ইস্তাম্বুলের সঙ্গে বিড়ালের সম্পর্ক বহু শতাব্দীর। ওসমানীয় আমলের সেই ‘বিড়াল রক্ষক’ থেকে শুরু করে আধুনিক সময়ের পথের ‘অভিভাবকদের’ সঙ্গে বিড়ালের রসায়ন যেন জন্মগতভাবেই তৈরি হয়ে আছে।
ইস্তাম্বুলের আঁকাবাঁকা গলি, মসজিদ, মেট্রো, ক্যাফেগুলোতে প্রতিদিনই দেখা যায় সূক্ষ্ম সামঞ্জস্য। দেড় কোটিরও বেশি মানুষ এখানে ঠাঁই পাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করে। বসফরাসের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এই শহর ইউরোপ ও এশিয়ার ঐতিহাসিক সংযোগস্থল। শহরটিতে মানুষ ও বিড়ালের সম্পর্ক বহু পুরোনো।
শহরটিতে প্রায় আড়াই লাখ পথ বিড়াল আছে। শহরটির ইতিহাস আর দৈনন্দিন জীবনে বিড়াল এমনভাবে জড়িত যে, রাস্তার প্রতিটি কোণে বিক্রি হওয়া কারুকাজ করা গালিচার মতোই এদের উপস্থিতিও খুবই সাধারণ ঘটনা। এটি প্রেম আর জীবনের অবিরাম মিউমিউ শব্দে ভরা এক সজীব নগরী।
‘City Cats of Istanbul’-এর আলোকচিত্রী মার্সেল হেইনেন বলেন, ‘ইস্তাম্বুলের বিড়ালরা মোটামুটি পোষা প্রাণীও নয়, আবার পুরোপুরি পথ বিড়ালও নয়, দুয়ের মাঝামাঝি এক পরিচয় এদের।’ তাঁর ভাষায়, শহরের এসব বিড়ালের নির্দিষ্ট কোনো মালিক নেই, বরং প্রতিটি এলাকার মানুষ মিলে তাদের যত্ন নেয়।
তিনি জানান, বিড়ালদের প্রতি এখানে যে সম্মান দেখা যায়, তা অন্য কোথাও দেখা কঠিন। ক্যাটস মিউজিয়াম ইস্তাম্বুলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ফাতিহ দাগলি বলেন, ‘প্রতিটি পৌরসভায় আলাদা ভেটেরিনারি বিভাগ আছে, তারা পথের প্রাণীদের চিকিৎসা করে, বিড়ালের জন্য বিনা মূল্যে সেবা দেয়। বেসরকারি ক্লিনিকগুলোও পথ বিড়ালের জন্য কম খরচ নেয়, আর বাসিন্দারা মিলে সেই বিল শোধও করে।’
এই ভালোবাসা নতুন কিছু নয়। হেইনেন বলেন, ‘ওসমানীয় আমলে পথ বিড়াল ছিল শহরের আদরণীয় বাসিন্দা। স্থানীয় ওয়াক্ফ প্রতিষ্ঠানগুলো এসব প্রাণীর দেখভাল করত। সেই সময়ই মানজাজি নামে পূর্ণকালীন এক পেশা তৈরি হয়—যাদের কাজ ছিল শহরের বিড়ালদের খাওয়ানো। মানুষ চাইলে মানজাজিদের কাছ থেকে খাবার কিনেও বিড়ালদের দিত।’
দাগলি সম্পর্কটিকে আরও প্রাচীন সময়ে খুঁজে পান। তাঁর ভাষায়, ‘ফিনিশীয় যুগ থেকেই নাবিকেরা জাহাজে ইঁদুর দমনে বিড়াল রাখত।’ রোমান যুগ থেকে ওসমানীয় সময় পর্যন্ত সিল্ক ও মসলাবাহী জাহাজ যখন ব্যস্ত ইস্তাম্বুল বন্দরে ভিড়ত, তখনই নানা প্রজাতির বিড়ালও শহরে এসে মিশে যেত।
আজও ইস্তাম্বুলের মানুষ ঘর-বাহির, মাটির ওপর-নিচ, সব জায়গাই আন্তরিকভাবে বিড়ালদের সঙ্গে উপভোগ করে। এ কারণেই পৃথিবীজুড়ে ইস্তাম্বুলের আরেক নাম ‘Catstanbul–ক্যাটসতাম্বুল।’ বহু পর্যটকও শুধুই বিড়ালের টানে এখানে ছুটে আসে।
