দীপু মাহমুদ
ঝিম ধরে বসে আছি। ঝিম ধরে বসে থাকা আমার অভ্যাস নয়। সব সময় নড়াচড়া করা আমার অভ্যাস। কলেজের ফার্স্ট ইয়ার পরীক্ষার পর খানিকটা অলস সময় কাটাচ্ছি। অলসতা কাটাতে বাইরে যাওয়ার শার্ট গায়ে দিয়ে বের হয়ে পড়লাম। বইয়ের দোকানে গিয়ে বই দেখছি। নতুন কী কী বই এসেছে, তার সন্ধান করছি। সেবা প্রকাশনীর নতুন বই এসেছে। ‘তিমির প্রেম’। লিখেছেন রকিব হাসান। কিনে নিয়ে বাড়িতে ফিরে এলাম। একটানা পড়ে গেছি ‘তিমির প্রেম’। পড়া শেষ করে হু হু করে কেঁদে ফেলেছি। চুপচাপ বসে আছি। কান্না থামানোর চেষ্টা করছি। কান্না থামাতে পারছি না। শব্দ না করে কেঁদে যাচ্ছি।
সমুদ্রতীরের ছোট উপকূলীয় এলাকায় হঠাৎ এক বিশাল তিমি ভেসে এসেছে। সমুদ্র আর নদীর মোহনার খাঁড়িতে আটকে গেছে তিমি। সে অন্তঃসত্ত্বা। তার গর্ভে সন্তান আছে। খাঁড়ির ভেতর থেকে বের হয়ে সেই বিশাল তিমি আর সমুদ্রে ফিরে যেতে পারছে না। খাঁড়ির বাইরে তার সঙ্গী তিমি অস্থির হয়ে গেছে। খাঁড়ির ভেতর তিমি দেখে গ্রামবাসী প্রথমে ভয় পেয়েছিল, পরে কৌতূহলী হয়ে উঠেছে। স্থানীয় একজন, যিনি প্রকৃতি আর প্রাণীদের ভালোবাসেন, তাদের প্রতি গভীর মমত্ব বোধ করেন, তিনি তিমিকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু গ্রামের অন্যরা সেই তিমিকে ‘অভিশাপ’ বা ‘অলৌকিক প্রাণী’ ভেবে ভয়ানকভাবে আঘাত করে যাচ্ছে। বাঁচার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে আটকে পড়া তিমি। মানুষ আর তিমির এই লড়াইয়ে ভেতর গড়ে উঠেছে এক নিঃশব্দ, করুণ সম্পর্ক—ভালোবাসা, সহমর্মিতা আর অপরাধবোধের মিশেল। শেষ পর্যন্ত তিমি মারা গেছে, কিন্তু মানুষের মনে থেকে গেছে হাহাকারের মতো শূন্যতা, গহিন অপরাধবোধ আর প্রকৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।
বইয়ের দোকানে গিয়ে বই দেখছি। নতুন কী কী বই এসেছে, তার সন্ধান করছি। সেবা প্রকাশনীর নতুন বই এসেছে। ‘তিমির প্রেম’। লিখেছেন রকিব হাসান। কিনে নিয়ে বাড়িতে ফিরে এলাম। একটানা পড়ে গেছি ‘তিমির প্রেম’। পড়া শেষ করে হু হু করে কেঁদে ফেলেছি। চুপচাপ বসে আছি। কান্না থামানোর চেষ্টা করছি। কান্না থামাতে পারছি না।
আমার মেজ চাচা তখন জ্বরে ভুগছেন। পড়ার জন্য বই চাইলেন। চাচাকে ‘তিমির প্রেম’ পড়তে দিলাম। বই পড়ে চাচা কাঁদলেন। বললেন, অসুখে এমনিতেই দুর্বল হয়ে আছি। এমন বই দিয়েছিস, কাতর হয়ে গেলাম।
আমার কৈশোর পেরোনো সদ্য তরুণ মেজ চাচা পরিণত মানুষ। এক বই পড়ে দুজনই কাঁদছি। যার লেখা বই পড়ে কিশোর বয়সে বুকের ভেতর তীব্র আলোড়ন উঠেছে, সেই লেখকের নাম রকিব হাসান।
বাংলা কিশোরসাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র রকিব হাসান। নক্ষত্র নিভে গেছে। লেখক রকিব হাসান পৃথিবীর স্পর্শ ছেড়ে অনন্তলোকে চলে গেছেন। যিনি আমাদের হাতে প্রথম রহস্যের বই তুলে দিয়েছিলেন, যিনি শিখিয়েছিলেন বন্ধুত্ব, সাহস আর সত্যের মানে; সেই মানুষ চলে গেলেন চিরবিদায় নিয়ে।
১৫ অক্টোবর বিকেলে ঢাকার গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ইন্তেকাল করেন ‘তিন গোয়েন্দা’র স্রষ্টা রকিব হাসান। তিনি দীর্ঘদিন কিডনির জটিলতায় ভুগছিলেন। তাঁর বয়স হয়েছিল প্রায় ৭৫ বছর।
তবে রকিব হাসানের অনন্তলোকে চলে যাওয়া শুধু একজন লেখকের মৃত্যু নয়, আমাদের কৈশোরের এক যুগের থমকে যাওয়া। রকিব হাসান সেই মানুষ, যিনি কিশোর বয়সের হাজারো পাঠকের কল্পনার পৃথিবী গড়ে দিয়েছেন।
বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে রকিব হাসান বিশেষভাবে পরিচিত গোয়েন্দা গল্পের লেখক হিসেবে। তিনি ‘তিন গোয়েন্দা’ সিরিজের স্রষ্টা হিসেবে একনামে খ্যাতি অর্জন করেছেন। হিরো হয়ে উঠেছেন আমাদের কাছে। সিরিজটি সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়ে বাংলাদেশের একাধিক প্রজন্মের কিশোর পাঠকের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তা ছাড়া রকিব হাসান অনুবাদ করেছেন ব্রাম স্টোকারের ‘ড্রাকুলা’, এরিক ফন দানিকেন, ফার্লে মোয়াট ও জেরাল্ড ডুরেলের মতো বিশ্বখ্যাত লেখকের বহু ক্ল্যাসিক কৃতিত্বপূর্ণ বই।
আমাদের প্রজন্মের কাছে ‘তিন গোয়েন্দা’ মানেই ছিল এক আলাদা দুনিয়া। ছুটির দিনে কিংবা ছুটির সময় বই হাতে নিয়ে আমরা হারিয়ে গেছি কিশোর, মুসা আর রবিনের সঙ্গে রহস্যের সন্ধানে। তিন বন্ধুর বুদ্ধি, সাহস আর বন্ধুত্বের গল্পে আমরা নিজেদের খুঁজে পেয়েছি। রকিব হাসান আমাদের শিখিয়েছেন, ভয় না পেয়ে প্রশ্ন করা মানেই বেড়ে ওঠা
‘ড্রাকুলা’ পড়ে আমরা পরিবারের সবাই এক অলীক অবয়বকে সত্য বলে কল্পনা করতে শুরু করি। তখন থেকে আমাদের ভেতর বিচরণ করতে থাকে ড্রাকুলা। বিভিন্ন ঘটনার সঙ্গে আমরা ড্রাকুলার উপস্থিতি খুঁজে পেতে থাকি। সেই কল্পিত ড্রাকুলা থেকে রেহাই পেতে বইয়ে লেখা পদ্ধতি অনুসরণ করে যাই।
ইংল্যান্ডের তরুণ আইনজীবী জনাথন হার্কার ট্রান্সিলভানিয়ার দুর্গে যান রহস্যময় কাউন্ট ড্রাকুলার সঙ্গে দেখা করতে। ধীরে ধীরে তিনি বুঝতে পারেন, ড্রাকুলা মানুষ নয়, এক ভয়ংকর ভ্যাম্পায়ার, যে মানুষের রক্ত পান করে অমর থাকে। ড্রাকুলা পরে ইংল্যান্ডে এসে একাধিক মানুষকে আক্রান্ত করতে শুরু করে। হার্কার, তার প্রণয়িনী মিনা, ডাক্তার ভ্যান হেলসিংসহ কয়েকজন মিলে তাকে থামানোর জন্য প্রাণপণ লড়াই চালিয়ে যায়। ভয়, মৃত্যু, অন্ধকার আর মানবতার লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে তারা অবশেষে ড্রাকুলাকে ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। আমরা পরিবারের সবাই—ভাই, বোন, চাচা, ফুফু ড্রাকুলা ধ্বংসের সেই অভিযানের অংশ হয়ে যাই।
আমাদের প্রজন্মের কাছে ‘তিন গোয়েন্দা’ মানেই ছিল এক আলাদা দুনিয়া। ছুটির দিনে কিংবা ছুটির সময় বই হাতে নিয়ে আমরা হারিয়ে গেছি কিশোর, মুসা আর রবিনের সঙ্গে রহস্যের সন্ধানে। তিন বন্ধুর বুদ্ধি, সাহস আর বন্ধুত্বের গল্পে আমরা নিজেদের খুঁজে পেয়েছি। রকিব হাসান আমাদের শিখিয়েছেন, ভয় না পেয়ে প্রশ্ন করা মানেই বেড়ে ওঠা। আমরা প্রশ্ন করতে শিখেছি। নিজের কাছে, বড়দের কাছে। আমরা যেকোনো রহস্যের সন্ধানে মেতে উঠেছি যেকোনো সময়।
রকিব হাসান জন্মেছিলেন ১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর, কুমিল্লায়। বাবার চাকরির সুবাদে শৈশব কেটেছে ফেনীতে। ছোটবেলা থেকেই বই ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী—বিশেষ করে রহস্য, গোয়েন্দা আর অ্যাডভেঞ্চারের গল্প। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে উচ্চশিক্ষা শেষ করে তিনি চাকরিজীবনে প্রবেশ করেন, কিন্তু অফিসের বাঁধাধরা জীবনে মন টেকেনি। অবশেষে লেখালেখিকেই নিজের জীবনপথ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন।
রকিব হাসান (১২ ডিসেম্বর ১৯৫০-১৫ অক্টোবর ২০২৫)
রকিব হাসানের লেখালেখির শুরু হয়েছিল অনুবাদ দিয়ে। তিনি বিদেশি সাহিত্যের বহু জনপ্রিয় বই অনুবাদ করেছেন বাংলায়—যার মধ্যে ‘ড্রাকুলা’ অন্যতম। উল্লেখযোগ্য আরও অনুবাদ বইয়ের মধ্যে আছে ‘রবিনসন ক্রুসো’। জুল ভার্নের রচনাও তিনি অনুবাদ করেছেন শামসুদ্দীন নওয়াব ছদ্মনামে। অনুবাদের মাধ্যমেই বাংলা পাঠকের কাছে রহস্য আর রোমাঞ্চধর্মী সাহিত্যকে জনপ্রিয় করে তুলেছেন। সেখান থেকেই জন্ম নিয়েছে লেখক রকিব হাসানের নিজস্ব সৃজনশীল জগৎ।
১৯৮৫ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় রকিব হাসানের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ‘তিন গোয়েন্দা’। মার্কিন লেখক রবার্ট আর্থারের ‘দ্য থ্রি ইনভেস্টিগেটরস’ অবলম্বনে হলেও রকিব হাসান সেটাকে রূপ দিয়েছেন একেবারে দেশীয় আঙ্গিকে। তিনি চরিত্রগুলোকে এমনভাবে সাজিয়েছিলেন, যেন তারা আমাদের পাড়ার, পাশের বাসার কেউ।
রকিব হাসানের লেখালেখির শুরু হয়েছিল অনুবাদ দিয়ে। তিনি বিদেশি সাহিত্যের বহু জনপ্রিয় বই অনুবাদ করেছেন বাংলায়—যার মধ্যে ‘ড্রাকুলা’ অন্যতম। উল্লেখযোগ্য আরও অনুবাদ বইয়ের মধ্যে আছে ‘রবিনসন ক্রুসো’। জুল ভার্নের রচনাও তিনি অনুবাদ করেছেন শামসুদ্দীন নওয়াব ছদ্মনামে।
‘তিন গোয়েন্দা’ বই খুললেই প্রথমে লেখা থাকে এভাবে, হ্যাল্লো কিশোর বন্ধুরা—
আমি কিশোর পাশা বলছি অ্যামিরিকার রকি বিচ থেকে। জায়গাটা লস অ্যাঞ্জেলসে, প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে। হলিউড থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে। যারা এখনো আমাদের পরিচয় জানো না, তাদের বলছি, আমরা তিন বন্ধু একটা গোয়েন্দা সংস্থা খুলেছি। নাম তিন গোয়েন্দা।
আমি বাঙালি, থাকি চাচা-চাচির কাছে। দুই বন্ধুর একজনের নাম মুসা আমান। ব্যায়ামবীর, আমেরিকান নিগ্রো। অন্যজন আইরিশ আমেরিকান, রবিন মিলফোর্ড, বইয়ের পোকা। একই ক্লাসে পড়ছি আমরা। পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডে লোহালক্কড়ের জঞ্জালের নিচে পুরোনো এক মোবাইল হোমে আমাদের হেডকোয়ার্টার। নতুন এক রহস্যের সমাধান করতে চলেছি আমরা। চলে এসো আমাদের দলে।
এটুকু পড়েই উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপতে থাকি। আমরাও সে সময়ে কিশোর পাশা, মুসা আমান আর রবিন মিলফোর্ডের সঙ্গে সেই স্যালভিজ ইয়ার্ডে লোহালক্কড়ের জঞ্জালের নিচে পুরোনো মোবাইল হোমে বানানো গোয়েন্দা সংস্থার হেডকোয়ার্টারে উপস্থিত হই। নেমে পড়ি রহস্যের সমাধানে। পাশা, মুসা আর রবিন তখন হয়ে ওঠে আমাদের পরম বন্ধু।
কিশোর, মুসা আর রবিন—তিন বন্ধুর দুঃসাহসিক অভিযানের মধ্য দিয়ে রকিব হাসান সৃষ্টি করেছেন এমন এক জগৎ, যেখানে পাঠক শুধু রহস্যের সমাধানই খুঁজে পায় না, পায় সাহস, বন্ধুত্ব আর যুক্তির পাঠ। রকিব হাসানের সহজ ও প্রাণবন্ত ভাষা, চোখের সামনে দৃশমান হয়ে ওঠা সাজানো সব দৃশ্য, দারুণ মজার সংলাপ আর টানটান রহস্য পাঠককে টেনে নিয়ে যায় এক বসাতে বইয়ের শেষ পর্যন্ত। যেন কাহিনির সঙ্গে বেঁধে ফেলেছেন পাঠককে আষ্টেপৃষ্ঠে। যে বাঁধন ছেড়ে যাওয়া যায় না।
‘তিন গোয়েন্দা’–ই শুধু নয়, রকিব হাসান লিখেছেন ‘গোয়েন্দা রাজু’, ‘রেজা-সুজা’, ‘গোয়েন্দা কিশোর মুসা রবিন’সহ বহু জনপ্রিয় সিরিজ। মৌলিক ও অনূদিত মিলিয়ে তাঁর বইয়ের সংখ্যা চার শতাধিক। তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ কর্মী, যিনি প্রতিদিন লিখে গেছেন নিরলসভাবে। নতুন রহস্য নিয়ে ভেবেছেন, গড়ে তুলেছেন নতুন চরিত্র।
রকিব হাসানের লেখার মূল শক্তি তাঁর ভাষার স্বাভাবিকতা। তিনি কখনো জটিল শব্দে গল্প ভারী করেননি। তাঁর গল্পে কিশোর–তরুণদের কথা বলার ভঙ্গি, হাসির উচ্ছলতা, আর সেই চেনা ‘দারুণ আইডিয়া!’ ধাঁচের সংলাপ পাঠকের কাছে নিজের জীবনের অংশ বলে মনে হয়েছে। হয়তো সে কারণেই তাঁর বই পাঠকের মধ্যে এত জনপ্রিয় হয়েছে। কারণ, তিনি আমাদের মতো করেই গল্প বলেছেন। আমরা যেভাবে কথা বলি, গল্প করি—সেভাবে; যেন আরোপিত কিছু নয়।
‘তিন গোয়েন্দা’–ই শুধু নয়, রকিব হাসান লিখেছেন ‘গোয়েন্দা রাজু’, ‘রেজা-সুজা’, ‘গোয়েন্দা কিশোর মুসা রবিন’সহ বহু জনপ্রিয় সিরিজ। মৌলিক ও অনূদিত মিলিয়ে তাঁর বইয়ের সংখ্যা চার শতাধিক। তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ কর্মী, যিনি প্রতিদিন লিখে গেছেন নিরলসভাবে। নতুন রহস্য নিয়ে ভেবেছেন, গড়ে তুলেছেন নতুন চরিত্র।
রকিব হাসান ছিলেন প্রচারবিমুখ মানুষ। তিনি খুব কম আসতেন মানুষের ভিড়ে। অনেক বছর পর তাঁকে একবারই মাত্র খুঁজে পেয়েছিলাম বইমেলায়। হয়তো আরও এসেছেন। চুপচাপ এসে, কোনো বইয়ের স্টলে নিঃশব্দ বসে থেকে, নীরবে চলে গেছেন বইমেলা ছেড়ে। সাক্ষাৎকার দিতেও অনীহা ছিল তাঁর। তবে রকিব হাসানের লেখা বইয়ের প্রচার করে গেছে তাঁর অগণিত অজস্র পাঠক নিজ আগ্রহে। আমাদের মতো হাজারো কিশোর–তরুণ যখন বন্ধুর হাতে রকিব হাসানের কোনো বই ধরিয়ে দিয়ে বলেছে, পড়ে দেখো, দারুণ রহস্য আছে, তখনই তাঁর গল্প ছড়িয়ে পড়েছে পাড়ায় পাড়ায়, এ মহল্লা থেকে আরেক মহল্লায়।
