ইউনূস সরকারের শাসনামলের শুরু থেকেই রাজনৈতিক অস্থিরতা, লাগামহীন মূল্যস্ফীতি ও উচ্চ সুদের চাপে বাংলাদেশের অর্থনীতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মারাত্মক ধাক্কা খেয়েছে। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ ‘বাংলাদেশ উন্নয়ন হালনাগাদ’ প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে মাত্র ৪ শতাংশে, যা গত এক দশকের মধ্যে অন্যতম নি¤œস্তর।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এই ধীরগতির অর্থনীতি শুধু প্রবৃদ্ধিই নয়, কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ এবং ভবিষ্যৎ উন্নয়ন সম্ভাবনাকেও গুরুতরভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কার্যত স্থবির হয়ে পড়ে। এই সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসে, এবং মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি ব্যাপকভাবে কমে যায়, যা নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগ অনীহার ইঙ্গিত দেয়।
উচ্চ সুদের হার, ব্যয়বহুল কাঁচামাল, অনিশ্চিত মুদ্রানীতি এবং সরকারের অনড় মনোভাব ব্যবসায়ীদের ঝুঁকি নিতে নিরুৎসাহ করেছে। এর ফলে বিনিয়োগ স্থবিরতা সরাসরি প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
শিল্প ও নির্মাণ খাতে প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার পাশাপাশি সেবা খাতে মন্দাভাব সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে বাণিজ্য, পরিবহন ও আবাসন খাতে কর্মসংস্থান হ্রাস পেয়েছে। ২০২৫ সালে শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার ২ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৫৮.৯ শতাংশে, যেখানে নারীদের অংশগ্রহণ হ্রাস বেশ উদ্বেগজনক। ফলে মোট কর্মসংস্থান অনুপাত কমে ৫৬.৭ শতাংশে, এবং বেকারত্বের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩.৭ শতাংশে।
ইউনূস সরকারের সময়েই ব্যাংক খাতের দুর্বলতা প্রকটভাবে প্রকাশ পেয়েছে। আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী হিসাব করলে ২০২৫ সালের মার্চ নাগাদ খেলাপি ঋণের হার ২৪.১ শতাংশে পৌঁছেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার গড়ের তিন গুণেরও বেশি।
একই সময়ে মূলধনঝুঁকি অনুপাত নেমে এসেছে ৬.৩ শতাংশে, যা ন্যূনতম নিয়ন্ত্রক মান (১০%) থেকে অনেক নিচে। যদিও সরকার ব্যাংক খাত সংস্কারে ‘ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ’ প্রণয়ন করেছে, বিশেষজ্ঞরা এটিকে দেরিতে নেওয়া প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখছেন।
ইউনূস সরকারের সময় কর আদায়ের হার জিডিপির অনুপাতে ৬.৮ শতাংশে নেমে এসেছে, যেখানে আগে তা ৭.৪ শতাংশ ছিল। অন্যদিকে ভর্তুকি ও সুদের ব্যয় বেড়ে মোট ব্যয় দাঁড়িয়েছে জিডিপির ৯.২ শতাংশে।
উন্নয়ন ব্যয় কমে ৩.৩ শতাংশে দাঁড়ানো এবং বাজেট ঘাটতি বেড়ে ৪.৭ শতাংশ হওয়ায় সরকারের আর্থিক ভারসাম্য মারাত্মকভাবে বিঘিœত হয়েছে। সরকারি ঋণের বড় একটি অংশ বর্তমানে দেশীয় ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নেওয়া, যা প্রায় ৩৭ শতাংশ।
এছাড়া আমদানিতে বড় বৈষম্য রয়ে গেছে খাদ্য ও মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি বাড়লেও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে, যা ভবিষ্যৎ উৎপাদন ও বিনিয়োগের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়।
বিশ্বব্যাংক ২০২৬ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৪.৮ শতাংশে পৌঁছাতে পারে বলে পূর্বাভাস দিলেও তা নির্ভর করছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও কার্যকর সংস্কারের ওপর। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, জ্বালানি সরবরাহের ঘাটতি, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা, এবং নীতিগত অনিশ্চয়তা আগামী বছরও বড় বাধা হয়ে থাকবে। তখন দেশের অর্থনীতি আরো খারাপ হবে।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ও ভুটানের বিভাগীয় পরিচালক জ্যাঁ পেসমে বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থিতিস্থাপকতা দেখিয়েছে, কিন্তু সেটিকে স্বাভাবিক ধরে নেওয়া যাবে না। প্রবৃদ্ধি টিকিয়ে রাখতে হলে কর আদায় বৃদ্ধি, ব্যাংক খাত সংস্কার, জ্বালানি খাতে ভর্তুকি হ্রাস এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলার সংস্কার জরুরি। কিন্তু বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
ইউনূস সরকারের সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্বল অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং বিলম্বিত সংস্কার দেশের অর্থনীতিকে এক দশকের অন্যতম চ্যালেঞ্জিং সময়ে ঠেলে দিয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া, ব্যাংক খাতে অনিয়ম, শ্রমবাজারে সংকোচন এবং বিনিয়োগ স্থবিরতা অর্থনীতিকে বিপজ্জনক অবস্থায় ফেলেছে যার দায় এড়ানোর সুযোগ এই সরকারের নেই বলে মন্তব্য তাদের।