শামীম আহমেদ
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান নিয়ে পড়ালেখা করছিলাম গত কয়েকদিন ধরেই। আইনে পড়ালেখা করা বাংলাদেশিদের নিজেদের দেশ ও পাড়ি জমানো দেশের আইন নিয়ে এত কম জ্ঞান যে তাদের ৭-১০ বছরের পড়ালেখার ভিত্তিতে অর্জিত শিক্ষাকে (অধিকাংশের) তুলোধুনো করতে ৫-৭ দিনের বেশী পড়ালেখা করা লাগে না। তবে নিশ্চয় প্রজ্ঞাবান অনেকে আছেন, তাদের কথা ভিন্ন। তো পড়ালেখা করছিলাম মূলত ‘জুলাই সনদ’ বাংলাদেশ সংবিধান অনুযায়ী তৈরি করা কতটা বৈধ সেটা বুঝবার জন্য।
কিন্তু পড়ালেখা করতে গিয়ে বিস্মিত হয়েছি, ধাক্কা খেয়েছি। আদতে জুলাই সনদ তো সম্পূর্ণ অবৈধ বটেই, এটি তৈরি করায় যারা জড়িত এবং তাতে যে কেউ সমর্থন এমনকি অনুসমর্থন দিলেও সেটি বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রদ্রোহিতা এবং এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
যে সংবিধান অনুযায়ী ইউনূস ও তার (দখলদার) সরকার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় রাষ্ট্রপতির নিকট শপথ গ্রহণের মাধ্যমে (জোরপূর্বক) সরকার পরিচালনা করছে, সেই সংবিধান অনুযায়ী ‘জুলাই সনদ’ তৈরি করে একই সংবিধানের নানা অনুচ্ছেদ রদ, রহিত, পরিবর্তনের কারণে দেশের প্রচলিত আইনে তারা সর্বোচ্চ শাস্তির আওতায় দণ্ডিত হবে।
একইভাবে এই সংবিধান বিকৃতি ও তাতে সমর্থনের দায়ে বিএনপি ও জামায়াতসহ অন্যান্য যারাই ‘জুলাই সনদ’কে সমর্থন বা অনুসমর্থন করবে, তারাও একই দণ্ডে ষড়যন্ত্রের অংশীদার হিসেবে সর্বোচ্চ শাস্তির সম্মুখীন হবে। এই শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
খুব সিরিয়াসলি একটা কথা বলি ভাই। এটি কোন দলীয় আহ্বান নয়। আপনাদের ভালোর জন্য, শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে বলছি, ‘জুলাই সনদের’ পক্ষে একটি শব্দও লিখবেন না। সমর্থন করবেন না। নতুবা বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে একদিন আপনার মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। এটি আইন, এটা বাংলাদেশের সংবিধানের ধারা। শেখ হাসিনার তৈরি করা নয়। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানের অংশ এটি।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের প্রথম ভাগ – প্রজাতন্ত্র – অংশের – সংবিধান বাতিল, স্থগিতকরণ, ইত্যাদি অপরাধ সংক্রান্ত ধারায় বলা হয়েছেঃ
৭ক। (১) কোন ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোন অসাংবিধানিক পন্থায় –
(ক) এই সংবিধান বা ইহার কোন অনুচ্ছেদ রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে ; কিংবা
(খ) এই সংবিধান বা ইহার কোন বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে-
তাহার এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে এবং ঐ ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হইবে।
(২) কোন ব্যক্তি (১) দফায় বর্ণিত-
(ক) কোন কার্য করিতে সহযোগিতা বা উস্কানি প্রদান করিলে; কিংবা
(খ) কার্য অনুমোদন, মার্জনা, সমর্থন বা অনুসমর্থন করিলে-
তাহার এইরূপ কার্যও একই অপরাধ হইবে।
(৩) এই অনুচ্ছেদে বর্ণিত অপরাধে দোষী ব্যক্তি প্রচলিত আইনে অন্যান্য অপরাধের জন্য নির্ধারিত দণ্ডের মধ্যে সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডিত হইবে।
সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) আইন, ২০১১ (২০১১ সনের ১৪নং আইন)-এর ৭ ধারাবলে ৭ক এবং ৭খ অনুচ্ছেদ সন্নিবেশিত।
