মাহফুজ আলম এখন সংঘাতের ভয় দেখাচ্ছেন। বলছেন কয়েক মাসের মধ্যে সব দেখা যাবে। শুনে মনে হয় উনি যেন এসব কিছুই জানতেন না, এসব ঘটনার সাথে যেন তার কোনো সম্পর্কই নেই। অথচ জুলাইয়ে যখন পুরো দেশ জুড়ে আগুন জ্বলছিল, তখন এই মানুষটি কোথায় ছিলেন? কী করছিলেন? এখন ক্ষমতায় এসে যখন দেখছেন যে জিনিসটা তারা বোতল থেকে বের করেছেন সেটা আর ভেতরে ঢোকানো যাচ্ছে না, তখন হঠাৎ করে শান্তির ফেরিওয়ালা সেজে গেছেন।
ইউনূস সাহেব তো নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন দরিদ্রদের উন্নয়নের জন্য। কিন্তু আসলে যে ব্যবসা তিনি করেছেন সেটা হলো সুদের ব্যবসা। গরিব মানুষদের কাছ থেকে চড়া সুদ নিয়ে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন। সেই মানুষটা আজ দেশ চালাচ্ছেন। কীভাবে? ক্যু করে। আর সেই ক্যু হয়েছে জেনারেল ওয়াকারের মতো সামরিক কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়। জুলাই মাসে পুরো দেশে যে দাঙ্গা হলো, সেটা কি এমনি এমনি হয়েছিল? লাখ লাখ মানুষকে উস্কিয়ে রাস্তায় নামানো হলো, সরকারি ভবনে আগুন দিলো, পুলিশের সাথে সংঘর্ষ করলো – এসব কি স্বতঃস্ফূর্ত ছিল?
কারা টাকা দিয়েছিল সেই দাঙ্গায়? কোন বিদেশি শক্তি এর পেছনে ছিল? কোন জঙ্গি সংগঠনগুলো মাঠে নেমেছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর সবাই জানে। কিন্তু কেউ মুখ খুলছে না কারণ যারা এখন ক্ষমতায় তারাই তো সেই দাঙ্গার সাথে জড়িত ছিল। নির্বাচিত একটা সরকারকে উৎখাত করে ফেলা হলো। হ্যাঁ, তর্কের খাতিরে না হয় বুঝলাম আপনার সাথে সেই সরকারের অনেক সমস্যা ছিল, অনেক স্বার্থবিরোধী ইস্যু ছিল আপনাদের। কিন্তু সেটার সমাধান কি এই ছিল? রাস্তায় মানুষ মেরে, সম্পত্তি ধ্বংস করে, পুরো দেশকে অস্থির করে দিয়ে ক্ষমতা দখল করা – এটাই কি সমাধান ছিল?
এখন যেটা হচ্ছে সেটা আরও ভয়ানক। মাজার ভাঙা হচ্ছে। দরবারে হামলা চলছে। মসজিদ থেকে মানুষকে জোর করে বের করে দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে এসব কখনো এতটা নগ্ন হয়নি। শেরপুরের মুর্শিদপুর দরবারে হামলা হলো। সেখানে কোনো মাজার নেই, কোনো সেজদা হয় না, কোনো বিতর্কিত কাজ হয় না। তারপরও হামলা। কেন? কারণ একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠী ঠিক করে ফেলেছে যে বাংলাদেশে যে ধরনের ইসলাম চর্চা হয়ে আসছে সেটা ‘ভুল’। তারা চায় তাদের নিজেদের মতো করে ইসলাম চর্চা হোক। আর যে কেউ তাদের সাথে একমত নয়, তাকে শায়েস্তা করতে হবে।
এই কাজগুলো কিন্তু হঠাৎ করে শুরু হয়নি। ৫ অগাস্টের পর থেকে একটার পর একটা ঘটনা ঘটছে। গাজীপুরে, সিলেটে, চট্টগ্রামে – সব জায়গায় একই ধরনের হামলা। এক-দুইটা ঘটনা হলে বলা যেত এটা বিচ্ছিন্ন। কিন্তু একশ-দেড়শ ঘটনা? এটা তো পরিকল্পিত। আর সরকার কী করছে? কিছুই না। মাহফুজ আলম এখন বলছেন প্রধান উপদেষ্টার ‘অবস্থানের কারণে’ অনেকে সংঘাতে জড়াচ্ছে না। মানে কী এর? মানে ইউনূস সাহেব যদি চলে যান তাহলে আরও বড় সংঘাত হবে? তাহলে এই পুরো ব্যবস্থাটা দাঁড়িয়ে আছে কীসের ওপর? ভয়ের ওপর? হুমকির ওপর?
