ঢাকা, ১৫ অক্টোবর ২০২৫: জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশন থেকে বাংলাদেশ পুলিশের একমাত্র অবশিষ্ট ইউনিটকে ফেরত আনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গো (ডিআরসি)-তে মোতায়েন ১৮০ সদস্যের এই ইউনিটটি, যার মধ্যে ৭০ জন মহিলা কর্মকর্তা রয়েছেন, এখন সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহার হবে।
এটি বাংলাদেশের তিন দশকের শান্তিরক্ষী অবদানের একটি বড় ধাক্কা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, যা মূলত জাতিসংঘের চলমান অর্থ সংকটের কারণে ঘটছে।
জাতিসংঘের অভ্যন্তরীণ নথি অনুসারে, এই প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে মনুসকো (মোতায়েন ইউএন স্টেবিলাইজেশন মিশন ইন ডিআর কঙ্গো)-এর অধীনে। নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশ পুলিশের এই ইউনিটটি বিশ্বের একমাত্র সম্পূর্ণ মহিলা পুলিশ ইউনিট ছিল, যা স্থানীয় নারী ও শিশুদের সুরক্ষা এবং লৈঙ্গিক সহিংসতা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিল। কিন্তু অর্থের অভাবে মিশনের স্কেল ডাউন করতে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যার সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
অন্যান্য দেশ যেমন ক্যামেরুন, সেনেগাল এবং মিশরের ইউনিটগুলোতে শুধু আংশিক কমানো হবে।
বাংলাদেশ পুলিশের এক কর্মকর্তা, যিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলেছেন, বলেছেন, “এই ইউনিটটি তিন দশক ধরে দেশের গর্বের প্রতীক ছিল। সরকারের অপর্যাপ্ত পদক্ষেপের কারণে এটি শেষ হয়ে যাচ্ছে, এটি একটি গুরুতর আঘাত।”
একজন সিনিয়র মহিলা অফিসার যোগ করেছেন, “আমরা জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করতে পারিনি, কারণ আমাদের প্রস্তুতি ছিল না। এখন পুলিশ সম্পূর্ণভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে।”
বাংলাদেশ ১৯৮৯ সাল থেকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে অংশগ্রহণ করছে এবং ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বড় অবদানকারী দেশগুলোর একটি ছিল। মোট ২১,৪৪৪ পুলিশ সদস্য ২৩টি মিশনে অংশ নিয়েছেন, যার মধ্যে ২২ জন শহীদ হয়েছেন। বিশেষ করে মহিলা শান্তিরক্ষীদের অবদান উল্লেখযোগ্য—২০২৫ সালে ১,৭০০-এর বেশি নারী সদস্য মিশনে ছিলেন, যা জাতিসংঘের লৈঙ্গিক অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।
এই ইউনিটটি কিনশাসায় মনুসকো-তে স্থানীয় পুলিশকে প্রশিক্ষণ দিয়ে এবং সম্প্রদায়ভিত্তিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে নিজেদের ভালোবাসা অর্জন করেছিল।
জাতিসংঘের সূত্র জানিয়েছে যে, এই প্রত্যাহারের পিছনে মূলত অর্থ সংকট দায়ী। বিশ্বব্যাপী শান্তিরক্ষী মিশনগুলোর জন্য অর্থায়ন কমে যাওয়ায় অনেক দেশের ইউনিট স্কেল ডাউন করছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পুলিশের শান্তিরক্ষী অংশগ্রহণের অধ্যায় প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। তবে সেনাবাহিনীর ইউনিটগুলো এখনও মিশনে রয়েছে, যা দেশের সামগ্রিক অবদানকে ধরে রেখেছে।
এই সিদ্ধান্ত নিয়ে পুলিশের অভ্যন্তরে হতাশা দেখা দিয়েছে। একজন অবসরপ্রাপ্ত অফিসার বলেছেন, “এটি শুধু অর্থের সমস্যা নয়, সরকারের অগ্রাধিকারের প্রশ্নও। আমরা বিশ্ব শান্তিতে অবদান রাখতে গর্বিত ছিলাম, কিন্তু এখন সেই সুযোগ হারিয়ে যাচ্ছে।”
জাতিসংঘের উপ-সচিব জাঁ-পিয়ের লাক্রোয়া ২০২৩ সালে বাংলাদেশ সফরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে সতর্কতা দিয়েছিলেন, যা এখন অর্থ সংকটের সাথে মিলে এই পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
বাংলাদেশ পুলিশের শান্তিরক্ষী অংশগ্রহণ থেকে দেশ বছরে লক্ষ লক্ষ ডলার আয় করে, যা কর্মীদের প্রশিক্ষণ এবং উন্নয়নে ব্যয় হয়। এখন এই ইউনিটের ফেরতের ফলে সেই আয় কমবে এবং মহিলা কর্মকর্তাদের জন্য নতুন সুযোগ সীমিত হয়ে পড়বে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে জাতিসংঘের সাথে আলোচনা করে এই সংকট মোকাবিলা করতে হবে, নইলে বাংলাদেশের বিশ্ব শান্তিরক্ষায় অবদানের ঐতিহ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বিভাগ জানিয়েছে যে, প্রত্যাহার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে এবং আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সকল সদস্য দেশে ফিরে আসবেন। এই ঘটনা বাংলাদেশের কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ বাড়িয়ে তুলেছে, যেখানে দেশকে তার শান্তিরক্ষী ভূমিকা পুনরুদ্ধারের জন্য নতুন কৌশল গ্রহণ করতে হবে।