প্রথমবারের মতো শেখ হাসিনা তার সরকার উৎখাতের ষঢ়যন্ত্রে “হাজারো নাগরিক হত্যার” ঘটনায় “নেতৃত্বের দায়িত্ব” বিষয়ে মুখ খুললেন। ভারতে অবস্থানকালে ১৫ মাস পর শেখ হাসিনা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে নিজের মতামত প্রকাশ করলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ স্পষ্ট করে বলেছেন, সুযোগ পেলে আওয়ামী লীগ আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অবশ্যই অংশ নেবে। আওয়ামী লীগ সরকারের উৎখাতের পেছনে বিদেশি শক্তির ভূমিকা ছিল কি না—এমন প্রশ্নও করা হয়েছে তাকে। ২৩৪ বিলিয়ন ডলারের অনিয়মের অভিযোগ নিয়েও জবাব দিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা।
সাক্ষাৎকার পর্ব
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস: আগামী বছরের শুরুর দিকে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করেছে ইউনূস সরকার। আপনার দলের নেতারা কি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার কথা ভাবছেন?
শেখ হাসিনা: আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তটি সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক। এটি বাংলাদেশের সংবিধান ও ভোটারদের মৌলিক অধিকারের স্পষ্ট লঙ্ঘন। এতে কোটি কোটি মানুষের ভোটের অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়েছে। অতীতে দেখা গেছে, যখন কোনো বড় দল নির্বাচনে অংশ নেয়নি, তখন সাধারণ মানুষ অন্য দলে ভোট না দিয়ে ভোটদানে অনাগ্রহ দেখিয়েছে। তাই আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে—আমাদের ভোটারদের অধিকার রক্ষার লড়াই চালিয়ে যাওয়া।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস: যদি আওয়ামী লীগ ও তার নেতৃবৃন্দ কোনোভাবেই নির্বাচনে অংশ না নেন, তাহলে এর প্রভাব বাংলাদেশে কী হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
শেখ হাসিনা: আমরা নির্বাচনে অংশ নিতে নিষেধ করছি না। বরং আমরা আন্তরিকভাবে অংশ নিতে চাই। কিন্তু একটি অনির্বাচিত প্রশাসন আমাদের নিষিদ্ধ করেছে—যারা গণতন্ত্রের প্রতি কোনো সম্মান দেখায় না। আমাদের এই চক্রটি ভাঙতে হবে—যেখানে কখনও কোনো দল নির্বাচন বর্জন করে, আবার কখনও নিষিদ্ধ হয়। এতে সরকারের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
বাংলাদেশের এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। এতে দেশ পুনরায় ঐক্য ও পুনর্মিলনের পথে এগোতে পারবে। কিন্তু আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করে এটি অর্জন করা সম্ভব নয়। আমরা এই দেশের আধুনিক ইতিহাস ও স্বাধীনতার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত, আর কোটি মানুষ আমাদের সমর্থন করে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস: হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, গত বছরের ১৫ই জুলাই থেকে ৫ই আগস্ট পর্যন্ত সরকারবিরোধী আন্দোলনে প্রায় ১,৪০০ মানুষ নিহত এবং কয়েক হাজার আহত হয়েছিল। প্রতিবেদনের দাবি, নিহতদের বেশিরভাগই নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে মারা গেছে। আপনি তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন—এই সহিংসতার দায় আপনি নেন কি?
শেখ হাসিনা: গত বছরের সেই দুঃখজনক সহিংসতায় নিহত প্রতিটি মানুষের মৃত্যু আমাকে গভীরভাবে ব্যথিত করেছে। দেশের নেতা হিসেবে আমি অবশ্যই নেতৃত্বের দায়িত্ব স্বীকার করি। তবে এটা বলা ভুল হবে যে- আমি নিরাপত্তা বাহিনীকে এমন কোনো নির্দেশ দিয়েছিলাম। মাঠপর্যায়ে যা কিছু করা হয়েছে, তা সৎ উদ্দেশ্যে এবং সহিংসতা কমানোর জন্যই করা হয়েছিল—যাতে আরও প্রাণহানি বা আইনশৃঙ্খলার অবনতি না ঘটে।
জাতিসংঘের যে মৃত্যুর সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে, আমরা সেটি মেনে নিতে চাই না। ওই সংখ্যা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি, এবং এটি অন্তর্বর্তী সরকারের সরবরাহ করা সীমিত ও যাচাইবিহীন তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি।
প্রতিবেদনে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ও আওয়ামী লীগের কর্মীদের মৃত্যুর ঘটনাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, কিন্তু তা স্পষ্ট করে বলা হয়নি। ইউনূস সরকার গত ১৫ মাসে সঠিক মৃত্যুর সংখ্যা নির্ধারণ করতে পারত, কিন্তু এখনো কোনো চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করেনি। আমার বিশ্বাস, এটি ইচ্ছাকৃতভাবে গোপন রাখা হয়েছে এবং জাতিসংঘের প্রাথমিক হিসাবকে রাজনৈতিক প্রচারের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস: বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি জাতীয় নির্বাচনের নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে—এর মধ্যে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হওয়া নির্বাচনগুলোও রয়েছে। ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের বহু নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়, ফলে তারা ভোট বর্জন করে। যুক্তরাষ্ট্র জানায়, তারা বিশ্বাস করে না যে ২০২৪ সালের নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু ছিল। বিএনপি আপনার সরকারের বিরুদ্ধে ফলাফল কারচুপির অভিযোগও তোলে। তাহলে কি আওয়ামী লীগ দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে বিকৃত করেছে?
