মনজুরুল হক
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করছেন ঘরে-বাইরে অন্তর্বর্তী সরকার এমন চাপে রয়েছে যা থেকে মুক্ত হওয়ার সম্ভবনা ক্রমশ কমে আসছে। সেদিক থেকে নভেম্বর মাসটিকে অনেকে ‘মান্থ অব ডিসাইডার’ আখ্যায়িত করছেন।
📍
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন এবং নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবীতে জামাতের নেতৃত্বে আটটি ইসলামিস্ট পার্টির আল্টিমেটাম শেষ হয়েছে ১১ নভেম্বর। এই সময়ের মধ্যে তাদের দাবী মানা না হলে তারা ব্যাপক শোডাউন করার হুমকি দিয়েছে। সরকারের একাধিক প্রতিনিধি দলগুলোর সঙ্গে আপসরফার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে।
📍
নির্বাচনের আগে গণভোটে সংবিধান সংশোধনী পাশ করাতে বদ্ধপরিকর জামায়াত। সেটা করতে পারলে ‘সাংবিধানিকভাবেই’ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা থাকবে না। এর অর্থ জামায়াত জুলাই সনদে যে ৪২টি সংবিধান সংশোধনের পয়েন্ট আছে সেই বলেই বর্তমান অন্তর্বর্তী শাসন ব্যবস্থা বহাল রাখতে পারবে। যা তাদের ইসলামী হুকুমতের অনেকটাই পুরণ করতে পারবে। অন্যান্য গণতান্ত্রিক দলগুলোর উপর বিবিধ নিষেধাজ্ঞা জারি করাতে পারবে, সর্বপরি মুক্তিযুদ্ধের ফসল-৭২-এর সংবিধানকে ছুঁড়ে ফেলতে পারবে। অর্থাৎ অফিসিয়ালি মুক্তিযুদ্ধের ‘সমাধি’ রচনা করতে এক-পা এগিয়ে যেতে পারবে।
📍
বিএনপি জামায়াতের নামোল্লেখ না করে সংকট সৃষ্টির জন্য ইন্টেরেমের পাশাপাশি তাদের ওপর দায় চাপাচ্ছে, যদিও খুব জোর দিয়ে জামায়াতকে মোকাবেলা করতে পারছে না! একে দীর্ঘদিনের সহচর, তার উপর এই দুই দলই ইন্টেরিমের খাস ‘সিপাহসালার’, তারও উপর বিএনপি জুলাই সনদের সকল পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন, বিয়োজন মানতে বাধ্য থাকবে বলে স্বাক্ষর করেছে।
📍
এই সংকট মোকাবেলা করতে করতেই সরকারের সামনে ‘অ্যাসিড টেস্ট’ হিসাবে সামনে আসছে আওয়ামী লীগের ১৩ নভেম্বরের ‘লকডাউন’। যা ১০ তারিখ থেকে শুরু হয়ে সারা দেশজুড়ে তাদের প্রতিবাদ সমাবেশ, গণসংযোগ, মিছিল দিয়ে শুরু হবে। ১৩ তারিখ রাজধানী ঢাকায় সর্বতভাবে ‘লকডাউন’ সফল করার জন্য জনগণের কাছে আহ্বান জানিয়েছে দলটি। জেলের বাইরে থাকা গুটি কয়েক নেতা এবং বিদেশে অবস্থানরত নেতাদের মাধ্যমেই তারা কর্মসূচি সফল করতে চায়।
📍
আওয়ামী লীগের এই ঘোষণার পরে সরকার একদিকে নিজেদের শক্তিমত্তা দেখানোর জন্য দমন-পীড়নের পথে হাঁটছে। সে লক্ষ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ গুপ্ত দলীয় ক্যাডার বা মিলিশিয়া বাহিনীকে মাঠে নামাবে। এক তরুণ উপদেষ্টা ঘোষিত সাড়ে আট হাজার সদস্যের মিলিশিয়া বাহিনীর কথা প্রকাশ করা হলেও বিভিন্ন সূত্র মতে তারা যা বলছে তার কয়েকগুন বেশি সদস্যের বাহিনী ইতোমধ্যে প্রস্তুত করেছে। গত পনের মাসে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকায় সরকার আতঙ্কিত। সেখানে ধস নামাতে ঐদিন নাশকতা ঘটিয়ে তার দায় আওয়ামী লীগের ওপর চাপানো হতে পারে। সেইসঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অ্যাকশন, গ্রেফতার, ছত্রভঙ্গকরণ তো আছেই।
📍
একই ইস্যুতে সরকারের পাশে থেকে রাজপথে সক্রিয় থাকার ঘোষণা বিএনপিও দিয়ে রেখেছে। জামায়াত-এনসিপি-অন্যান্য সরকারপন্থী দলের ক্যাডারাও আওয়ামী লীগকে ঠেকাতে একসঙ্গে কাজ করবে।
📍
একই সময়ে দেশের বাইরে থেকেও অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য ভালো খবর নেই। ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ট্যারিফ বিরোধের ফলে পাকিস্তান নিজেদেরকে যুক্তরাষ্ট্রের এই অঞ্চলে ‘একমাত্র’ মিত্র মনে করে বাংলাদেশকে ‘প্রক্সিওয়ারে’ টেনে নামানোর জন্য চেষ্টা করে আসছিল। গত ৩১ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্র-ভারত ১০ বছর মেয়াদী প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরের পরই এই অঞ্চলের বিশেষ করে বাংলাদেশকেন্দ্রীক জিওপলিটিক্সে র্যাডিক্যাল চেঞ্জ এসেছে।
