মানিকগঞ্জের ঘিওরে একটা মেলায় গান গেয়েছিলেন বাউল শিল্পী আবুল সরকার। তিন সপ্তাহ পরে হঠাৎ মামলা, গ্রেফতার, জেলে পাঠানো। অভিযোগ : ধর্ম অবমাননা। অভিযোগের ব্যাপারে স্পষ্টতার দরকারও নেই অবশ্য বাংলাদেশে। ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তোলাটাই যথেষ্ট। প্রমাণ? সেটা তো বিলাসিতা। একজন মসজিদের ইমাম মামলা করলেন, পুলিশ ধরে আনলো, আদালত জেলে পাঠালো। কাজ শেষ।
এটা একটা বৃহৎ পরিকল্পনার অংশ। জুলাইয়ে যে রক্তাক্ত ক্যু ঘটিয়ে একটা নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে, তার পরবর্তী ধাপ এটা। সেই ক্যুতে কাজ করেছে তিনটা উপাদান – বিদেশি অর্থায়ন, ইসলামি জঙ্গি সংগঠনের মাঠপর্যায়ের সহিংসতা, এবং সামরিক বাহিনীর নীরব সম্মতি। কোটা সংস্কার আন্দোলনের আড়ালে হাজার হাজার তরুণকে রাস্তায় নামানো হলো, তারপর সেই আন্দোলনে জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা ঢুকে সহিংসতা ছড়ালো। পুলিশের উপর হামলা, সরকারি ভবনে আগুন – পুরোটাই পরিকল্পিত। শেষে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা তুলে দিলো মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে, যে লোকটার একমাত্র যোগ্যতা হলো পশ্চিমাদের পছন্দের মানুষ হওয়া আর দরিদ্রদের কাছ থেকে চক্রবৃদ্ধি সুদে টাকা আদায়ে দক্ষতা।
ইউনূসকে সামনে রাখা হয়েছে মুখোশ হিসেবে। আসল ক্ষমতা এখন জামায়াতে ইসলামী আর তাদের ওহাবি মতাদর্শের অনুসারীদের হাতে। তাদের উপদেষ্টা পরিষদে বসে আছে কারা? জামায়াতের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থকরা, হেফাজতের সহানুভূতিশীলরা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাতিল চাওয়া লোকজন। এদের কাছ থেকে বাউল শিল্পীদের সুরক্ষা আশা করা মূর্খতা।
বাউল শিল্পীরা কেন এদের টার্গেট? কারণ বাউল দর্শন ওহাবি মতবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত। বাউলরা বলে, খোদা মানুষের ভেতরে। মসজিদ-মন্দিরের চেয়ে মানুষের হৃদয় বড়। লালন ফকির বলেছিলেন, “মসজিদ ভাঙলে আল্লা কি কাঁদে, মানুষ ভাঙলে কেউ নাই।” এই দর্শন ওহাবিদের কাছে বিপজ্জনক। কারণ ওহাবিবাদের ভিত্তি হলো কঠোর নিয়ন্ত্রণ, ধর্মীয় পুলিশিং, বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠানের কঠোরতা। বাউলরা বলে ধর্ম মানে আত্মার মুক্তি, ওহাবিরা বলে ধর্ম মানে শৃঙ্খলা। দুটো একসাথে চলতে পারে না।