এছাড়াও, সংবিধানের মৌলিক বিধানাবলী সংশোধন অযোগ্য ধারায় বলা হয়েছে –
৭খ।সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রথম ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, দ্বিতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, নবম-ক ভাগে বর্ণিত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলী সাপেক্ষে তৃতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ এবং একাদশ ভাগের ১৫০ অনুচ্ছেদসহ সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত অনুচ্ছেদসমুহের বিধানাবলী সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোন পন্থায় সংশোধনের অযোগ্য হইবে।
সুতরাং সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগ – রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, তৃতীয় ভাগ – মৌলিক অধিকার, চতুর্থ ভাগ – নির্বাহী বিভাগ, পঞ্চম ভাগ – আইনসভা, ষষ্ঠ ভাগ – বিচার বিভাগ, সপ্তম ভাগ – নির্বাচন, অষ্টম ভাগ – মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, নবম ভাগ – বাংলাদেশের কর্মবিভাগ, একাদশ বিভাগ – বিবিধের ১৫০ অনুচ্ছেদ ব্যতিরেকে অন্যান্য অংশ প্রয়োজনে পরিবর্তন করা গেলেও সেটি হতে হবে দশম ভাগ সংবিধান-সংশোধন ধারার সংবিধানের বিধান সংশোধনের ক্ষমতার নির্ধারিত ধারা অনুয়ায়ী নির্বাচিত সংসদের অন্যূনতম দুই-তৃতীয়াংশের ভোটের মাধ্যমে। অন্যথায় নয়।
সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে বলা আছে যেঃ
১৪২। এই সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও-
(ক) সংসদের আইন-দ্বারা এই সংবিধানের কোন বিধান সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন বা রহিতকরণের দ্বারা সংশোধিত হইতে পারিবেঃ
তবে শর্ত থাকে যে,
(অ) অনুরূপ সংশোধনীর জন্য আনীত কোন বিলের সম্পূর্ন শিরনামায় এই সংবিধানের কোন বিধান সংশোধন করা হইবে বলিয়া স্পষ্টরূপে উল্লেখ না থাকিলে বিলটি বিবেচনার জন্য গ্রহণ করা যাইবে না;
(আ) সংসদের মোট সদস্য-সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে গৃহীত না হইলে অনুরূপ কোন বিলে সম্মতিদানের জন্য তাহা রাষ্ট্রপতির নিকট উপস্থাপিত হইবে না;
(খ) উপরি-উক্ত উপায়ে কোন বিল গৃহীত হইবার পর সম্মতির জন্য রাষ্ট্রপতির নিকট তাহা উপস্থাপিত হইলে উপস্থাপনের সাত দিনের মধ্যে তিনি বিলটিতে সম্মতিদান করিবেন, এবং তিনি তাহা করিতে অসমর্থ হইলে উক্ত মেয়াদের অবসানে তিনি বিলটিতে সম্মতিদান করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে।
আবারও ফিরে যাই সংবিধানের ৭ এর খ ধারায় যেখানে বলা হয়েছে, “সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রথম ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, দ্বিতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, নবম-ক ভাগে বর্ণিত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলী সাপেক্ষে তৃতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ এবং একাদশ ভাগের ১৫০ অনুচ্ছেদসহ সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত অনুচ্ছেদসমুহের বিধানাবলী সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোন পন্থায় সংশোধনের অযোগ্য হইবে।”
সুতরাং, ‘জুলাই সনদ’ অবৈধ এবং এটি তৈরি, প্রচার, প্রসার, ও সমর্থন রাষ্ট্রদ্রোহিতা, যার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। এটি আমি বলছি না। সংবিধান বলছে। সংবিধানের আলোকে আইনও বলছে।