আজকের প্রজন্ম কতখানি রিলেট করতে পারবে জানি না। তখন মুঠোফোন বা ইন্টারনেট ছিল না—আমাদের শৈশব–তারুণ্যে। তবু রকিব হাসানের কলমেই আমরা পৃথিবীর রহস্যে ঘেরা সব জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি। যেমন নীল নদের ধারে, লাল গুহায়, কিংবা অজানা কোনো মরুভূমিতে। তিনি যেন শেখাচ্ছিলেন, কল্পনাই আমাদের সৃজনশীলতার সবচেয়ে বড় শক্তি।
রকিব হাসানের লেখা কেবল আনন্দ দিয়েছে, তা–ই নয়, আমাদের মূল্যবোধ গড়ে দিয়েছে। তাঁর তৈরি চরিত্ররা আমাদের শিখিয়েছে সততা, সাহস, আর বন্ধুত্বের মানে। অনেকেই হয়তো প্রথম গল্পের বই হাতে নিয়েছিল সে কারণেই। আমার মতো অনেক লেখক এখনো বলেন, কখনো আমার লেখার অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছে ‘তিন গোয়েন্দা’।
রকিব হাসানের প্রয়াণের খবর ছড়িয়ে পড়তেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে নিজ স্মৃতির কথা লিখেছেন। কেউ লিখেছেন, ‘আমার শৈশবের অংশ চলে গেল।’ একজন লিখেছেন, ‘আমার খুব কান্না পাচ্ছে! আমি বড় হয়েছি “তিন গোয়েন্দা”র সাথে। একজন শিশুর মনে উনি বইয়ের জন্য যে ভালোবাসা তৈরি করেছেন, আমি তার জন্য কৃতজ্ঞ।’ আরেকজন লিখেছেন, ‘আমার প্রথম পড়া বই ছিল “তিন গোয়েন্দা”, তাই রকিব হাসান আমার শিক্ষক।’ আরও একজন লিখেছেন, ‘“তিন গোয়েন্দা”র সাথেই বেড়ে উঠেছি আমরা তিন বোন। পাগলের মতো পড়েছি। গভীর শ্রদ্ধা।’
এ কথা সত্য যে রকিব হাসান কখনো হারিয়ে যাবেন না। যত দিন কোনো কিশোর রহস্যে মুগ্ধ হবে, যত দিন বই হাতে বন্ধুত্বের গল্প পড়বে, তত দিন রকিব হাসান বেঁচে থাকবেন। তিনি কেবল একজন লেখক নন, তিনি এক প্রজন্মের অভিভাবক, যিনি আমাদের সাহসী করে তুলেছেন নিজের অজান্তেই।
আজ মনে হচ্ছে যেন স্যালভিজ ইয়ার্ডে লোহালক্কড়ের জঞ্জালের নিচে পুরোনো মোবাইল হোমে বানানো তিন গোয়েন্দার সেই হেডকোয়ার্টার নিস্তব্ধ হয়ে আছে। মুসা আমান আর রবিন মিলফোর্ড বড্ড বেশি চুপচাপ হয়ে গেছে। কিশোর পাশা তাকিয়ে আছে দূরে—কেস ক্লোজড!
কিন্তু না, এই গল্প শেষ হয়নি। রকিব হাসানের লেখা যত দিন বেঁচে থাকবে, তাঁর পাঠকেরাই সেই কেস চালিয়ে নিয়ে যাবে, নতুন রহস্য খুঁজে বের করবে। তার সমাধান করবে।
প্রিয় রকিব হাসান, আপনি শুধু ‘তিন গোয়েন্দা’র স্রষ্টা নন, আপনি আমাদের শৈশবের স্থপতি। আপনার লেখা আমাদের শিখিয়েছে কল্পনা করতে, চিন্তা করতে, প্রশ্ন করতে আর সাহসী হতে। আজ আপনি নেই, তবু আমরা যারা বড় হয়েছি আপনার বইয়ের পাতায় মিশে, তারা সবাই আপনার কিশোর, মুসা আর রবিন হয়ে আছি। আপনার প্রতি আভূমিনত শ্রদ্ধা, নিতল ভালোবাসা আর গহিন কৃতজ্ঞতা—আমাদের স্বপ্ন দেখার মতো মন বানিয়ে দেওয়ার জন্য।