এই উচ্ছ্বসিত ও কোলাহলময় শহরে সবচেয়ে শান্ত প্রাণী হলো পথের বিড়াল। গালাতা টাওয়ারে যাওয়ার পথে ক্লান্ত হয়ে কাঠের বেঞ্চে বসলে পাশে চুপচাপ বসে থাকা এক বিড়াল, কিংবা সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে শহরের ৩৬০ ডিগ্রি দৃশ্য দেখার সময় পাথরের দেওয়ালে এসে পাশে গা ঘেঁষা অন্য এক বিড়াল—সব মিলিয়ে তারা শহরের বিশৃঙ্খলার ভেতরে শান্তির নিশ্বাস দেয়।
অগণিত মানুষকে তারা একইভাবে কাছে টেনে নেয়। পৃথিবীর কোনো ভাষা বা সীমান্ত তাদের পথ আটকায় না। রাস্তার জন্য সংগ্রাম করে বেঁচে থাকা এই প্রাণীগুলোও দয়া পাওয়ার যোগ্য। হেইনেন বলেন, যখন একটি ইস্তাম্বুলি বিড়াল আপনার হাঁটুর ওপর ঘুমিয়ে পড়বে, আর চারদিকে ভেসে আসবে কাবাব, জাফরান, ভাজা ভুট্টা ও টাটকা ম্যাকারেলের গন্ধ, তখনই শহরটি একটু নরম হয়ে আসে, ব্যস্ততা একটুখানি মোলায়েম হয়।
শহরকে সাধারণত কোমল বলা হয় না। বিশাল পথ, সেতু, কংক্রিট, কাচ আর ইস্পাতের নির্মাণ শহর তৈরি হয় মানুষের জন্য। হেইনেন বলেন, ‘এত কঠিন কাঠামোর ভেতর অন্য এক জীবের নিজের জায়গা দাবি করা বিস্ময়কর। আর স্থানীয় মানুষের সেই প্রাণীদের প্রতি যত্ন দেখা আরও বিস্ময়কর।’
পৃথিবীর অনেক শহরে পথের প্রাণীদের জীবন খুব কঠিন। কিন্তু ইস্তাম্বুলে তারা যেন ঘরের সদস্য। ফাতিহ এলাকায় হেঁটে ব্লু মসজিদ বা হায়া সোফিয়া দেখতে গেলে চোখে পড়বে সুলো নামের বিড়ালকে। ধূসর-সাদা মোটা টবি বিড়ালটি সুলতানআহমেত স্কোয়ারে পর্যটকদের সঙ্গে ছবি তোলে, আর তার পাশে থাকে সেই সংবাদপত্র বিক্রেতা, যিনি সুলোর যত্ন নেন।
পাহাড়ি এলাকা থেকে বসফরাস পাড়ের পাথর সিঁড়ি—সবখানেই বেঞ্চে গা এলিয়ে বা কাঠের ফ্রেম ঘরে শুয়ে দুপুরের ঘুমে মগ্ন থাকে বিড়ালরা। বাজারের সামনে, মেট্রো স্টেশনের বাইরে রাখা পানির বাটি আর শুকনো খাবার, আর ক্যাফেতে মানুষজনের ভাগ করে দেওয়া খাবার—বিড়ালরা সবখানেই অদ্ভুত স্বাচ্ছন্দ্যে।
অনেক দোকান বিড়াল পুষে রাখে, এতে ক্রেতারাও খুশি হয়ে ভেতরে ঢোকে। আরও বহু দোকান বাইরে খাবার-পানির বাটি রাখে, যেন প্রতিদিনের যাতায়াতের মধ্যে পথ বিড়ালও তাদের নিয়মিত অতিথি। হেইনেন বলেন, ‘মানুষ ও বিড়ালের সহাবস্থানের শুরু হয়েছিল এখানেই। ওসমানীয় আমলে বিড়াল ছিল ব্যবহারিক প্রয়োজন—গুদামে খাদ্য রক্ষার জন্য।’
আজ সেই কাজ বদলে গেছে। বিড়ালরা পরিণত হয়েছে শহরের অনানুষ্ঠানিক পর্যটক দূত হিসেবে। কঠিন, ব্যস্ত শহরটিকে তারা নরম আভাস দেয়। ভ্রমণকারীর পায়ের কাছে এসে দাঁড়ানো বা হঠাৎ ছবিতে ঢুকে পড়া সেই মুখ, লোমশ পা আর মৃদু গরগর ধ্বনি—সবই আপনাকে দীর্ঘদিন ধরে ইস্তাম্বুলের কথা মনে করিয়ে দেবে। মনে করিয়ে দেবে, একসঙ্গে থাকা, খাবার ভাগ করা আর জীবন ভাগ করে নেওয়া আসলে কত সহজ হতে পারে, ঘরে হোক বা দূর দেশে। তথ্যসূত্র: বিবিসি
