লোক- আধ্যাত্মিকতাকে ‘সফট শরিয়া’র শিকলে বেঁধে ফেলার নতুন অধ্যায়
যে দেশে একদিন রবীন্দ্রনাথের “আমার সোনার বাংলা” গাওয়া হতো স্কুলের পিটি-প্যারেডে, ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সেই দেশের স্কুলগুলো থেকে এখন গান-বাজনা প্রায় উঠেই যাচ্ছে। “ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত” লাগে, এই একটি যুক্তিতে বাদ্যযন্ত্র বাজানো বন্ধ, সঙ্গীত শিক্ষকদের চাকরি অনিশ্চিত, ছাত্রীদের নাচ-গানের অনুষ্ঠানে হরেক রকমের বাহানা প্রতিবান্ধকতা। এবার সেই একই অস্ত্র উঠল বাংলার হাজার বছরের লোক-আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য বাউল গানের বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশ বাউল সমিতির সভাপতি, প্রখ্যাত বাউল শিল্পী আবুল সরকারকে (ছোট আবুল সরকার) গতকাল ভোরে একটি গানের আসর থেকে তুলে নিয়ে যায় ডিবি পুলিশ। তিনি গত ৪ঠা নভেম্বর মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জাবরা খালা পাগলীর মেলায় গান গাইতে গিয়ে “আল্লাহর সৃষ্টির আগা-মাথা নেই” বলে ইসলাম অবমাননা করেছেন, এমন অভিযোগ করেছেন স্থানীয় এক মুফতি, আর তার সাথে তাল মিলিয়ে উগ্রবাদীরা একে ভাইরাল ইস্যুতে পরিণত করেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার তাকে আদালতে হাজির করা হলে বিচারক কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। বাউল সম্প্রদায়ের শত শত শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মী এই গ্রেপ্তারকে “লোক-আধ্যাত্মিকতার গলায় ফাঁস” বলে আখ্যায়িত করছেন। তাদের যুক্তি: বাউল গান কখনো কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বিরোধী নয়; এটি মানবতা, প্রেম ও স্রষ্টার সঙ্গে সরাসরি সংলাপের পথ।
প্রখ্যাত বাউল শিল্পী আবুল সরকার
লালন বলেছিলেন, “সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে”; আজ সেই লালনের উত্তরসূরিকে জেলে পাঠানো হচ্ছে “জাত” নির্ধারণের নামে। গত এক দশকে বাংলাদেশে “ধর্ম অবমাননা”র অভিযোগে যত মামলা হয়েছে, তার বেশিরভাগই ব্যবহৃত হয়েছে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড দমনের হাতিয়ার হিসেবে।
স্কুল-কলেজে সঙ্গীত শিক্ষা কার্যত নিষিদ্ধ, বইমেলায় ব্লগার-লেখকদের উপর হামলা, থিয়েটার-সিনেমায় সেন্সরের খাঁড়া, এমনকি পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রাকেও “শিরক” বলে ফতোয়া দেওয়া হয়েছে। এবারের বাউল গ্রেফতার তারই চূড়ান্ত পরিণতি।
সংস্কৃতিকর্মীরা বলছেন, এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটা একটা পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া, যার নাম দেওয়া যায় “সফট শরিয়া”: আইনের ছদ্মবেশে, জনমতের চাপে, রাষ্ট্রীয় নিষ্ক্রিয়তার মাধ্যমে ধীরে ধীরে সব বহুত্ববাদী সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি স্তব্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।
বাউল শিল্পী মতিউর রহমান বললেন, “যেদিন লালনের গান গাইতে গেলে জেলে যেতে হয়, সেদিন বাংলাদেশ আর শুধু ভূগোলে বাংলাদেশ থাকে না, মনেও থাকে না।”
প্রশ্ন হলো, পরবর্তী পালা কার?
যে দেশে স্রষ্টার সঙ্গে প্রেমের কথা বলাও অপরাধ, সেখানে মানুষের সঙ্গে প্রেমের কথা বলার সাহস ক’জন রাখবে?
