বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে পড়েছে। রপ্তানি আয় হ্রাস পাচ্ছে, মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে চলেছে, আর বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কার্যত স্থবির হয়ে আছে। এক সময়ের তুলনামূলক স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এখন নানা অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক চাপে দমবন্ধ হয়ে পড়েছে।
রপ্তানি খাতে টানা পতন
টানা দুই মাস ধরে রপ্তানি খাতে পতন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একসময় দেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি হিসেবে বিবেচিত রপ্তানি খাত এখন নানামুখী সংকটে ভুগছে। প্রধান বাজারগুলোতে চাহিদা কমে যাওয়া, বৈদেশিক মুদ্রার অস্থিরতা এবং উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে রপ্তানিকারকরা নতুন অর্ডার পেতে হিমশিম খাচ্ছেন।
একই সঙ্গে সরকার পরিবর্তনের পর কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকা মুদ্রাস্ফীতি আবারও ঊর্ধ্বমুখী ধারা নিয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে, বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে, আর জীবনযাত্রার ব্যয় দিন দিন বেড়েই চলেছে।
রাজনৈতিক ও আর্থিক অনিশ্চয়তা
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, ঋণপ্রাপ্তিতে সীমাবদ্ধতা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর নীতি—এসব মিলেই অর্থনীতিকে নিম্নমুখী পথে ঠেলে দিয়েছে। ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট ও সুদের হারের ঊর্ধ্বগতি ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত করছে।
উচ্চ সুদের হার, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং জ্বালানি সংকট সব মিলিয়ে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি এখন এক অনিশ্চিত ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। শিল্প খাতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ঘাটতি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের অবস্থানকে দুর্বল করে দিচ্ছে।
বিনিয়োগে স্থবিরতা
দেশের গুরুত্বপূর্ণ শিল্প খাতগুলোর একাধিক প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যেই উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে, নতুন বিনিয়োগ কার্যত স্থবির হয়ে আছে। উদ্যোক্তারা নতুন প্রকল্প হাতে নিতে দ্বিধাগ্রস্ত, কারণ তারা ভবিষ্যৎ বাজার পরিস্থিতি ও নীতিগত ধারাবাহিকতা সম্পর্কে নিশ্চিত নন। ফলে শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির যে গতি একসময় দেখা গিয়েছিল, তা এখন প্রায় থমকে গেছে।
বৈদেশিক আয়ে ধস ও রাজস্ব ঘাটতি
অতিরিক্তভাবে, আন্তর্জাতিক ঋণমানের অবনতি, রাজস্ব ঘাটতি এবং প্রবাসী আয়ের দুর্বল প্রবাহ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। প্রবাসী আয়ের নিম্নগতি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ সৃষ্টি করছে, যা সরকারের উন্নয়ন ব্যয় ও আমদানি সক্ষমতাকে সীমিত করে দিচ্ছে।
ফলে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোয় অর্থঘাটতি দেখা দিচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রেই সরকার ব্যয় সংকোচন নীতি নিতে বাধ্য হচ্ছে।
পথ খুঁজছে অর্থনীতি
বিশ্লেষকদের মতে, একটি নির্বাচিত ও স্থিতিশীল সরকারের অধীনে রাজনৈতিক শান্তি ও আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারলে অর্থনৈতিক গতি পুনরুদ্ধারের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। বিনিয়োগবান্ধব নীতি, আর্থিক শৃঙ্খলা এবং উৎপাদনমুখী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমেই অর্থনীতিকে পুনরায় ঘুরে দাঁড়ানোর পথে আনা সম্ভব।
বাংলাদেশের অর্থনীতি একসময় দৃঢ় প্রবৃদ্ধির উদাহরণ হিসেবে আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসিত হয়েছিল। এখন সেই অর্থনীতির স্থিতি পুনরুদ্ধারে প্রয়োজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নীতি, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং কার্যকর প্রশাসনিক সমন্বয়। অন্যথায়, “অর্থনীতির গতি থেমে যাচ্ছে” শুধু একটি শিরোনাম নয়—তা হতে পারে এক গভীর বাস্তবতার প্রতিফলন।