নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের ক্ষমতারোহনের পর থেকে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর নিপীড়ন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন ও পরিবারের বিবরণ অনুসারে, এ পর্যন্ত অন্তত ৩০ জন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী রাষ্ট্রীয় হেফাজতে মৃত্যুবরণ করেছেন। যার অনেকেই গ্রেপ্তারের সময় সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলেন, কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদ ও আটক অবস্থায় নির্যাতনের ফলে তাদের মৃত্যু ঘটে।
সাম্প্রতিক সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা সাবেক মন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুনের মৃত্যু। তিনি আটক অবস্থায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হন, কিন্তু পরিবারের অনুরোধ সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ তাকে সময়মতো হাসপাতালে স্থানান্তর করেনি। চিকিৎসা বিলম্বিত হওয়ার কারণে তিনি মারা যান। পরিবার অভিযোগ করছে, এটি কোনো দুর্ঘটনা নয়, বরং পরিকল্পিত অবহেলা ও প্রতিহিংসার ফল।
রাষ্ট্রিয় হেফাজতে মৃত্যুর সবচেয়ে ভয়াবহ চিত্র দেখা যাচ্ছে বগুড়ায়। সেখানে জেলা কারাগারেই একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা রহস্যজনকভাবে মারা গেছেন। শহিদুল ইসলাম রতন, প্রিন্সিপাল শহীদাত আলম ঝুনু, আব্দুল মতিন মিঠু এবং এমদাদুল হক ভুট্টো—এই চারজন নেতার মৃত্যু নিয়ে এলাকায় তীব্র ক্ষোভ ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, তাদের গ্রেপ্তারের পর নির্যাতন করা হয়েছিল এবং অসুস্থ হওয়ার পরও যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হয়নি।
পরিবারগুলোর অভিযোগ, কর্তৃপক্ষ মৃত্যুর প্রকৃত কারণ গোপন রাখার চেষ্টা করছে এবং মরদেহ হস্তান্তরেও দেরি করা হয়েছে।
বগুড়ার ঘটনাগুলো শুধু স্থানীয় নয়, বরং সারা দেশের জন্য এক সতর্কবার্তা। একই ধরনের মৃত্যু ঘটেছে গোপালগঞ্জ, গাইবান্ধা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, নীলফামারী, খুলনা, ঢাকা, নওগাঁ, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও সাভারে। এলাহী সিকদার, শফিকুল ইসলাম, সোহরাব হোসেন আপেল, আলিমুজ্জামান চৌধুরী, আব্দুল লতিফ, হযরত আলী, আতাউর রহমান আঙ্গুর, নিত্য সরকার, শেখ জহিরুল ইসলাম, মোমিনুর ইসলাম, আখতার সিকদার, আবদুর রাজ্জাক, সিদ্দিক হোসেন মোল্লা, জাহিদুল ইসলাম শিপু, সুজিত চন্দ্র দেব, রিয়াজুল ইসলাম রাইজুল, ফরজাদ হোসেন সাজিব, ইমাম হোসেন বাচ্চু, মো. আজগর আলী ও সাইদুর রহমান সুজন, জয়নাল আবেদীন জনি—সবাই একই পরিণতির শিকার হয়েছেন।
এই ধারাবাহিক মৃত্যুগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানের ভেতরে সৃষ্ট এক উদ্বেগজনক সংস্কৃতির প্রতিফলন। যেসব জায়গা আইনের শাসন ও নিরাপত্তার প্রতীক হওয়ার কথা—সেই কারাগার ও পুলিশ হেফাজত এখন মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে।
গ্রেপ্তারের পর পরিবারগুলোকে প্রায়ই জানানো হয়নি তাদের প্রিয়জন কোথায়, কী অবস্থায় আছেন। অসুস্থতার খবর পেলে চিকিৎসার অনুরোধ করা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা উপেক্ষিত হয়েছে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, এসব মৃত্যু বাংলাদেশের সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের, বিশেষ করে জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কনভেনশনের, সরাসরি লঙ্ঘন। রাষ্ট্রের ওপর দায়িত্ব রয়েছে প্রত্যেক বন্দির জীবন, স্বাস্থ্য ও বিচার পাওয়ার অধিকার রক্ষা করার, কিন্তু বাস্তবে সেই দায়িত্ব উপেক্ষিত হচ্ছে।
এই ঘটনার ভয়াবহতা বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্ধকার অধ্যায়গুলোর স্মৃতি ফিরিয়ে দিচ্ছে—খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড কিংবা ১৯৭৫ সালের জেলহত্যার মতো ঘটনা যেন নতুন প্রজন্মে আবার পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর এখন নৈতিক ও আইনগত চাপ ক্রমেই বাড়ছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহল এক কণ্ঠে দাবি জানাচ্ছে—রাষ্ট্রিয় হেফাজতে মৃত্যুর প্রতিটি ঘটনার পূর্ণ, স্বচ্ছ ও স্বাধীন তদন্ত করতে হবে এবং যারা দায়ী, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে।
এগুলো শুধু রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ঘটনা নয়, বরং রাষ্ট্রের নৈতিকতার পরীক্ষা। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা না হলে এই মৃত্যুদের তালিকা শুধু লম্বা হবে, আর বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ আরও অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে।