কবির য়াহমদ
চব্বিশের জুলাইয়ের নামে পঁচিশে এসে সনদ স্বাক্ষর করতে যাচ্ছে কয়েকটি রাজনৈতিক দল। বিদেশ থেকে আসা লোকদের নিয়ে কমিশন গঠন হয়েছে। কমিশন আট মাস ধরে একের পর এক বৈঠক করে শেষ পর্যায়ে এসে পড়েছে।
শুক্রবার ‘জুলাই ২০২৫ সনদ’ স্বাক্ষর করবে কিছু রাজনৈতিক দল। রাজনৈতিক দল বলতে দেশে রয়েছে শতাধিক ব্যানার। তবে আওয়ামী লীগ বাদে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল মাত্র ৫১। অর্থাৎ রাষ্ট্র এদেরকে রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে।
জুলাই সনদে যারা স্বাক্ষর করবে, তারা রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি। এখানে যত দল স্বাক্ষর করতে যাচ্ছে, তাদের সবাই স্বীকৃত রাজনৈতিক দল নয়, অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি নেই সবার। স্বীকৃতি পাওয়া রাজনৈতিক দল আছে ২১টি, যারা এই জুলাই সনদে সাক্ষর করতে যাচ্ছে। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়া ৩০টি রাজনৈতিক দল এই জুলাই সনদ সম্পর্কে অবহিত নয়। সংখ্যায় যা অর্ধেকের বেশি। ২১-এর সঙ্গে যদি হবু-স্বীকৃত রাজনৈতিক দল এনসিপিকে ধরি, তবে নিবন্ধিত দল হবে এখানে ২২।
জুলাই সনদ রচনা করেছে ঐকমত্য কমিশন নামের সরকারি একটা কমিটি। অথচ দেখুন দেশের বেশিরভাগ দলকে বাইরে রেখে ঐক্য রচনার কথা বলা হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে স্বীকৃত ৫১ দলের দেশে মাত্র ২১টি দলকে নিয়ে সরকার দেশের ১৭ কোটি মানুষের ম্যান্ডেট গ্রহণের অভিনয় করছে। নিবন্ধিত ৩০টি দল যেখানে সনদের আলোচনার বাইরে, সেখানে এই সনদের গ্রহণযোগ্যতা শুরুতেই কি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায় না?
এখন যত যাই ঐক্যের কথা বলা হোক না কেন, এটা মূলত বিভাজনের সরকারি আয়োজন। স্বাক্ষরিত হওয়ার পর বিভাজন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি লাভ করবে।
মুহাম্মদ ইউনূসের যে সরকার, এটাকে বলা হচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তাদের গৃহীত সবকিছুকে তাই অন্তর্বর্তীকালীন ভাবা সংগত। এই হিসেবে জুলাই সনদও অন্তর্বর্তীকালীন। দেশের অর্ধেকের বেশি রাজনৈতিক দলকে বাইরে রেখে যে সনদের আয়োজন, এর ভবিষ্যৎ তাই প্রশ্নের মুখে থাকবেই।
সরকার চাইলে পারত সর্বজনীন কিছু করতে, কিন্তু সেটা না করে এখানে বিভাজনের সুস্পষ্ট একটা রেখা আঁকা হয়েছে। এটা ভয়ানক হতে পারে।
জুলাই সনদ প্রক্রিয়ায় আলোচনার বাইরে থাকা অনেক দলই চাইছে এতে অংশ নিতে। এটা অনেকট ভয়ে এবং অনেকটা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে। তবে সরকার তাদের ডাকেনি।
বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘জুলাই সনদে স্বাক্ষর হলেও পরবর্তীতে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তাদেরই এর আইনি ভিত্তি দিতে হবে। এই জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি জাতীয় সংসদের ওপর নির্ভর করবে।’ তার বক্তব্যে বুঝাই যায় কৌশলগত কারণে তারা এই জুলাই সনদ প্রক্রিয়ায় রয়েছেন।
সবকিছু ঠিকঠাক মতো হলে বিএনপিরই ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ক্ষমতায় যাওয়ার পর এই জুলাই সনদকে কি তারা আমলে নেবে? হয়ত তারা কিছুটা মানবে, কিন্তু সবটা মানার বাধ্যবাধকতা থাকবে না তাদের। বাধ্যবাধকতা কেবলই নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোর, আর দলবিযুক্ত মানুষেরা কোন রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি প্রণয়ন করে দেবে আর রাজনৈতিক দল সেটা প্রতিপালন করবে—এমনটা ভাবার কারণ নাই।
জুলাই সনদের নামে যা রচিত হচ্ছে—এটা না আইন, না সংবিধান। এটা মাঝামাঝি প্রকৃতির এমন কিছু যা মেঘ গুড়গুড় মেঘ গুড়গুড়, কিন্তু ওখান থেকে যে বৃষ্টি নামবে, সেটা মাটিতে পড়তে না পড়তেই শুষে নেবে মাটি। ওটা না কাজে আসবে শস্যের, না প্রকৃতির, না মানুষের।
আমরা নাগরিক, সতত দর্শক; দর্শক হয়ে নানা বাকবদলের সাক্ষী হচ্ছি। আমরা সাক্ষী, কিন্তু সাক্ষ্য দিচ্ছি না; একদম না! জুলাই সনদের তাই কোন ভবিষ্যৎ দেখছি না।
এটা দিয়ে কী হবে? সংবিধান চলমান থাকা সত্ত্বেও সংবিধানকে অগ্রাহ্য করাকে যেখানে প্রশ্রয় দেওয়া হয়, সেখানে ‘জুলাই সনদ’ টিকে থাকবে—এটা ভাবতে পারছি না!