সিন্ডিকেটের গঠন
বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে কেন্দ্র করে যুক্তরাজ্যে একটি বড় সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এই সিন্ডিকেট বিএনপির রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে, দেশ ও বিদেশে, এবং দলের সব কার্যক্রম কার্যত নিয়ন্ত্রণ করছে।
পটভূমি: হাওয়া ভবনের প্রভাব
২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনের পর, বিএনপির রাজনীতি এবং রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ছিল হাওয়া ভবন কেন্দ্রিক একটি সিন্ডিকেটের অধীনে। এটি ছিল সাধারণ জ্ঞান যে এই সিন্ডিকেট, সরকারী কাঠামোর বাইরে কাজ করছিল এবং প্রধান প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছিল।
যুক্তরাজ্যে পুনরাবৃত্তি
অনুরূপভাবে, যুক্তরাজ্যে তারেক রহমানকে কেন্দ্র করে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে, যা বিএনপির রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। নিবেদিত কর্মীরা ক্রসফায়ার, গুম বা আইনি লড়াইয়ে আটকে যাচ্ছে এবং কারাবরণ করছে। তবুও, সিন্ডিকেটের ভাল তালিকায় না থাকলে দলীয় পদ পাওয়া যায় না।
পুরনো এবং নতুন সদস্য
পুরনো হাওয়া ভবনের সদস্যরা এখন এই নতুন চক্রের অংশ লন্ডনে। তারা পূর্বের ইউপি, পৌর এবং উপজেলা নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্যে জড়িত ছিল। এই লন্ডন ভিত্তিক সিন্ডিকেট, যা তারেক রহমানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে, বাংলাদেশে অনেক জেলা এবং থানার কমিটি নিয়ন্ত্রণ করছে। বিশাল পরিমাণ অর্থ এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কমিটি এবং মনোনয়ন বাণিজ্যে লেনদেন হয়। ফলে, অনেক ধনী ব্যবসায়ী বাংলাদেশ থেকে লন্ডনে গিয়ে দলীয় পদ নিশ্চিত করতে দেখা যায়।
সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে পদ
মনোনয়ন এবং দলীয় পদ অনেকটা সিন্ডিকেটের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। যদি কেউ সিন্ডিকেটকে ম্যানেজ করতে পারে, তবে তারা নিবেদিত নেতাদের পাশ কাটিয়ে মনোনয়ন এবং পদ নিশ্চিত করতে পারে, যা একটি ওপেন সিক্রেট। অপরদিকে, সিন্ডিকেটের অপছন্দের তালিকায় থাকলে সবকিছু অনিশ্চিত হয়ে যায়, ত্যাগের পরও। বিএনপির রাজনীতিতে মাঠে থাকা প্রয়োজন নেই, যদি তারেক রহমানের সিন্ডিকেট ম্যানেজ থাকে।
প্রধান ব্যক্তিদের প্রভাব
তারেক রহমানের শক্তিশালী পিএস মিয়া নূর উদ্দিন অপু, যিনি জরুরি অবস্থা ঘোষণার পর ১১ জানুয়ারি ২০০৭-এ পালিয়ে যান। তিনি মালয়েশিয়ায় দীর্ঘদিন ছিলেন এবং এখন বাংলাদেশ ও লন্ডনে যাতায়াত করছেন। আরেক প্রভাবশালী হাওয়া ভবন সদস্য আতিকুর রহমান রোমান নিয়মিত লন্ডনে আসেন। হাওয়া ভবনের কথিত মুখপাত্র আশিক ইসলাম, যিনি ১/১১-এর পর আমেরিকায় পালিয়ে যান, তিনি নিয়মিত লন্ডনে যাতায়াত করেন। এই যাতায়াতের পেছনে রয়েছে ধনী ব্যবসায়ীদের বিশাল অনুদান যারা পদ ও মনোনয়ন প্রত্যাশী।
নতুন সংযোজন: আবদুর রহমান সানি