শেখ হাসিনা: ২০২৪ সালের নির্বাচন স্বাধীন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মতে অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছিল। এ নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয়। আওয়ামী লীগ নয়বার জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে ক্ষমতায় এসেছে। দলটি কখনো সংবিধানবহির্ভূতভাবে ক্ষমতা দখল করেনি। কিন্তু বর্তমান তথাকথিত অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের কোনো ভোট ছাড়াই ক্ষমতায় এসেছে।
এছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারই স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার এনেছিল—যেমন ছবি-ভিত্তিক ভোটার তালিকা, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স এবং আইন প্রণয়নের মাধ্যমে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন। এসব সংস্কারের লক্ষ্য ছিল জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা। ১৯৭০-এর দশক থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত নির্বাচনী জালিয়াতির ইতিহাসের তুলনায় ব্যবস্থা তখন অনেক উন্নত হয়েছিল—এ নিয়ে কারও সন্দেহ ছিল না।
তবে আমি স্বীকার করি, আমাদের কিছু নির্বাচন পুরোপুরি অংশগ্রহণমূলক ছিল না। কারণ, প্রধান কিছু রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বর্জন করেছিল, ফলে ভোটাররা তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। দীর্ঘমেয়াদে এটি দেশের রাজনীতির ক্ষতি করেছে—এটা স্পষ্ট।
এখন এই অংশগ্রহণহীনতার চক্র ভাঙা জরুরি। আওয়ামী লীগ সম্পর্কে যে কারও মত যেমনই হোক, সত্য হলো—স্বাধীনতার পর থেকেই দলটি বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি, সংবিধান রক্ষার পক্ষে এবং কোটি কোটি মানুষের সমর্থনপুষ্ট। যদি আওয়ামী লীগের ওপর নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকে, তাহলে জনগণের সম্মতিতে গঠিত বৈধ সরকার প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে।
আর এটিই শুধু আমার ব্যক্তিগত মত নয়। জাতিসংঘ স্পষ্টভাবে বলেছে, বাংলাদেশের জন্য একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রয়োজন। আমি নিশ্চিত, যুক্তরাষ্ট্রও একই মত পোষণ করে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস: সাম্প্রতিক *ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস*-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস দাবি করেছেন—আপনার ১৫ বছরের শাসনামলে প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে। তিনি আরও বলেছেন, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী এবং এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম এ অর্থ বিদেশে সরিয়ে নিতে সহায়তা করেছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনও অভিযোগ তুলেছে, আপনি অবৈধভাবে সরকারি জমি বণ্টন করেছেন, যাতে আপনার পরিবারের ঘনিষ্ঠ বা রাজনৈতিকভাবে জড়িত ব্যক্তিরা লাভবান হন। এখন আপনার বিরুদ্ধে, আপনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের বিরুদ্ধেও আদালতে মামলা চলছে। এসব দুর্নীতির অভিযোগে আপনার মত কী?
শেখ হাসিনা: এসব অভিযোগের কোনো প্রমাণ নেই। এগুলো এমন সব অভিযোগ, যা আমার রাজনৈতিক বিরোধীদের প্রভাবে কাজ করা প্রসিকিউটররা সাজিয়েছে। আমি এটা বলছি না যে দেশে দুর্নীতি নেই, কিন্তু কেউ প্রমাণ করতে পারেনি যে আমার পরিবার বা ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা রাষ্ট্রের সম্পদ থেকে ব্যক্তিগতভাবে উপকৃত হয়েছেন বা কোনো সরকারি দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন।
২৩৪ বিলিয়ন ডলারের অভিযোগটি যেমন হাস্যকর, তেমনি ভিত্তিহীন। এই অঙ্ক বাংলাদেশের পুরো বাজেটের চেয়েও বেশি। বাস্তবে এত বিপুল অর্থ পাচার সম্ভবই নয়—যদি তা সত্যি ঘটত, আমাদের অর্থনীতি ধসে পড়ত। বরং আমার শাসনামলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ১৫ বছরে ৪৫০ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও অন্যান্য বৈশ্বিক সংস্থার স্বীকৃত সত্য। যারা এসব অভিযোগ করছে, তারা বাস্তব তথ্য নয়—গুজব আর কল্পকাহিনিতেই বিশ্বাস করে।
এখন আমি একটি প্রশ্ন রাখতে চাই। খবর অনুযায়ী, ড. ইউনূস পূর্বাচলে প্রায় ৪,০৮০ কাঠা জমি কিনে *নিসর্গ* নামে একটি রিসোর্ট করেছেন। তিনি ঢাকার উত্তরাতেও প্রায় ৩০০ কাঠা জমি কিনেছেন। ড. ইউনূস ১৯৯০ সালে গ্রামীণ ব্যাংকে মাত্র ৬,০০০ টাকা বেতনে চাকরি শুরু করেছিলেন। তাহলে তিনি এত বিপুল সম্পদ কোথা থেকে পেলেন? এখন বলা হচ্ছে, তার নামে দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে প্রায় ৫,০০০ কোটি টাকার স্থায়ী আমানত রয়েছে। তিনি কখনও জানাননি এই সম্পদ কীভাবে অর্জিত হয়েছে। অথচ তিনিই এখন ক্ষমতায় আছেন।
আমার মনে হয়, গণমাধ্যমের উচিত বাস্তবতা যাচাই করা—শুধু ক্লিনটন দম্পতির মতো বিখ্যাত বন্ধু থাকার কারণে ইউনূসকে প্রশ্নহীনভাবে ছাড় না দেওয়া। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস
