নেকটাই, ভেস্ট, ঢিলেঢালা প্যান্ট আর ফেডোরা টুপি সাধারণত একজন শক্তসমর্থ পুরুষের কথাই ভাবায়। যে অভিনেত্রী ৭০-এর দশকে মেয়েদের জন্য এ পোশাক জনপ্রিয় করেছিলেন, তিনি ডায়ান কিটন। কিংবদন্তী এই অভিনয় শিল্পী ও ফ্যাশন আইকনের জীবনাবসান হয়েছে; তার বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর।
কিটনের মৃত্যুর খবর জানিয়েছেন তার সাম্প্রতিক কয়েকটি সিনেমার প্রযোজক ডরি রাথ। তবে কবে বা কোথায় কিটন মারা গেছেন, বা মৃত্যুর কারণ তিনি জানাননি।
১৯৭৭ সালে উডি অ্যালেনের সিনেমা ‘অ্যানি হল’-এ অভিনয়ের মধ্য দিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোচনায় আসেন ডায়ান কিটন। নিউ ইয়র্কের এক তরুণীর চরিত্রে প্রাণবন্ত অভিনয় তাকে এনে দেয় সেরা অভিনেত্রীর অস্কার। সিনেমাটি আরও তিনটি অস্কার জেতে, যার মধ্যে ছিল সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কারও।
উডি অ্যালেনের আরও সাতটি সিনেমায় অভিনয় করেছেন কিটন। এর মধ্যে রয়েছে ১৯৭৭ সালের ‘ম্যানহাটন’, যেটিকে অ্যালেনের অন্যতম সেরা কাজ বলে বিবেচনা করা হয়।
তবে নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে, ‘ম্যানহাটন’ এর দুই বছর আগের ‘অ্যানি হল’ কেবল কিটনের ক্যারিয়ার নয়, হলিউডের রোমান্টিক কমেডি ধারাকেও নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছিল।
পোশাকে নতুন ধারা, আলাপে স্বতঃস্ফূর্ততা আর তার সঙ্গে অদ্ভুত রসবোধে কিটন হয়ে উঠেছিলেন এক অনন্য শিল্পী। যে রসিকতায় তিনি নিজেই অনেক সময় হয়ে উঠতেন হাস্যরসের উপাদান।
১৯৪৬ সালের ৫ জানুয়ারি লস অ্যাঞ্জেলেসে ডায়ান কিটনের জন্ম। বাবা ছিলেন একজন প্রকৌশলী, মা গৃহিণী ও শৌখিন আলোকচিত্রী। কৈশোরে থিয়েটারের প্রতি আগ্রহ থেকেই অভিনয়ের স্কুলে ভর্তি হন কিটন, পরে নিউ ইয়র্কে চলে যান অভিনয় শেখার জন্য।
ব্রডওয়েতে ‘হিয়ার’ মিউজিক্যালে অভিনয় দিয়ে ক্যারিয়ারের শুরু। এরপর উডি অ্যালেনের সঙ্গে ‘প্লে ইট অ্যাগেইন, স্যাম’ নাটকে কাজ করেন, যা তাকে এনে দেয় ‘মঞ্চ নাটকের অস্কার’ খ্যাত টোনি অ্যাওয়ার্ডের মনোনয়ন।
চলচ্চিত্রে তার অভিষেক ঘটে ১৯৭০ সালে ‘লাভারস অ্যান্ড আদার স্ট্রেঞ্জার্স’ সিনেমায়। তবে তার বড় সাফল্য আসে ১৯৭২ সালে ‘দ্য গডফাদার’ সিনেমায় মাইকেলের বান্ধবী ও পরে স্ত্রী কে অ্যাডামস চরিত্রে অভিনয় করে। ‘দ্য গডফাদার: পার্ট টু’ ও ‘পার্ট থ্রি’তেও একই চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি।
দীর্ঘ অভিনয়জীবনে কিটন প্রায় একশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন প্রজেক্টে কাজ করেছেন। কখনো ‘স্লিপার’ বা ‘দ্য ফার্স্ট ওয়াইভস ক্লাব’-এর মত হালকা মেজাজের কমেডিতে, আবার কখনো ‘মারভিন’স রুম’ বা ‘রেডস’-এর মত গভীর নাট্যধর্মী সিনেমায়।
‘রেডস’ (১৯৮১), ‘মারভিন’স রুম’ (১৯৯৬) ও ‘সামথিং’স গটা গিভ’ (২০০৩)-এর জন্যও তিনি আরও তিনবার অস্কার মনোনয়ন পেয়েছিলেন।
পাশাপাশি তিনি ২০১৭ সালে অর্জন করেন আমেরিকান ফিল্ম ইনন্টিটিউটের লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড। আর ১৯৭৭ সালেই অ্যানি হল-এর জন্য জেতেন বাফটা অ্যাওয়ার্ড ও গোল্ডেন গ্লোব। ২০০৩ সালে ফের তার হাতে গোল্ডেন গ্লোব ওঠে ‘সামথিংস গটা গিভ’ সিনেমার জন্য।
পরিচালক হিসেবেও কাজ করেছেন কিটন। তার পরিচালিত তথ্যচিত্র ‘হেভেন’ (১৯৮৭) ছিল মৃত্যুর পরজগত নিয়ে এক অনুসন্ধানী কাজ। ১৯৯৫ সালে ‘আনস্ট্রাং হিরোস’ চলচ্চিত্রটি কানের চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয় এবং প্রশংসা পায়।
ব্যক্তিজীবনে ডায়ান কিটন কখনো বিয়ে করেননি। তার দত্তক নেওয়া এক ছেলে ও এক মেয়ে আছে—ডিউক ও ডেক্সটার কিটন।
২০১৯ সালে পিপল ম্যাগাজিনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “বয়স বাড়লেও আমি তেমন বুদ্ধিমান হইনি। এখনো জানি না কিছুই।”
এই ‘না জানা’ মানুষটিই প্রাণবন্ত অভিনয়ের পাশাপাশি নতুন সংজ্ঞা দিয়েছেন ফ্যাশনের। এ নিয়ে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলছে, ‘অ্যানি হল’-এর পোশাকগুলোর কিছু কিটনের নিজের সংগ্রহ থেকে নেওয়া হয়েছিল। ছবির পোশাক নকশা করেছিলেন রুথ মর্লে, কিন্তু কিটনের নিজের টম বয় ধাঁচের ফ্যাশন সেন্সই চরিত্রটিকে আলাদা করে তুলেছিল।
সিনেমাটি মুক্তির পর নারীদের মধ্যে পুরুষদের পোশাক, বিশেষ করে প্যান্টসুট জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পরবর্তী বছরগুলোতেও কিটন প্রায়ই পুরুষদের পুরোনো নকশার পোশাক পরতে দেখা যেত।
স্যান ফ্রান্সিসকো ক্রনিকল-এর ২০০৫ সালের এক প্রতিবেদন তাকে নিয়ে লিখেছিল, “তাকে খুঁজে পাওয়া সহজ। শুধু দেখুন, আশেপাশে টার্টলনেক পরা একমাত্র নারীটি কে।”
জীবনের শেষ পর্যন্ত লিখে গেছেন কিটন। ফ্যাশন, শিল্প, স্থাপত্য আর স্মৃতিকথা নিয়ে রয়েছে এক ডজনের বেশি বই। তার আত্মজীবনী ‘দেন এগেইন’ (২০১৪)-এ বলেছেন, “ভালোবাসা নিয়ে আমি শুধু এতটাই বলতে পারি—এটা আসে, যায়, আর আমরা কৃতজ্ঞ থাকি।”