চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যকারিতা ও আধুনিকায়ন নিয়ে সাম্প্রতিক আলোচনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ তর্ক ঘনীভূত হচ্ছে—বিদেশি গ্লোবাল অপারেটর নিয়োগ করলেই কি বন্দর সমস্যার সমাধান হবে? আন্তর্জাতিকভাবে সফল কিছু বন্দর যেমন সিঙ্গাপুর, কলম্বো বা কাই মেপ-এর উদাহরণ তুলে ধরে বলা হচ্ছে, বিদেশি অপারেটররাই দক্ষতার নিশ্চয়তা দিতে পারে। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরের সীমাবদ্ধতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে সমস্যাগুলোর উৎস কাঠামোগত, ভৌগোলিক ও ব্যবস্থাপনাগত—যা শুধু অপারেটর পরিবর্তন করে সমাধান করার মতো নয়।
চট্টগ্রাম বন্দরের নাব্যতা সংকট এর অবস্থানগত কারণে দীর্ঘদিনের সমস্যা। চ্যানেলে পলি জমা হওয়ার ফলে নিয়মিত ড্রেজিং করেও জোয়ারের সময় সর্বোচ্চ সাড়ে নয় মিটার গভীরতা নিশ্চিত করা যায়, ভাটায় তা কমে ছয় থেকে সাত মিটারে নেমে আসে। ফলে বড় আকারের জাহাজ বন্দরে ঢুকতে পারে না।
অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক মানের আধুনিক বন্দরগুলোতে ১৬ থেকে ১৮ মিটার গভীরতার ড্রাফট নিশ্চিত থাকে, যার তুলনায় চট্টগ্রাম স্বভাবতই পিছিয়ে। সঙ্গে রয়েছে কাস্টমস প্রক্রিয়ার জটিলতা, দেশের অর্থনৈতিক কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে দুর্বল রেল–সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং পর্যাপ্ত ইয়ার্ড ও জেটির অভাব। এসব কারণে চট্টগ্রাম বন্দরের সার্বিক কর্মদক্ষতা কাঙ্ক্ষিত মানে পৌঁছাতে পারছে না।
বন্দর সর্বোচ্চ ড্রাফট
সিঙ্গাপুর ১৬ মিটার
কলম্বো ১৮ মিটার
কাই মেপ (ভিয়েতনাম) ১৬–১৮ মিটার
সায়গন ১১.৫ মিটার
চট্টগ্রাম ৯–৯.৫ মিটার (শুধু জোয়ারে)
প্রশ্ন হলো—বিদেশি অপারেটর কি এই ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা বা কাস্টমস সংস্কার কিংবা জাতীয় পর্যায়ের অবকাঠামোগত সংযোগ উন্নয়ন করতে পারবে? উত্তর স্পষ্ট—না। তাই বিদেশি অপারেটর নিয়োগকে ‘ম্যাজিক সমাধান’ হিসেবে তুলে ধরা বাস্তবসম্মত নয়।
এই প্রেক্ষাপটে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে এসেছে—লালদিয়া টার্মিনাল ৪৮ বছরের জন্য ডেনমার্কের এপিএম টার্মিনালসকে ইজারা দেওয়া এবং এই চুক্তির আর্থিক কাঠামো ও গোপনীয়তা নিয়ে ওঠা প্রশ্ন। তিন বছরে ৬,৭০০ কোটি টাকার বিনিয়োগের বিনিময়ে বাংলাদেশ ৪৫ বছর ধরে মাশুল আদায়ের সুযোগ দেবে অপারেটরকে। অথচ এই বিনিয়োগ বাংলাদেশ নিজেই করতে পারত, সেক্ষেত্রে আয়ও থাকত পুরোপুরি দেশের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৬,৭০০ কোটি টাকার প্রকল্প বাংলাদেশ সহজেই সরকারি বা যৌথ উৎস থেকে বিনিয়োগ করতে সক্ষম ছিল। সেক্ষেত্রে—
মাশুলের পুরো আয় রাষ্ট্রের হতো
দীর্ঘমেয়াদে বন্দর সম্পদ জাতীয় নিয়ন্ত্রণে থাকত
কৌশলগত সম্পদের নিরাপত্তা বজায় থাকত
কিন্তু সবচেয়ে বড় উদ্বেগ হচ্ছে—ইজারা চুক্তির মাশুল ভাগাভাগির সুনির্দিষ্ট হার এবং ভবিষ্যতে মাশুল বাড়ানোর শর্তাবলি জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। নির্বাচন-পূর্ব সময়ের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের এমন একটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি স্বাক্ষর করা নীতি-নৈতিকতা ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থের দিক থেকে বিতর্ক তৈরি করেছে।
