থা।
এবার দেখি, কারা এই বিশ্বনেতা? বাসস সূত্রে প্রথম আলো যে নামগুলো লিখেছে, তাতে দেখা যায়—এই বিশ্বনেতারা বিশ্বের অপরিচিত কিছু দেশের ‘সাবেক’ সরকার অথবা রাষ্ট্রপ্রধান এবং অগুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রতিষ্ঠানের সাবেক ও বর্তমান।
‘সর্বসাবেক’ এই নামগুলো তাহলে পড়ি এবার—“লাটভিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ও নিজামি গঞ্জাভি আন্তর্জাতিক কেন্দ্রের (এনজিআইসি) সহসভাপতি ভাইরা ভিকে-ফ্রেইবারগা, লাটভিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট এগিলস লেভিটস, স্লোভেনিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট বরুত পাহোর, সার্বিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট বোরিস তাদিচ, ইউরোপীয় কাউন্সিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বেলজিয়ামের সাবেক প্রধানমন্ত্রী চার্লস মিশেল, গ্রিসের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জর্জ পাপান্দ্রেউ, বুলগেরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট রোসেন প্লেভনেলিভ ও পেতার স্তোইয়ানোভ, ক্রোয়েশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ইভো যোসিপোভিচ, বসনিয়া-হার্জেগোভিনার সাবেক প্রেসিডেন্ট ম্লাদেন ইভানিচ এবং মরিশাসের সাবেক প্রেসিডেন্ট আমিনা গুরিব-ফাকিম। বৈঠকে কমনওয়েলথের সাবেক মহাসচিব, জর্জিয়ার সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের চারজন সাবেক সভাপতি, একাধিক সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বিশ্বব্যাংকের সাবেক সহসভাপতি ও এনজিআইসির সহসভাপতি ইসমাইল সেরাগেলদিন, মানবাধিকার সংগঠন রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটসের প্রেসিডেন্ট কেরি কেনেডি, আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) এবং জর্জটাউন ইনস্টিটিউট ফর উইমেন, পিস অ্যান্ড সিকিউরিটির ঊর্ধ্বতন প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন”।
সংবাদের শিরোনামে ‘বিশ্বনেতাদের পূর্ণ সমর্থন’ দেখে যেভাবে আবেগ উথলে ওঠেছিল, নামগুলো দেখে সেই আবেগ চাঙে ওঠে গেলো।
আচ্ছা, জনগণের ট্যাক্সের বিপুল অর্থব্যয়ে এই দাওয়াতি প্রোগ্রামে এই বিশ্বনেতাদের সমর্থন পেয়ে মুহাম্মদ ইউনূস সাহেব ও বাংলাদেশের কী লাভ হলো? তাদের সমর্থনের কোন কি মূল্য আছে? এই সর্বসাবেকেরা যদি সমর্থন না জানাতো, তাহলে কি বাংলাদেশের অশেষ ক্ষতি হয়ে যেতো?
লাটভিয়া-স্লোভেনিয়াসহ এই দেশগুলো বর্তমান সরকারপ্রধান হলে না হয় কিছুটা গুরুত্ব দেওয়া যেতো (যদিও এগুলো গুরুত্ব পাওয়ার মতো অবস্থায় নেই), কিন্তু এই সাবেকদের ‘পূর্ণ সমর্থনে’ কী যায় আসে?
হাস্যকর; পুরো বিষয়টা হাস্যকর হয়ে যাচ্ছে, হাস্যকর হয়ে গেছে।
এই উথলানো আবেগ দিয়ে, হাছা-মিছা মিশিয়ে, অগুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে লাফালাফির কী মানে? ন্যূনতম মান কিংবা ব্যক্তিত্ব প্রতিবেদনে বজায় রাখা উচিত; তাই না!
সর্বসাবেকের এই মাহফিলে ‘প্রভাবশালী বিশ্বনেতা’ হিসেবে যাদের পরিচয় দেওয়া হয়েছে, তারা কোথাকার প্রভাবশালী?
দোকান থেকে ট্রফি কিনে এনে শো-কেসে থরে থরে সাজিয়ে রাখা যায়, কিন্তু অর্জনের আনন্দ থাকে না। ‘বিশ্বনেতাদের পূর্ণ সমর্থন’ শিরোনাম দিয়ে ‘সর্বসাবেক’ অখ্যাতদের বিখ্যাত বানিয়ে ‘জাতে ওঠা’ যায়?
যায় না তো, স্যার!
আনন্দ পাচ্ছেন? আপনাদের অবস্থা জানি না, কিন্তু আমার হাসি পাচ্ছে; হাসতে-হাসতে পড়ে যাওয়ার মতো হাসি!
‘জাতে ওঠা’ এতো সোজা না! জাতে উঠতে কাজ করা লাগে, যোগ্যতা লাগে কিন্তু!