জামায়াতের কাছে বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি পুরোটাই শিরক, বিদআত, হারাম। পহেলা বৈশাখ? হিন্দুয়ানি। বাউল গান? ইসলাম বিকৃতি। রবীন্দ্রনাথ? কাফের কবি। নজরুল? মুসলমান বলে কোনোমতে গ্রহণযোগ্য, কিন্তু তার অনেক লেখাই আপত্তিজনক। এই মানসিকতার লোকেরা এখন দেশ চালাচ্ছে। এদের কাছে বাংলার হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য কোনো মূল্য রাখে না। তারা চায় একটা ধর্মীয় রাষ্ট্র, যেখানে শিল্প-সংস্কৃতি-চিন্তার স্বাধীনতা সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হবে ধর্মীয় আইন দিয়ে। তারা বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বানাতে চায়, যেখানে তালেবান সংগীত নিষিদ্ধ করেছে, নারীদের ঘরে বন্দী করেছে, শিক্ষা সীমিত করেছে মাদ্রাসায়।
এই অঞ্চলে ইসলাম এসেছিল সুফি সাধকদের মাধ্যমে, তলোয়ারের জোরে নয়। খাজা মইনুদ্দিন চিশতি, শাহজালাল, খান জাহান আলী – এরা প্রচার করেছেন ভালোবাসার ইসলাম, সহনশীলতার ইসলাম। বাউলরা সেই ঐতিহ্যের ধারক। লালন শাহ, হাসন রাজা, রাধারমণ দত্ত, পাগলা কানাই – এরা বাংলার মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন তাদের উদার মানবিক দর্শন দিয়ে, ধর্মের বাহ্যিক আচারের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখার শিক্ষা দিয়ে।
কিন্তু এখন যে ইসলাম চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সেটা সৌদি মরুভূমি থেকে আমদানি করা ওহাবিবাদ। এই মতবাদ বাংলার মাটি, পানি, মানুষের সাথে খাপ খায় না। কিন্তু তেলের ডলার আর সাম্প্রতিক বিদেশি ষড়যন্ত্রের টাকায় এই মতবাদ এখন জোর করে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। ধর্মীয় অনুভূতি রক্ষার নামে যা হচ্ছে, তা আসলে একটা নির্দিষ্ট মতাদর্শের একচেটিয়া আধিপত্য কায়েম করার চেষ্টা। বাংলাদেশের ইসলাম সবসময় উদার, সহনশীল ছিল। সুফি-দরবেশরা এখানে যে ইসলাম শিখিয়েছেন, তা ছিল ভালোবাসার, মানবতার, সহাবস্থানের। কিন্তু এখন যা চাপানো হচ্ছে, তা বিদেশি, আমদানিকৃত, কঠোর ও কল্পিত – এই মাটির সাথে, এই মানুষের সাথে, এই সংস্কৃতির সাথে যার কোনো সম্পর্ক নেই।
যারা মনে করে ধর্ম রক্ষা করছে, তারা আসলে ধর্মের মূল শিক্ষাকেই বিকৃত করছে। ধর্ম মানুষকে মুক্তি দেয়, শান্তি দেয়, মানবিক করে। কিন্তু এই মৌলবাদী ব্যাখ্যা মানুষকে সংকীর্ণ, অসহিষ্ণু, হিংস্র করে তুলছে। একজন বাউল শিল্পী যখন গান গায়, তিনি ঈশ্বরের সন্ধান করেন, মানুষের ভেতরে সৃষ্টিকর্তার উপস্থিতি খোঁজেন। এতে ধর্মের অবমাননা কোথায়? কিন্তু যাদের কাছে ইসলাম মানে শুধু বাহ্যিক আচার, যাদের কাছে ঈমান মানে অন্ধ আনুগত্য, তারা এই গভীর আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান বুঝবে কীভাবে?
