লন্ডন, ২০ অক্টোবর। কথাশিল্পী সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্মরণসভায় বক্তারা বলেন, তিনি শিক্ষক হিসাবে বেঁচে থাকতে চেয়েছেন আজীবন। তাকে এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যর দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করা হলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি। তিনি বলেন ‘আমি শিক্ষক হিসেবে বেঁচে থাকতে চাই।’
লন্ডনে সাংস্কৃতিক সংগঠন কবিকণ্ঠ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্মরণসভা আয়োজনে করে ২০ অক্টোবর। পূর্ব লন্ডনে অবস্থিত লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত এ স্মরণ সভায় সভাপতিত্ব করেন সাহিত্য গবেষক ফারুক আহমেদ। অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন কবি হামিদ মোহাম্মদ।
সভায় সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে স্মৃতিচারণমূলক বক্তব্য রাখেন বীরমুক্তিযোদ্ধা আবু মুসা হাসান, সহপাঠী ও বাল্যবন্ধু ফরহাদ চৌধুরী, মোহাম্মদ কামরুজ্জামান, দেওয়ান গৌস সুলতান। তারা প্রত্যেকেই ছিলেন বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁর সহপাঠী, সতীর্থ এবং ঘনিষ্টজন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ছাত্র লেখক সাংবাদিক বিতার্কিক বুলবুল হাসান ছাত্র শিক্ষক সম্পর্কের উর্ধে এক বিরল বন্ধু উল্লেখ করে বক্তব্য রাখেন।আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেন, তিনি ছিলেন নির্মোহ ব্যক্তিত্ব, প্রশাসক হতে চাননি কখনো, শিক্ষক হিসাবে বেঁচে থাকতে চেয়েছেন আজীবন। তাকে এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যর দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করা হলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি। তিনি বলেন ‘আমি শিক্ষক হিসেবে বেঁচে থাকতে চাই।’ বুলবুল হাসান বলেন, আমরা তাকে শিক্ষক হিসাবে যেমন পেয়েছি, তেমন বন্ধু হিসাবেও পেয়েছি। শ্রেণিকক্ষের বাইরে জানার ও শেখার যে বিরাট দুনিয়া, সেটির দেখা মিলেছিল তাঁর সংস্পর্শে এসে। স্যারের পড়ানোর ভঙ্গি ছিল অনবদ্য। কলাভবনের দোতলার একটি ছোট্ট ক্লাসরুমে বসেই আমি প্রবেশ করি পাঠ্যপুস্তকের বাইরে অপেক্ষমাণ বহুমাত্রিক এক চিন্তার জগতে। বুলবুল হাসান বলেন, তিনি ছিলেন আমার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক।
বাল্যস্তৃতি রোমন্থন করে ফরহাদ চৌধুরী বলেন, একসাথে খেলাধূলা থেকে বিদ্যালয়ে পাঠ নিয়েছি আমরা। মনজুরুল ইসলাম সব সময় ভালো ছাত্র ছিল। পরবর্তী জীবনে আমাদের বিচরণক্ষেত্র ভিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়। দূরত্ব বাড়লেও বিচ্ছিন্ন হইনি।
সভার শুরুতে আবৃত্তি শিল্পী মুনিরা পারভীন সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের জীবন ও কর্ম নিয়ে একটি নিবন্ধ পাঠ করেন। এতে উঠে আসে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের বর্নাঢ্য জীবন। মুনিরা পারভীন বলেন, আমার পৈত্রিক বাড়ি হবিগঞ্জের বানিয়াচঙ্গে, তিনিও বানিয়াচঙ্গের সন্তান। তিনি আমার চাচা প্রফেসর মোহাম্মদ আলীর গর্বিত ছাত্র। সেইসুত্রে আমাদের বোধের মাঝে সর্বদা আত্মিক সম্পর্ক বিরাজমান ছিল।তাঁর সৃজনশীল সাহিত্যেরও মুগ্ধ পাঠক আমি।
আলোচনায় অংশ নিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা দেওয়ান গৌস সুলতান বলেন, আমদের সময়কার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। ছাত্রাবস্থায়ই তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। ভালো ছাত্র হিসাবে তাঁর কদরই আলাদা ছিল।
লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ এমদাদুল হক চৌধুরী লন্ডনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম কয়েক বছর আগে লন্ডনে আর্ন্তজাতিক একটি সেমিনারে অতিথি বক্তা ছিলেন। তখন দেখেছি, বিশ্ব মাত্রিক পন্ডিতরাও তাকে সমীহ করে তাঁর বক্তব্য থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে কথা বলছেন। তিনি বলেন, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ছিলেন বিশ্বমাত্রিক চিন্তক।