জুলাই মাসে যারা রাস্তায় নেমেছিল তাদের মধ্যে অনেকেই আসলে জানতো না তারা কীসের জন্য লড়ছে। তাদের বলা হয়েছিল গণতন্ত্রের জন্য, স্বাধীনতার জন্য। কিন্তু আসলে যেটা হয়েছে সেটা হলো একদল মানুষ তাদের নিজেদের স্বার্থে পুরো দেশটাকে ব্যবহার করেছে। তারা জানতো কোন গোষ্ঠীকে উসকে দিলে সহিংসতা ছড়ানো সম্ভব। তারা সেই গোষ্ঠীগুলোকে ব্যবহার করেছে। জঙ্গি মানসিকতার মানুষদের সুযোগ দিয়েছে। আর এখন সেই মানুষগুলো তাদের আসল রূপ দেখাচ্ছে।
মাজার সংস্কৃতি এদেশের একটা বড় অংশ। এটা শুধু ধর্ম নয়, এটা সংস্কৃতি। এটা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এদেশে আছে। সাধারণ মানুষ মাজারে যায়, মানত করে, শান্তি খোঁজে। এতে কারো কী সমস্যা? কিন্তু একদল মানুষ এটাকে ‘শিরক’ বলছে, ‘বিদআত’ বলছে। তাদের মতে এসব বন্ধ করতে হবে। আর সেই কাজটা তারা করছে হাতুড়ি-লাঠি নিয়ে। কোরআনের নাম করে মানুষকে মারছে, সম্পত্তি ভাঙছে। এর চেয়ে বড় ভণ্ডামি আর কী আছে?
সবচেয়ে হাস্যকর ব্যাপার হলো, একটা মুসলিম দেশে মুসলমানদের মসজিদ-মাজার ভাঙা হচ্ছে। মুসলমানদের ওপর হামলা হচ্ছে। আর যারা এসব করছে তারাও মুসলমান দাবি করছে। তাহলে আসল সমস্যাটা কী? সমস্যা হলো ক্ষমতা। ধর্ম এখানে শুধু একটা অজুহাত। যারা ক্ষমতায় আছে তারা চায় একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর হাতে সব কিছু থাকুক। যারা তাদের কথা শুনবে না, তাদের দমন করতে হবে। আর সংখ্যালঘুদের অবস্থা? সেটা তো আরও ভয়াবহ। যখন সংখ্যাগরিষ্ঠদের ওপরই এমন অত্যাচার চলছে, তখন সংখ্যালঘুদের কী হচ্ছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ইউনূস আর ওয়াকার একটা বিশাল ভুল করেছেন। তারা ভেবেছিলেন জঙ্গিদের ব্যবহার করে ক্ষমতায় আসবেন, তারপর তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখবেন। কিন্তু জঙ্গিবাদ কোনোদিন কারো নিয়ন্ত্রণে থাকে না। এটা একবার শুরু হলে সবাইকে গ্রাস করে। পাকিস্তান দেখেছে, আফগানিস্তান দেখেছে, ইরাক-সিরিয়া দেখেছে। আর এখন বাংলাদেশ সেই পথে হাঁটছে। মাহফুজ আলম হয়তো টের পাচ্ছেন যে তারা যে শক্তিকে জাগিয়ে তুলেছেন সেটা এখন তাদেরকেও রেহাই দেবে না। তাই এখন সংঘাতের আশঙ্কা করছেন, শান্তির কথা বলছেন।
কিন্তু এই শান্তি আসবে কোথা থেকে? যে মানুষগুলো দেশটাকে আগুনে পুড়িয়ে ক্ষমতায় এসেছে, তারা এখন শান্তি চাইছে শুধু নিজেদের বাঁচাতে। দেশের মানুষ? তাদের কথা তো কেউ ভাবছে না। একশ-দেড়শ মাজারে হামলা হয়েছে, সরকার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। কেন? কারণ যারা এসব করছে তারাই তো তাদের আসল শক্তি। সেই শক্তিকে থামাতে গেলে তাদের নিজেদের ভিত্তিই নড়ে যাবে। তাই চুপ করে বসে আছে। আর এই চুপ থাকাটাই প্রমাণ করে যে তারা কতটা দুর্বল, কতটা অক্ষম এবং কতটা অবৈধ।
বাংলাদেশ এখন একটা ভয়ানক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে অবৈধ সরকার, অন্যদিকে জঙ্গিবাদের উত্থান। মাঝখানে সাধারণ মানুষ, যারা কিছু বুঝে উঠার আগেই সব হারিয়ে ফেলছে। মাহফুজ আলম যতই সংঘাতের আশঙ্কা করুন, সত্যি কথা হলো তিনি নিজেই সেই সংঘাতের একজন স্থপতি। যে আগুন তারা জ্বালিয়েছিলেন, এখন সেই আগুনেই তারা পুড়ছেন। আর দেশের মানুষ দেখছে, শুধু দেখছে।
