বাংলাদেশের জন্য এটা শুধু একটা প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়, এটা একটা জাতীয় অপমান। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন থেকে বাংলাদেশ পুলিশের শেষ কনটিনজেন্টকে ফিরিয়ে আনার নির্দেশ এসেছে। কঙ্গো থেকে ১৮০ জন পুলিশ সদস্যকে নভেম্বরের মধ্যেই ফিরে আসতে হবে। এর মধ্যে ৭০ জন নারী পুলিশ অফিসার, যারা মাত্র দুই মাস আগে গিয়েছিলেন। এক মাস কাজ করার পরই তাদের ব্যাগ গুছিয়ে ফিরতে বলা হচ্ছে।
এই ঘটনার পেছনে যে কূটনৈতিক ব্যর্থতা লুকিয়ে আছে, সেটা নিয়ে কেউ কথা বলছে না। জাতিসংঘ যখন অন্য দেশগুলোর কনটিনজেন্ট আংশিক কমাচ্ছে, তখন শুধুমাত্র বাংলাদেশের পুরো ইউনিট তুলে দেওয়া হচ্ছে। ক্যামেরুন, সেনেগাল, মিশর সবার ক্ষেত্রেই সংখ্যা কমানো হচ্ছে, কিন্তু পুরোপুরি সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে না। এর মানে কী? এর মানে হচ্ছে বাংলাদেশের কূটনৈতিক উপস্থিতি এতটাই দুর্বল যে জাতিসংঘে আমাদের কথা শোনার মতো কেউ নেই।
অন্তর্বর্তী সরকারের নিরাপত্তা উপদেষ্টা বা অন্যান্য কর্তাব্যক্তিরা কি জানতেন এই সিদ্ধান্ত আসছে? যদি জানতেন, তাহলে কী করেছেন? আর যদি না জানতেন, তাহলে তো আরও খারাপ। একটা দেশের নিরাপত্তা উপদেষ্টা যদি জাতিসংঘের এত বড় সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আগাম কিছু না জানেন, তাহলে তিনি কীসের উপদেষ্টা? ইউনুস সাহেব বিদেশে নোবেল লরিয়েট হিসেবে যতই সম্মানিত হন না কেন, কূটনীতিতে তার দক্ষতা যে প্রশ্নবিদ্ধ, সেটা এই ঘটনায় আরও একবার প্রমাণিত হলো।
১৯৮৯ সাল থেকে বাংলাদেশ পুলিশ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে কাজ করছে। নামিবিয়ায় প্রথম মিশন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ২১ হাজারেরও বেশি পুলিশ সদস্য ২৬টি মিশনে দায়িত্ব পালন করেছেন। এটা শুধু একটা চাকরি ছিল না, এটা ছিল বাংলাদেশের সুনাম অর্জনের একটা বড় মাধ্যম। বিশ্বে বাংলাদেশকে একটা দায়িত্বশীল, শান্তিপ্রিয় এবং পেশাদার দেশ হিসেবে উপস্থাপন করার সুযোগ ছিল এটা।
২০০৫ সাল থেকে কঙ্গোতে বাংলাদেশের নারী পুলিশ ইউনিট দায়িত্ব পালন করছে। এই ইউনিট শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্য গর্বের বিষয় ছিল।
জাতিসংঘের একমাত্র সর্ব-মহিলা পুলিশ ইউনিট হিসেবে এদের খ্যাতি ছিল। চলতি বছরের আগস্টে এই ইউনিটের মেডেল প্যারেডে স্বয়ং জাতিসংঘ মহাসচিবের কঙ্গো বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। এটা বিরল ঘটনা, যা প্রমাণ করে জাতিসংঘ এই ইউনিটের কাজের মান নিয়ে সন্তুষ্ট ছিল।
তাহলে হঠাৎ করে কেন এই সিদ্ধান্ত? সরকারি ব্যাখ্যা অনুযায়ী জাতিসংঘের বাজেট সংকট। কিন্তু বাজেট সংকট যদি কারণ হয়, তাহলে সবার ক্ষেত্রেই সমানভাবে কাটছাঁট হওয়া উচিত ছিল। শুধু বাংলাদেশকে পুরোপুরি সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে কেন? এর পেছনে কি রাজনৈতিক কোনো কারণ আছে? গত কয়েক মাসে বাংলাদেশে যে অস্থিরতা হয়েছে, যেভাবে সরকার পরিবর্তন হয়েছে, তার প্রভাব কি জাতিসংঘের এই সিদ্ধান্তে পড়েছে?
পুলিশ সদর দপ্তরের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন যে জাতিসংঘ মিশনের পুলিশ কমিশনার মৌখিকভাবে তাদের জানিয়েছেন। এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক চিঠি আসেনি। এটাও একটা অদ্ভুত ব্যাপার। এত বড় একটা সিদ্ধান্ত মৌখিকভাবে জানানো হচ্ছে? লিখিত কোনো নির্দেশনা নেই? এটা কি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, নাকি এখানেও কোনো অস্বাভাবিকতা আছে?
যে কর্মকর্তারা আগে জাতিসংঘ মিশনে ছিলেন, তারা বলছেন এটা বাংলাদেশের কূটনৈতিক দুর্বলতার প্রমাণ। জাতিসংঘ সাধারণত সদস্যসংখ্যা কমালে সব দেশের ক্ষেত্রেই আনুপাতিক হারে কমায়। কিন্তু এবার বাংলাদেশের পুরো ইউনিটকেই তুলে নেওয়া হচ্ছে। এটা শুধু পুলিশের জন্য নয়, পুরো জাতির জন্য হতাশার। সরকারের উচিত ছিল জাতিসংঘের সঙ্গে আলোচনায় বসা, এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য চাপ দেওয়া। কিন্তু সেরকম কোনো উদ্যোগের খবর পাওয়া যাচ্ছে না।
সবচেয়ে হতাশাজনক ব্যাপার হলো এই ইউনিটটি মাত্র এক মাস আগে কাজ শুরু করেছে। আগস্টে কঙ্গো পৌঁছে ১০ সেপ্টেম্বর থেকে তারা দায়িত্ব নিয়েছে। এক মাসের মাথায় তাদের ফেরার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই দলে যাওয়ার জন্য কত প্রস্তুতি, কত খরচ, কত আশা ছিল। সেই আশা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো। যে নারী পুলিশ সদস্যরা গিয়েছিলেন, তারা নিজেদের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় সুযোগ মনে করে গিয়েছিলেন। তাদের মানসিক অবস্থা এখন কী, সেটা ভেবে দেখার দরকার আছে।
পুলিশের একজন নারী সিনিয়র কর্মকর্তা বলেছেন, সরকারের সক্রিয় উদ্যোগের অভাবে পুলিশ এখন কোণঠাসা অবস্থায়। জাতিসংঘের সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলার কোনো ক্ষমতা তাদের নেই। নারী এফপিইউর ভূমিকা শুধু পুলিশের অর্জন নয়, এটা জাতীয় গৌরব। এটা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরে। এই ভাবমূর্তি রক্ষা করা সরকারের দায়িত্ব ছিল। কিন্তু সেই দায়িত্ব পালনে তারা ব্যর্থ হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশের ভেতরে নানা ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে। আইনশৃঙ্খলার অবনতি, অর্থনৈতিক অস্থিরতা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা সব মিলিয়ে পুরো দেশ একটা ঝামেলার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ছে। জাতিসংঘের এই সিদ্ধান্ত সেই দুর্বলতার একটা প্রমাণ মাত্র।
ইউনুস সাহেবের নেতৃত্বাধীন সরকার নিয়ে শুরু থেকেই প্রশ্ন ছিল। তিনি একজন অর্থনীতিবিদ, ক্ষুদ্র ঋণের জনক, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী। কিন্তু একটা দেশ চালানো আর একটা এনজিও চালানো এক জিনিস নয়। দেশ চালাতে দরকার কূটনৈতিক দক্ষতা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষমতা, দেশের স্বার্থ রক্ষার সাহস। এই গুণগুলো তার মধ্যে আছে কিনা, সেটা এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। একজন নিরাপত্তা উপদেষ্টার প্রথম কাজ হওয়া উচিত দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর স্বার্থ রক্ষা করা, তাদের আন্তর্জাতিক উপস্থিতি নিশ্চিত করা। কিন্তু জাতিসংঘের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তার কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। তিনি কি জানতেন এই সিদ্ধান্ত আসছে? যদি জানতেন, তাহলে কী করেছেন? আর যদি না জানতেন, তাহলে তার নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক কতটা দুর্বল, সেটা বোঝা যায়।
বাংলাদেশ পুলিশের জন্য এটা একটা বড় ধাক্কা। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে তারা জাতিসংঘের মিশনে দায়িত্ব পালন করেছে। দেশের জন্য সম্মান এনেছে, আয় করেছে, অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। এখন সেই সুযোগ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শুধু বন্ধ নয়, অপমানজনকভাবে বন্ধ হচ্ছে। যে দেশগুলো বাংলাদেশের চেয়ে অনেক পরে জাতিসংঘ মিশনে যোগ দিয়েছে, তারা থাকছে। আর বাংলাদেশকে বের করে দেওয়া হচ্ছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী পুলিশ সুপার শাহাদত হোসেন এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। এটাও একটা সমস্যা। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো স্পষ্ট বক্তব্য আসছে না। কেন এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, এর বিরুদ্ধে সরকার কী পদক্ষেপ নেবে, এসব বিষয়ে জনগণকে জানানো উচিত। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। নীরবতা কখনো সমাধান হতে পারে না, বরং সন্দেহ ও অনিশ্চয়তা বাড়ায়।
জাতিসংঘের বাজেট সংকট একটা বাস্তবতা। কিন্তু সেই সংকট মোকাবিলায় কেন শুধু বাংলাদেশকে টার্গেট করা হলো, সেটা অস্পষ্ট। বাংলাদেশের পুলিশ সদস্যরা সব সময় তাদের দায়িত্ব ভালোভাবে পালন করেছে। কোনো অভিযোগ বা নালিশ কখনো শোনা যায়নি। বরং তাদের কাজের প্রশংসা হয়েছে। তাহলে এত ভালো পারফরম্যান্স থাকার পরও কেন তাদের বাদ দেওয়া হচ্ছে? এর পেছনে কি রাজনৈতিক কোনো চাপ আছে? কোনো দেশ কি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে লবিং করছে?