আশঙ্কা এখানেই থেমে নেই। পূর্ববর্তী আদানি চুক্তির অভিজ্ঞতা স্মরণ করিয়ে অনেকেই বলছেন—যদি এই চুক্তিতেও বাতিলের অপশন অনুকূল না হয়, কিংবা এমন শর্ত রাখা থাকে যা অপারেটরের মুনাফাকে অগ্রাধিকার দেয়, তখন রাষ্ট্রের জন্য পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের সুপারিশে ইতোমধ্যেই বন্দর মাশুল ৪০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে, যা আমদানি ব্যয় ও রপ্তানি প্রতিযোগিতা—উভয় ক্ষেত্রেই প্রতিকূল প্রভাব ফেলতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি ইজারা যে কেবল অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক ও কৌশলগতভাবেও গুরুতর সিদ্ধান্ত—তা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার দাবি করেছে যে তারা জিটুজি পদ্ধতিতে যথাযথ নিয়ম মেনে চুক্তি সম্পন্ন করছে। কিন্তু প্রাপ্ত তথ্য বলছে—গণতান্ত্রিক oversight বা জাতীয় স্বার্থ রক্ষার যে মানসমূহ এমন গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিতে অনুসরণ করা উচিত, সেগুলো পূরণ হয়নি।
অভিযোগ রয়েছে, সাপ্তাহিক ছুটির দিনে তড়িঘড়ি করে একই দিনে দুটি টার্মিনালের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়েছে। মূল্যায়ন কমিটির অধিকাংশ সদস্যকে সিদ্ধান্তের আগেই অবহিত করা হয়নি।
জটিল পিপিপি কনসেশন চুক্তি পর্যালোচনার জন্য প্রয়োজনীয় পূর্ণাঙ্গ টিম মিটিং হয়নি। বন্দর ব্যবহারকারী সংগঠনগুলোকে পুরো প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখা হয়েছে। এমনকি নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কাগজপত্র পাঠানো হয়েছে এমন দ্রুততায়, যা স্বাভাবিক প্রশাসনিক পদ্ধতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
বহুজাতিক অপারেটরকে কৌশলগত বন্দর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দিলে এর সম্ভাব্য ঝুঁকি কী হতে পারে—তার একটি বাস্তব উদাহরণ হলো পূর্ব আফ্রিকার দেশ জিবুতির ঘটনাটি। সেখানে ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে একটি ৩০ বছরের কনসেশন চুক্তি সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়; অপারেটর সংখ্যালঘু শেয়ারধারী হয়েও বোর্ড নিয়ন্ত্রণ করে এবং জিবুতিকে অন্য বন্দর উন্নয়ন থেকে বিরত রাখতে শর্ত দেয়।
পরিস্থিতি এত জটিল হয়েছিল যে চুক্তি বাতিল করতে গিয়ে জিবুতিকে আন্তর্জাতিক আদালতে ৫৩৩ মিলিয়ন ডলার জরিমানা দিতে হয়েছে। মূল শিক্ষা পরিষ্কার—কৌশলগত বন্দর অবকাঠামোতে বিদেশি কোম্পানি নিয়ন্ত্রণ পেলে আইনগত, আর্থিক ও ভূরাজনৈতিক অঙ্গনে এমন ঝুঁকি তৈরি হয়, যা দীর্ঘমেয়াদা জাতীয় স্বার্থকে বিপন্ন করতে পারে।
এই অভিজ্ঞতা বাংলাদেশকেও সতর্ক করে। নির্বাচিত সংসদের আলোচনার মাধ্যমে, জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে—এমন দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত। কয়েক মাস পরেই নির্বাচন; এমন সময় অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকারের দ্রুততা ও অস্বচ্ছতার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিতে স্বাক্ষর প্রশ্ন তোলে নীতি, দায়বদ্ধতা এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা—সব ক্ষেত্রেই।
চট্টগ্রাম বন্দর সংস্কার অবশ্যই প্রয়োজন, কিন্তু সেই সংস্কার ভৌগোলিক বাস্তবতা, অবকাঠামো উন্নয়ন, কাস্টমস আধুনিকায়ন, বন্দর–অর্থনৈতিক হাব কানেক্টিভিটি এবং দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় কৌশলগত স্বার্থ বিবেচনা করে করতে হবে। বিদেশি অপারেটর হতে পারে একটি উপাদান, কিন্তু তা কখনোই সার্বিক সমাধান নয়। সমাধান হলো রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা, স্বচ্ছতা, সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং নীতিগত ধারাবাহিকতা।
বাংলাদেশের বন্দর নীতি কেবল অর্থনৈতিক হিসাবের বিষয় নয়—এটি সার্বভৌমত্ব, কৌশলগত অবস্থান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তার প্রশ্ন। তাই যেকোনো চুক্তি হওয়া উচিত সম্পূর্ণ তথ্য প্রকাশ, জনআলোচনা এবং গণতান্ত্রিক জবাবদিহির মাধ্যমে। গোপনীয়তা ও তড়িঘড়ি কোনোভাবেই এমন জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্তের বৈধ ভিত্তি হতে পারে না।