কবি দিলু নাসের লন্ডনে কবি সুভাষ মুখোপা্ধ্যায় ও সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সাথে দীর্ঘ সাহিত্য আড্ডার কথা স্মৃতিচারণ করে বলেন, তাঁর ছড়ার অনুরাগীপাঠক ছিলেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। সুভাষ মুখোপ্যাধায়কে তিনি অকপটে সেকথা বলেছিলেন। আবেগাপ্লুত হয়ে দিলু নাসের সে আড্ডার ছবি দেখান সভায়।
কবি হামিদ মোহাম্মদ উপস্থাপনার ফাঁকে ফাঁকে তাঁর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, সাংস্কৃতিক সংগঠন শিকড়-এর আমন্ত্রণে ১৯৯৮ ও ২০০৪ সালে দুবার দুটি সেমিনারে তিনি সিলেটে যান। সেই সেমিনারগুলোতে তিনি যে মূল্যবান বক্তব্য রাখেন, তা স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। আরো বক্তব্য রাখেন লেখক নোমান আহমেদ, সাংস্কৃতিক কর্মী শহীদ আলী, কবি সৈয়দ হিলাল সাঈফ, কবি শাহ শামীম আহমেদ, আবৃত্তিকার নজরুল ইসলাম অকিব, কবি শামীম আহমেদ, কবি একে এম আবদুল্লাহ, সাংবাদিক সালেহ আহমেদ ও সাংবাদিক রেজাউল করিম মৃধাসহ সুধীজন।
স্মরণসভায় সাম্প্রতিক এক সাহিত্য সভায় সৈয়দ মনজুরুরল ইসলামের প্রদত্ত স্মরণীয় ও দিগনির্দেশনামূলক কিছু বক্তব্য সাংবাদিক তবারকুল ইসলাম পড়ে শোনান।লেখাটি গ্রন্থনা ও রচনা করেছেন সাংবাদিক আজিজুল পারভেজ। এ টি ছিল তাঁর জীবনের শেষ কোনো সাহিত্য সভায় দেয়া বক্তব্য।
উল্লেখ্য, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম-এর জন্ম ১৮ জানুয়ারি ১৯৫১। প্রয়াত হন গত ১০ অক্টোবর ২০২৫। তিনি সিলেট শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তবে পৈত্রিক বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচঙ্গে। তার পিতার নাম সৈয়দ আমীরুল ইসলাম এবং মাতা রাবেয়া খাতুন। তিনি সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে মাধ্যমিক পাশ করেন। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন সিলেট এমসি কলেজ থেকে ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেন ১৯৭১ ও ১৯৭২ সালে। ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইয়েটস-এর কবিতায় ইমানুয়েল সুইডেনবার্গের দর্শনের প্রভাব বিষয়ে পিএইচডি করেন।
পেশাগত জীবনে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসরের পর তিনি ইউনিভার্সিটি অফ লিবারেল আর্টস বাংলাদেশে যোগ দিয়েছেন।
তাঁর গ্রন্থের রয়েছে: স্বনিরবাচিত শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৯৪), থাকা না থাকার গল্প (১৯৯৫), কাচ ভাঙ্গা রাতের গল্প (১৯৯৮), অন্ধকার ও আলো দেখার গল্প (২০০১), প্রেম ও প্রার্থনার গল্প (২০০৫)। সুখদুঃখের গল্প, বেলা অবেলার গল্প। উপন্যাসসমূহআধখানা মানুষ্য (২০০৬) দিনরাত্রিগুলি, আজগুবি রাত, তিন পর্বের জীবন।
যোগাযোগের গভীর সমস্যা নিয়ে ‘কয়েকজন একা একা লোক,’ ব্রাত্য রাইসু সহযোগে‘কানাগলির মানুষেরা’। প্রবন্ধ ও গবেষণাগ্রন্থ : নন্দনতত্ত্ব (১৯৮৬), কতিপয় প্রবন্ধ (১৯৯২)। অলস দিনের হাওয়া। মোহাম্মদ কিবরিয়া, সুবীর চৌধুরীর সহযোগে ‘রবীন্দ্রানাথের জ্যামিতি ও অন্যান্য শিল্পপ্রসঙ্গ’।
পুরস্কার ও সম্মাননা: বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৬),একুশে পদক (২০১৮)[৪]।
এই নিবিষ্টতা সত্ত্বেও সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ক্লাসরুমের মধ্যেই আবদ্ধ হয়ে থাকেননি। নিজ গুণে ছড়িয়ে পড়েছিলেন বৃহত্তর পরিসরে। পড়াতেন সাহিত্য, বিশেষ আগ্রহ ছিল নন্দনতত্ত্বে। ১৯৮৫ সালে বাংলা একাডেমির সে সময়কার মহাপরিচালক মনজুরে মওলার তদারকিতে ‘ভাষা–শহীদ গ্রন্থমালা’ সিরিজে তাঁর প্রথম প্রকাশিত বইয়ের শিরোনাম যে নন্দনতত্ত্ব, সেটি কোনো আকস্মিক ব্যাপার নয়। তিনি পড়াতেন উত্তর–আধুনিকতা, উত্তর–কাঠামোবাদ ও উত্তর–উপনিবেশবাদের তত্ত্বজগৎ, তবে এর তীক্ষ্ণ সাংস্কৃতিক–রাজনৈতিক শল্যব্যবচ্ছেদে তাঁর আগ্রহ ছিল কম। তিনি ছিলেন রুচি ও সৌন্দর্যে মুগ্ধ মানুষ। এসব নতুনতর ভাবনার চমকপ্রদ সৌন্দর্য সৈয়দ মনজুরকে বিমোহিত করেছিল বেশি। আর এর নিপুণ প্রকাশ ঘটেছিল প্রবন্ধ–নিবন্ধের বদলে তাঁর গল্পে।
তিনি ছিলেন খ্যাতিমান রসসাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর দৌহিত্র। তাঁর লেখায় ও কথা বলায় ছিল সৈয়দ মুজতবা আলীর রসবোধের ছায়া।এছাড়া শিক্ষাজীবনে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একশ বছরের ইতিহাসে ইংরেজী সাহিত্যে কবি বুব্ধদেব বসুর অনার্স ও মাস্টার্সের সর্বোচ্চ নম্বরের রেকর্ড অতিক্রম করা শিক্ষার্থী ছিলেন।