মুনজের আহমদ চৌধুরী
অভিবাসন কাঠামোতে আমূল পরিবর্তন আনলো ব্রিটিশ সরকার। দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাবানা মাহমুদ শুক্রবার (২১ নভেম্বর) ‘আর্নড সেটলমেন্ট’ বা ‘অর্জিত আবাসন’ নামে একটি তিন স্তরবিশিষ্ট আইনি কাঠামো উন্মোচন করেছেন। নতুন এই ব্যবস্থায় যুক্তরাজ্যে স্থায়ীভাবে বসবাসের অধিকারকে সরাসরি আর্থিক সচ্ছলতার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে হাজার হাজার অভিবাসীর জন্য প্রচলিত পাঁচ বছরে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ কার্যত বিলুপ্ত করা হলো। এর পরিবর্তে ধনীদের জন্য তৈরি করা হয়েছে দ্রুততম পথ বা ‘ফাস্ট ট্র্যাক’, আর স্বল্প আয়ের অপরিহার্য কর্মীদের ঠেলে দেওয়া হয়েছে ১৫ বছরের দীর্ঘ অনিশ্চয়তার দিকে।
পাঁচ বছরের রেওয়াজের অবসান
কয়েক দশক ধরে অভিবাসীদের জন্য ব্রিটেনে স্থায়ীভাবে বসবাসের ক্ষেত্রে ‘পাঁচ বছর বসবাস’ ছিল একটি অলিখিত মানদণ্ড। কিন্তু নতুন ঘোষিত ‘হোয়াইট পেপার’ সেই দীর্ঘদিনের নজির ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। নতুন ‘আর্নড সেটলমেন্ট’ মডেলে সরকার এমন একটি স্তরভিত্তিক ব্যবস্থা চালু করেছে যেখানে সময় আর মূল নিয়ামক নয়, বরং অর্থই এখন মুখ্য। এই কাঠামোর একেবারে শীর্ষে রয়েছে নতুন ‘ফাস্ট ট্র্যাক’ রুট, যাকে হোম অফিস ‘সবচেয়ে মেধাবী ও সেরাদের’ বিশেষ সুবিধা হিসেবে অভিহিত করেছে।
দেশটির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো, নির্বাচিত কিছু অভিবাসী মাত্র তিন বছর বসবাস করলেই স্থায়ী বসবাসের আবেদন করতে পারবেন, যা আগের সময়ের চেয়ে প্রায় চল্লিশ শতাংশ কম। তবে এই বিশেষ সুবিধা পাওয়ার চাবিকাঠি কঠোরভাবে আয়ের ওপর নির্ভরশীল। কেবল যাদের বার্ষিক আয় সর্বোচ্চ কর সীমার ওপরে—অর্থাৎ বছরে প্রায় এক লাখ ২৫ হাজার পাউন্ড এবং যারা গ্লোবাল ট্যালেন্ট ও ইনোভেটর ফাউন্ডার ভিসাধারী, তারাই কেবল এই সুযোগ পাবেন।
এই নীতির মাধ্যমে সরকার স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে যে দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক অন্তর্ভুক্তির চেয়ে তারা তাৎক্ষণিক আর্থিক অবদানকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে এবং ইউরোপের মধ্যে ধনীদের নাগরিকত্ব পাওয়ার পথটি সবচেয়ে সহজ করে দিচ্ছে।
‘স্ট্যান্ডার্ড রুট’ এখন আর সবার জন্য নয়
অভিজাত বা ধনীদের স্তরের ঠিক নিচেই রয়েছে ‘স্ট্যান্ডার্ড রুট’ বা সাধারণ পথ। এটি মূলত আগের পাঁচ বছরের সময়সীমাটিই বজায় রেখেছে, তবে এই সুবিধা এখন খুব অল্প সংখ্যক সংরক্ষিত গোষ্ঠীর জন্য সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। কঠোর নতুন নিয়ম থেকে এনএইচএস-এর ডাক্তার এবং নার্সদের বাদ রাখা হয়েছে, যা প্রমাণ করে যে দেশটির স্বাস্থ্যসেবা খাত আন্তর্জাতিক কর্মীদের ওপর কতটা নির্ভরশীল। একইভাবে, ব্রিটিশ নাগরিকদের স্বামী/স্ত্রী এবং হংকং বিএন(ও) স্কিমের আওতায় আগতরা পাঁচ বছর পরই স্থায়ী হওয়ার সুযোগ পাবেন। দক্ষ সরকারি খাতের কর্মীরাও এই সুবিধার আওতায় থাকবেন। বিশাল আইনি পরিবর্তনের সাগরে এই অংশটুকুই কেবল কিছুটা স্থিতিশীলতা বজায় রেখেছে।