📍
এর পর পরই একযোগে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম ‘রয়টার্স’, ‘এপি’, ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ ও ‘হিন্দুস্তান টাইমস’ ভারতে এক্সাইল প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার ছাপে। যা গত পনের মাসের দৃশ্যপটকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখার পথ দেখিয়ে দেয়।
📍
এর পর থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার ভয় পেতে শুরু করেছে। তারা যে ভয় পাচ্ছে সেটা গোপন থাকেনি। আওয়ামী লীগের ১০ থেকে ১৩ তারিখের কর্মসূচি ঘোষণার চ্যালেঞ্জ নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিঘ্ন সেটাও গোপন থাকেনি। তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে ওই কর্মসূচি মোকাবেলায় সরকারের সর্বশক্তি নিয়োগের হুমকি থেকে। সরকারের একাধিক দায়িত্বশীল ব্যক্তি ’১৩ তারিখের ‘লকডাউন’ নিয়ে চিন্তিত নয়’ বলে নিজেদের সাহস যোগাচ্ছে।
📍
৭ নভেম্বর প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা একসঙ্গে অনেকগুলো লক্ষ্যবস্তুতে ‘কামান’ দেগেছেন।
“মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ‘হিংসাত্মক এবং উগ্রপন্থী’ নীতি ভারতের সাথে বিরোধের জন্য দায়ী।”
আবার ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান বিরোধ যে ইউনূসের সরকারের সঙ্গে, সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন― “ভারত সর্বদা বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র ছিল এবং ছিল এবং বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি বজায় রাখতে হলে তা অবশ্যই থাকবে। যদি ভারত এবং ডঃ ইউনূসের অনির্বাচিত প্রশাসনের মধ্যে কোনও বিরোধ থাকে, তাহলে এর সাথে আমার কোনও সম্পর্ক নেই এবং ডঃ ইউনূসের শাসনামলে যে বিশৃঙ্খল, সহিংস ও চরমপন্থী নীতিমালা তৈরি হচ্ছে তার সাথে এর কোনও সম্পর্ক নেই। গত বছর আমাকে নিরাপদ আশ্রয় দেওয়ার জন্য আমি ভারতীয় জনগণের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞ।“
এরই ফলশ্রুতিতে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের এই কঠোর বার্তাটি এসেছে―”বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ চাই না, কিন্তু ইউনূস যেন কথা ভেবে বলেন। “
📍
দ্বিতীয়তঃ তিনি বলেছেন- “আমি স্পষ্টভাবে আমার বিরুদ্ধে আনা সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করছি। এই অভিযোগগুলো একটি ক্যাঙ্গারু কোর্টে আনা হয়েছে যা আমার রাজনৈতিক বিরোধীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, যারা অগণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা দখল করেছে। জনতার বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগের নির্দেশ বা নির্দেশ দেওয়ার দাবির সমর্থনে কোনও প্ররোচনামূলক প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি। আদালতে আনা অডিও রেকর্ডিং এবং ট্রান্সক্রিপ্টগুলি কারচুপি করা হয়েছে এবং প্রেক্ষাপট বর্হিভূত।“
এটা বলে তিনি কার্যত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাব্যুনালের কার্যক্রমকে বিদেশিদের সামনে হাজির করেছেন।
📍
তৃতীয়তঃ “দেশের প্রাচীনতম এবং সর্বাধিক জনপ্রিয় দলকে অংশগ্রহণ থেকে নিষিদ্ধ করা হলে গণতন্ত্রের কোন আশা থাকতে পারে না। এই নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের সংবিধান এবং বাংলাদেশের ১৭৩ মিলিয়ন মানুষের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারের লঙ্ঘন। এই নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকলে লক্ষ লক্ষ সাধারণ বাংলাদেশী ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন।“
এটি বলার পর থেকেই পশ্চিমা দেশগুলো অন্তর্ভূক্তিমূলক নির্বাচনের কথা জোরেশোরে বলা শুরু করেছে।
📍