ইউনূসের শাসনামলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর হামলা হয়েছে অসংখ্য। খ্রীষ্টান-হিন্দু বাড়িতে আগুন, চার্চ,-মন্দির ভাঙচুর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট নিয়মিত ঘটনা হয়ে গেছে এসব। কিন্তু ধর্মীয় অনুভূতির রক্ষক সেজে যারা বাউল শিল্পীদের জেলে পাঠায়, খ্রীষ্টান-হিন্দুদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগলে তারা কোথায় থাকে? উত্তরড়া জলের মতো পরিষ্কার – ধর্মীয় অনুভূতি তাদের কাছে শুধু হাতিয়ার, যা ব্যবহার করা হয় নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় আর ভিন্নমত দমনে। প্রকৃত ধর্মবোধের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
এই সরকারের কোনো বৈধতা নেই। এটা ভোটে আসেনি, সংবিধান মেনে গঠিত হয়নি। এটা একটা জগাখিচুড়ি ব্যবস্থা, যেখানে আশি বছরের এক ঘাটের মরা বুড়ো বসে আছে ক্ষমতার চূড়ায়, আর তার চারপাশে একদল উপদেষ্টা যাদের কোনো রাজনৈতিক ভিত্তি নেই, জনগণের কাছে কোনো দায়বদ্ধতা নেই। পুরো কাঠামো টিকে আছে সামরিক বাহিনীর নীরব সমর্থনে। এটা একটা হাইব্রিড স্বৈরতন্ত্র, যেখানে সামরিক শাসন আর ধর্মীয় মৌলবাদের অপবিত্র মিলন ঘটেছে।
বাউল শিল্পীরা, লোকসংগীত শিল্পীরা, যারা বাংলার প্রাণ বহন করে, তারা এখন নিরাপদ নয়। কারণ যারা ক্ষমতায়, তাদের কাছে বাংলার কোনো মূল্য নেই। যে দেশে একসময় পহেলা বৈশাখে লাখো মানুষ রাজপথে উৎসবে নামতো, বাউল গানের আসরে মানুষের ঢল নামত, সেই দেশে এখন বাউল শিল্পীদের জেলে পাঠানো হচ্ছে। যে দেশ গর্ব করত তার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য নিয়ে, সেই দেশে এখন সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন চলছে নিয়মিত। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষদের বাড়িঘর, ব্যবসা, উপাসনালয় আক্রান্ত হচ্ছে, কিন্তু কোনো প্রতিকার নেই। তখন এসব জঙ্গি মানসিকতার লোকদের কাছে ধর্মীয় অনুভূতির কোনো মূল্য থাকে না।
তিন সপ্তাহ পরে হঠাৎ মামলা করার পেছনে উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার। কোন শক্তি এখন এতটা সাহসী যে ইচ্ছেমতো শিল্পীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে, গ্রেফতার করাতে পারে, জেলে পাঠাতে পারে? উত্তর হলো : যে ক্ষমতা কাঠামো এখন দেশে প্রতিষ্ঠিত, সেখানে মৌলবাদী শক্তি নিয়ন্ত্রণে আছে। ইউনূস আর তার উপদেষ্টারা হয় এই শক্তির সাথে আপসরত, না হয় তাদের হাতের পুতুল।
বাংলাদেশের মানুষ বোকা নয়। তারা জানে কী হচ্ছে। কিন্তু ভয়ের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। কেউ প্রশ্ন তুললেই তাকে ভারতের দালাল বলা হয়, আওয়ামী লীগের সমর্থক বলে চিহ্নিত করা হয়। গুম, গ্রেফতার, মব লিঞ্চিংয়ের ভয় এসব কাজ করছে। কিন্তু ইতিহাস শেখায়, ভয়ের শাসন বেশিদিন টেকে না। মানুষ একদিন না একদিন জেগে ওঠে। বাংলাদেশের মানুষ আগেও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়েছে, পাকিস্তানি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়েছে। এরশাদের পতন হয়েছে গণআন্দোলনে। আবারও সেই দিন আসবে।
আবুল সরকার এখন জেলে, কিন্তু তার গান থেমে নেই। বাউল গান যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন বাংলার আত্মা বেঁচে থাকবে। ওহাবিরা চাইলেই বাংলার সংস্কৃতি মুছে দিতে পারবে না। কারণ এই সংস্কৃতি শুধু গানে বা নাচে নেই, এটা বাংলার মাটিতে, পানিতে, মানুষের রক্তে। ইউনূস আর তার জামায়াতি প্রভুরা ক্ষমতায় থেকে মনে করতে পারে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে, কিন্তু ইতিহাস তাদের বিচার করবে। আর সেই বিচার হবে কঠোর, নির্মম।(আওয়ামীলীগ পেইজ)