কেয়ার ওয়ার্কারদের জন্য ১৫ বছরের দীর্ঘ অপেক্ষা
নতুন ঘোষণার সবচেয়ে বিতর্কিত অংশটি হলো ‘লং পাথ’। এটি স্বল্প আয়ের অভিবাসীদের কয়েক দশক ধরে অস্থায়ী বসবাসের ফাঁদে আটকে রাখবে। ইউনিয়নগুলোর তীব্র নিন্দা সত্ত্বেও, সরকার স্বল্প আয়ের অভিবাসী, বিশেষ করে নার্সিং হোমগুলোতে কর্মী সংকট মেটাতে নিয়োগ দেওয়া হাজার হাজার হেলথ অ্যান্ড কেয়ার ভিসাধারীদের স্থায়ী বসবাসের জন্য এখন ১৫ বছর অপেক্ষার বিধান চালু করেছে।
এই নীতি এনএইচএস-এর কর্মী বাহিনীর মধ্যে এক স্পষ্ট বিভাজন তৈরি করেছে। যেখানে ডাক্তাররা পাঁচ বছরে স্থায়ী হতে পারবেন, সেখানে তাদের সঙ্গে কাজ করা কেয়ার অ্যাসিস্ট্যান্টদের অপেক্ষা করতে হবে তিনগুণ বেশি সময়। যারা কঠিন সময়ের মুখোমুখি হবেন, তাদের জন্য এই সময়সীমা আরও দীর্ঘ। যেসব অভিবাসী ১২ মাসের বেশি সময় ধরে সরকারি সুযোগ-সুবিধা বা বেনিফিটের ওপর নির্ভরশীল থাকবেন, তাদের স্থায়ী হতে অপেক্ষা করতে হবে ২০ বছর।
আর চরম ক্ষেত্রে, ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া (ওভারস্টেয়ার) বা যুক্তরাজ্যে থাকার বৈধ অধিকার হারানো ব্যক্তিদের জন্য ৩০ বছরের একটি পথ তৈরি করা হয়েছে—যা কার্যত একটি পুরো প্রজন্মের জন্য স্থায়ী হওয়ার সুযোগ বন্ধ করে দেওয়ার শামিল।
অব্যাহতি এবং আইনি লড়াইয়ের আভাস
সংস্কারের ব্যাপকতা সত্ত্বেও হোম অফিস নিশ্চিত করেছে যে ব্রেক্সিট চুক্তি দ্বারা সুরক্ষিত ইইউ এবং ইইএ নাগরিকরা এই স্তরভিত্তিক কাঠামোর আওতামুক্ত থাকবেন। তাদের স্থায়ী হওয়ার অধিকার আগের মতোই ‘ইইউ সেটলমেন্ট স্কিম’ দ্বারা পরিচালিত হবে, যাতে তারা পূর্ববর্তী কোনও ভুলের জন্য নতুন করে শাস্তির মুখে না পড়েন। তবে, ইউরোপের বাইরের অভিবাসীদের জন্য পুরনো নিয়মে আবেদন করার সুযোগ দ্রুতই শেষ হয়ে আসছে।
ধারণা করা হচ্ছে, এই ঘোষণা অবিলম্বে বড় ধরনের আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। বিশেষ করে, যেসব কেয়ার ওয়ার্কার ভিন্ন শর্তে ও কম সময়ের আশায় এদেশে এসেছিলেন, তাদের ওপর ব্যাকডেট থেকে এই ১৫ বছরের নিয়ম প্রয়োগ করা নিয়ে আদালতে প্রশ্ন উঠবে। পার্লামেন্টে এই আইন নিয়ে বিতর্কের প্রস্তুতি চলছে। তবে এটি স্পষ্ট যে যুক্তরাজ্য তার অভিবাসন নীতিকে যেভাবে ঢেলে সাজাচ্ছে, তা ধনীদের জন্য দ্রুততম, সংরক্ষিতদের জন্য সাধারণ, আর বাকিদের জন্য স্থায়ী বসবাসের স্বপ্ন এখন অনেক দূরের পথে পরিণত হবে।