চতুর্থতঃ “মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার আইসিসির মতো একটি নিরপেক্ষ, আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে করা উচিত। আওয়ামী লীগের সদস্য ও সমর্থক, বিচার বিভাগের সদস্য, সাংবাদিক এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের লক্ষ্য করে প্রতিশোধমূলক সহিংসতার বিষয়টি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হয়েছে এবং অসংখ্য মানবাধিকার সংস্থা এবং জাতিসংঘ কর্তৃক সমালোচিত হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। শত শত ব্যক্তিকে মিথ্যা অভিযোগে নির্বিচারে আটক রাখা হয়েছে এবং এর মধ্যে অনেকেই হেফাজতে মারা গেছেন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, ইউনূস প্রশাসনের ক্ষমতায় আসার প্রথম ১০০ দিনে আইনি ভিত্তি ছাড়াই হাজার হাজার মানুষের বিরুদ্ধে এক হাজার এরও বেশি পুলিশ মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এসব ঘটছে বর্তমানে ক্ষমতায় থাকা প্রশাসনের অধীনে। ইউনূস এবং তার সহযোগীরা এই নির্যাতন থেকে আন্তর্জাতিক মনোযোগ সরাতে আমার বিরুদ্ধে তাদের মিথ্যা মামলা ব্যবহার করছে। এজন্যই আমাদের আইসিসির মতো একটি ন্যায্য ও স্বাধীন বিচারিক সংস্থার হস্তক্ষেপ প্রয়োজন – বর্তমান নির্যাতনগুলি সনাক্ত ও যাচাই করার জন্য এবং ইউনূস শাসনকে জবাবদিহি করার জন্য।“
📍
শেখ হাসিনার এই সাক্ষাৎকার প্রকাশের পর পরই পশ্চিমা বিশ্বে কতগুলো সিগনিফিকেন্ট ঘটনা ঘটেছে। যুক্তরাজ্যের হাউস অব লডস-এর ৫ সদস্য ও ২ আইনজীবী ইউনূস সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘন, বাকস্বাধীনতা হরণ, সংখ্যালঘু নির্যাতন রুখতে ব্যর্থতা এবং ইনক্লুসিভ ইলেকশনের দাবীতে যুক্তরাজ্য সরকার, ইইউ ও জাতিসংঘ হিউম্যান রাইটস-এর কাছে পিটিশন করার পর বাংলাদেশের নির্বাচন, ট্রাইব্যুনাল ও সংখ্যালঘু সংকট নিয়ে হাউস অব লডস সদস্য অ্যালেক্স কার্লাইল উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
📍
পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, জাতিসংঘ থেকে সকল দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রী তার সরকারের অভিমত খোলাখুলি ব্যক্ত করে বলেছেন-“ভারত আশা করে বাংলাদেশে একটি অন্তর্ভূক্তিমূলক নির্বাচন হবে।”
📍
এসবের প্রেক্ষাপটে ১৩ তারিখে রাজধানী ঢাকায় ‘লকডাউন’ কর্মসূচি দিয়ে আওয়ামী লীগ সরাসরি ইউনূস সরকারের দিকে চ্যালঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। ১৩ তারিখের কর্মসূচি সফল-অসফল যা-ই হোক তাতে ইন্টেরিম সরকারের পতন হয়ত হবে না, কিন্তু সরকারের সামনে ইসলামিস্টদের ‘নির্বাচনের আগে গণভোট’, বিএনপির ‘আগে নির্বাচন পরে গণভোট’ চ্যালেঞ্জ দুটির পাশাপাশি আওয়ামী লীগের রাজপথে ঘুরে দাঁড়ানোর চ্যালেঞ্জও মোকাবেলা করতে হবে।
📍
একাধিক আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে গেলে হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে। বাহিনীগুলোর সদস্যদের মাথায় এই সরল বিবেচনাটি এসেছে যে, তাদের একটি নির্বাচিত সরকার রক্ষার জন্য বল প্রয়োগ করা যদি অন্যায় হয়, তাহলে একটি অনির্বাচিত সরকার রক্ষার জন্য বল প্রয়োগও কেন অন্যায় হবে না? ইতোমধ্যে এধরণের অভিমত সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েছে।
📍
এর বাইরে ‘প্রাইভেট মিলিশিয়া’ দিয়ে দমন করতে গেলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটি হয়ত সরকার এবং তাদের স্টেকহোল্ডাররা অনুমান করতে পারছেন না। ২০২৪-এর আগস্ট পরবর্তী আওয়ামী লীগ ছিল একা এবং বিচ্ছিন্ন। ২০২৫-এর নভেম্বরের আওামী লীগ বিচ্ছিন্ন নয়, তাদের সঙ্গে মিছিল বড় করছে গত পনের মাস ধরে নিপীড়িত সাধারণ মানুষ। আশাহত মানুষের মড়ার উপর খাড়ার ঘা হয়েছে দ্রব্যমূল্যের মারাত্মক ঊর্ধ্বগতি। নাভীশ্বাস উঠে যাওয়া মানুষের সামনে এখন দেশকে স্থিতিশীল করতে আওয়ামী লীগ একমাত্র বিকল্প হয়ে উঠেছে। ১৩ নভেম্বর সেসবেরই অ্যাসিড টেস্টই হতে চলেছে।