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এখানে একটা বড় ভূমিকা থাকার কথা ছিল। তারা কি জাতিসংঘের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে? বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি কি এই বিষয়ে কোনো প্রতিবাদ জানিয়েছেন? এসব প্রশ্নের উত্তর জনগণ জানতে চায়। কিন্তু কোনো উত্তর আসছে না।
২০ অক্টোবরের মধ্যে ১৬২ জন সদস্যকে ফেরানো হবে। বাকি ১৮ জন প্রশাসনিক কাজ শেষ করে নভেম্বরের মাঝামাঝি ফিরবেন। সময় খুবই কম। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে যদি সরকার কোনো পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে সবকিছু শেষ। তারপর আর ফিরে আসার সুযোগ থাকবে না। একবার জাতিসংঘের মিশন থেকে বের হয়ে গেলে আবার ঢোকা খুব কঠিন।
এই ঘটনা শুধু পুলিশের ব্যাপার নয়, এটা পুরো দেশের ব্যাপার। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি এখন ঝুঁকির মুখে। একটা দেশ হিসেবে আমরা কি এখনো বিশ্বের কাছে গুরুত্বপূর্ণ? আমাদের মতামত কি কেউ শোনে? আমাদের স্বার্থ রক্ষায় আমরা কি কোনো কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে পারি? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
অন্তর্বর্তী সরকার যদি সত্যিই দেশের স্বার্থ নিয়ে চিন্তা করে, তাহলে তাদের এখনই জাতিসংঘের সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের আলোচনায় বসতে হবে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, নিরাপত্তা উপদেষ্টা সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য চাপ দিতে হবে। কিন্তু সেই তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশের জনগণও এই বিষয়ে সচেতন হওয়া দরকার। এটা শুধু পুলিশের চাকরি হারানোর ব্যাপার নয়। এটা আমাদের জাতীয় গর্বের ব্যাপার। তিন দশক ধরে আমরা যে সুনাম অর্জন করেছি, সেটা এক মুহূর্তে শেষ হয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে আর কোনো দিন জাতিসংঘ মিশনে ফিরতে পারব কিনা, সেটাও অনিশ্চিত।
যারা এখন ক্ষমতায় আছেন, তাদের মনে রাখা দরকার যে দেশের সম্মান রক্ষা করা তাদের দায়িত্ব। তারা যেভাবেই ক্ষমতায় এসেছেন, এখন যখন আছেন, তখন দেশের স্বার্থ রক্ষা করা তাদের কর্তব্য। জাতিসংঘের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে তারা ইতিহাসে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হবেন।
বাংলাদেশ পুলিশের নারী ইউনিট শুধু একটা পুলিশ ইউনিট ছিল না। এটা ছিল বাংলাদেশের নারীদের ক্ষমতায়নের প্রতীক। বিশ্বের কাছে বার্তা ছিল যে বাংলাদেশে নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে, তারা দায়িত্ব নিতে পারছে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করতে পারছে। সেই বার্তা এখন হুমকির মুখে। এই ইউনিট বন্ধ হয়ে গেলে নারীদের জন্য একটা বড় সুযোগ বন্ধ হয়ে যাবে।
সবশেষে বলতে হয়, এই ঘটনা শুধু একটা প্রশাসনিক বিষয় নয়। এটা আমাদের জাতীয় আত্মসম্মানের প্রশ্ন। আমরা কি এভাবে নীরবে সব মেনে নেব? নাকি আমাদের সরকার দাঁড়িয়ে বলবে যে বাংলাদেশকে এভাবে অপমান করা যাবে না? এই প্রশ্নের উত্তর আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই পরিষ্কার হয়ে যাবে বলে আশা করতেই পারি আমরা, যদিও ইতিমধ্যে আমরা জানি যে উত্তরটা কি! এই সরকারের এই মুরোদই নেই। কারন নিজেদের মেরুদণ্ডটা বিদেশিদের কাছে বর্গা দিয়েই তো তারা ক্ষমতা দখল করছেন!(আওয়ামী লীগ পেইজ থেকে)