উত্তরার এক নিরীহ লাইব্রেরি গত রাতে ভাঙচুরের শিকার হয়েছে। অভিযোগ করা হয়েছে, “আওয়ামী লীগের দোসররা এখানে আড্ডা দেয়।” কিন্তু প্রমাণ কোথায়? কোনো প্রমাণ নেই। ছিল শুধু একটি ক্রিকেট ক্লাবের উদ্যোগে চালিত উন্মুক্ত লাইব্রেরি, যেখানে ছাত্ররা বই পড়ত, যুবকরা আলোচনা করত, সম্প্রদায় একসাথে সময় কাটাত। এমন এক স্থানকে লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে কেবল একটি রাজনৈতিক লেবেল দিয়ে। এটা কোনো রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নয়, এটা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সুসংগঠিত আক্রমণ।
গত জুলাইয়ে যারা রাস্তায় নেমে আগুন লাগিয়েছিল, পুলিশ স্টেশন পুড়িয়েছিল, নির্বাচিত সরকার উড়িয়ে দিয়েছিল — সেই একই মুখগুলো এখন লাইব্রেরি ভাঙছে। আর কেন? কারণ ওদের কাছে বই মানে “দোসরত্ব”, গান মানে “অবৈধ আনন্দ”, কবিতা মানে “বিপ্লবের বিরোধিতা”।
একবার ভাবুন, গত কয়েক মাসে কোথাও কি দেখেছেন কোনো বাউলের গান হচ্ছে? কোথাও কি কবিতা আবৃত্তি হচ্ছে? কোথাও কি মঞ্চ নাটক হচ্ছে? না। কারণ এই জুলাইয়ের দাঙ্গাবাজরা সব বন্ধ করে দিয়েছে। লাইব্রেরি বন্ধ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বন্ধ, শিল্পীরা মুখ বুজে আছে। কেন? কারণ ওরা জানে — একটা গান, একটা কবিতা, একটা বই পড়া মানুষ ওদের ক্ষমতার জন্য বড় বিপদ।
ওদের মানসিকতা পাকিস্তানি জেহাদি আর তালেবানের থেকে এক চুলও আলাদা না। তালেবান যেমন বই পুড়ায়, মাদ্রাসা ছাড়া শিক্ষা নিষিদ্ধ করে – ঠিক তেমনি এরা লাইব্রেরি ভাঙে, সংগীত নিষিদ্ধ করে, মানুষের মনকে কারাগারে ঢুকায়। শুধু নাম আলাদা—“বৈষম্যবিরোধী”। আসলে ওরা বৈষম্য নয়, বর্বরতার পক্ষে।
ওরা ভালোবাসে না গান, ভালোবাসে না কবিতা, ভালোবাসে না মানুষের হাসি। ওরা ভালোবাসে শুধু ভাঙচুর, লুট, আর ভয়। আর সেই ভয়ের উপর ওরা গড়ে তুলতে চায় নতুন “বিপ্লব”, যেখানে মানুষ শুধু ওদের কথা শুনবে, আর কিছু না।
কিন্তু একটা কথা ওদের মাথায় ঢুকাতে হবে : বাংলা সংস্কৃতি এত সহজে মরে না। লাইব্রেরি ভাঙলেও বইয়ের কথা মরে না। গান বন্ধ করলেও সুর মরে না। আর যে মানুষ লালন-রবীন্দ্র-জসীমউদদীনের মাটিতে জন্মেছে, সে কখনো এই বর্বরতা মেনে নেবে না – সে মুখ খুলবে, গান গাইবে, বই লিখবে, বারবার লাইব্রেরি বানাবে।
উত্তরার লাইব্রেরি ভাঙচুর শুধু একটি ঘটনা নয়। এটি এমন একটি ইন্ডিকেটর যা বলছে, আজ যে কোনো স্থানে মানুষ যদি বই পড়ে, গান গায়, কথা বলে, তাহলে সেখানে হামলা হতে পারে। কারণ এই নতুন শক্তির কাছে স্বাধীন চিন্তা হলো সবচেয়ে বড় অপরাধ।
বাংলা সংস্কৃতি কখনো “দোসর” হতে পারে না। লালনের গান, রবীন্দ্রনাথের কবিতা, জসীমউদদীনের মাঠ — এগুলো কোনো রাজনৈতিক পক্ষের সম্পত্তি নয়। এগুলো আমাদের সবার। আর যে কেউ এগুলোকে লক্ষ্য করে হামলা চালাবে, সে শুধু একটি লাইব্রেরি নয় – বাংলার আত্মাকেই আক্রমণ করবে।
এই ধ্বংসযজ্ঞ থামাতে হবে। না হলে আগামী প্রজন্ম জিজ্ঞাসা করবে — “বই কী ছিল?” “গান কেন নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল?” “আমাদের দেশে কি কখনো মানুষ মুক্তভাবে কথা বলতে পারত?”
সেই প্রশ্নের জবাব আমরা আজ থেকেই লিখতে শুরু করি — সংস্কৃতির পক্ষে, মানবতার পক্ষে, বাংলার পক্ষে।