এক বছর আগেও রফিকুল ইসলাম ছিলেন একটি পোশাক কারখানার সুপারভাইজার। মাসে ৩৫ হাজার টাকা আয়, সন্তানদের স্কুলে পড়াশোনা, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে শান্তিপূর্ণ সংসার সবকিছুই চলছিল নিয়মিত ছন্দে। কিন্তু কয়েক মাসের ব্যবধানে সব পাল্টে গেছে। এখন তিনি বেকার। গ্যাসের দাম, বাজারের আগুন আর বাচ্চাদের পড়ার খরচ—সব মিলিয়ে সংসার চালানো দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।
রফিকুল বলেন, “আগে মাস শেষে কিছু টাকা বাঁচত, এখন মাসের মাঝেই ধার করতে হয়। কখনও একবেলা খেয়ে থাকি, কখনও শুধু চা-রুটি।”
এই গল্পটি শুধু রফিকুলের নয়; এটি আজ কোটি কোটি পরিবারের প্রতিচ্ছবি। যারা একসময় মধ্যবিত্ত বা সচ্ছল শ্রেণিতে ছিলেন, এখন তারা চরম দারিদ্র্যের ঘূর্ণাবর্তে পড়ে গেছেন। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, কর্মসংস্থানের সংকট, আর মুদ্রাস্ফীতির চাপে মানুষের আয় থেকে ব্যয় বহুগুণ বেড়ে গেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, গত এক বছরে বাস্তব আয় কমেছে ৩০ শতাংশেরও বেশি, অপরদিকে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। এ বাস্তবতায় বহু পরিবার দিনে একবেলা না খেয়ে থাকে, কেউ বা একবেলা কম খায়। এমন চিত্র গত এক যুগে দেখা যায়নি।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই পরিস্থিতি কেবল বৈশ্বিক সংকটের কারণে নয়—বরং সরকারের দেশ পরিচালনায় ব্যর্থতা, নীতি অদক্ষতা ও দুর্নীতিই মূল কারণ। বাজেট ঘাটতি, বিনিয়োগ স্থবিরতা, বিদেশি রিজার্ভ সংকট এবং ব্যাংক খাতে অব্যবস্থাপনা অর্থনীতিকে দুর্বল করে তুলেছে। উৎপাদন ও রপ্তানিখাত থমকে গেছে, হাজারো শ্রমিক চাকরি হারাচ্ছেন।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা ও সামাজিক বিভক্তি। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে সরকারের দমননীতি, বিরোধী মতের ওপর দমন-পীড়ন এবং প্রশাসনিক অদক্ষতা সমাজে হানাহানি ও ক্ষোভ বাড়িয়ে তুলছে। মানুষ এখন শুধু অভাবে নয়, ভয়ে ও অনিশ্চয়তায়ও দিন কাটাচ্ছে।
আজ বাংলাদেশের জনগণ এমন এক বাস্তবতার মুখোমুখি, যেখানে ভাতের থালায় অভাব, আর জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই হাহাকার। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত মানুষ বলছে “বাঁচতে কষ্ট হয়, মরতে ভয় লাগে।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি এখনই বাস্তবসম্মত মূল্যনীতি, কর্মসংস্থান সৃজন ও সুশাসনের উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তাহলে দেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিক ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাবে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এই সময়টি হয়তো স্মরণীয় হয়ে থাকবে এক “নীরব দুর্ভিক্ষ” হিসেবে—যেখানে মানুষ কেবল পেটের ভাত নয়, হারিয়েছে আশা, মর্যাদা ও ভবিষ্যতের বিশ্বাস।