এই চক্রের নতুন সংযোজন আবদুর রহমান সানি, যিনি বাংলাদেশে পলিটেকনিকে পড়াশুনা করেছেন। লন্ডনে তিনি বিএনপির চীফ এক্সিকিউটিভ হিসাবে পরিচিত, তার অবস্থান এখন চেয়ারপার্সন এবং সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের পরেই। সানি তারেক রহমান এবং দলীয় কর্মীদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করেন। স্থায়ী কমিটির সদস্যরা তারেক রহমানের সান্নিধ্য পেতে সানির সাহায্য নেন। তার কোনো অফিসিয়াল দলীয় পদ না থাকলেও, তার প্রভাব স্থায়ী কমিটির সদস্যদেরও সম্মান জানাতে বাধ্য করে।
প্রভাব এবং ক্ষমতার গতিশীলতা
কেউ তাকে তারেক রহমানের পিএস, কেউ ড্রাইভার, কেউ ব্যক্তিগত সহকারী বলেন। তবে, তার ক্ষমতা স্থায়ী কমিটির সদস্যদের উপরে। তারেক রহমান সবসময় মঞ্চে পেছনের চেয়ারটি সানির জন্য সংরক্ষণ করেন। অফিসিয়াল পদ না থাকলেও, সানির প্রভাব তাকে দলের ভাল বইতে রাখার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। ফলে, সব বিএনপি সদস্য সানিকে ম্যানেজ এবং সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করে।
বিতর্ক এবং বিরোধ
সম্প্রতি, যুক্তরাজ্য বিএনপি সভাপতি আবদুল মালেক সানির প্রভাব প্রকাশ করেছেন যুক্তরাজ্য বিএনপি কাউন্সিল গঠনের সময়। মালেক একটি কথোপকথন রেকর্ড করেন, যেখানে তিনি বলেন যে সানি সম্ভাব্য কমিটির সদস্যদের তালিকা চেয়েছেন। এই অডিওটি যুক্তরাজ্য বিএনপি নেতাদের মধ্যে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। অনেকেই বাংলাদেশ থেকে সানির মাধ্যমে তারেক রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করতে আসেন, যা সানির ভাই কবীর আহমদ দ্বারা সুবিধাজনকভাবে পরিচালিত হয়।
হুমায়ুন কবীরের বিতর্কিত উত্থান
২০১৩ সাল থেকে, তারেক রহমানের উপদেষ্টা হুমায়ুন কবীর প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন। ২০১৫ সালে মার্কিন কংগ্রেসম্যানদের স্বাক্ষর জাল করার জন্য পরিচিত কবীর, তিনি পূর্বে যুক্তরাজ্য লেবার পার্টির একটি ওয়ার্ড শাখার সেক্রেটারি ছিলেন, কিন্তু অসদাচরণের কারণে বহিষ্কৃত হন। বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পাদক হিসাবে তার উত্থান দলীয় ভেতরে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।
নেতৃত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন
অনেক দীর্ঘমেয়াদী বিএনপি কর্মী, যারা নির্যাতন, কারাবাস এবং রিমান্ড সহ্য করেছেন, তারা পার্শ্ববর্তী হয়ে থাকেন, যখন নতুনরা তারেক রহমানের নিকটত্বের কারণে দ্রুত উত্থিত হন। এটি তারেক রহমানের স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। কবীর, যিনি এক সময় ভবঘুরে ছিলেন, এখন নিজেকে ভবিষ্যৎ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে দেখেন, তার এই প্রভাব নিয়ে দলীয় ভেতরেও প্রশ্ন উত্থাপন হয়েছে।
কবীরের আয়ের উৎস
কবীরের আয়ের উৎসের মধ্যে তারেক রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করানো জন্য মোটা অর্থ গ্রহণ করা অন্তর্ভুক্ত, যাকে প্রায়ই একটি কুখ্যাত ড্রাগ স্মাগলারের সাথে দেখা যায়। আরেক সিন্ডিকেট সদস্য আবু সায়েম, যিনি ২০১৪ সালে গ্রেফতার হন, তিনি এখন তারেক রহমানের উপদেষ্টা।
যুক্তরাজ্য বিএনপি কমিটির বিতর্ক
যুক্তরাজ্য বিএনপি কমিটি গঠনের প্রক্রিয়াটি বিতর্কের মধ্যে রয়েছে। বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে মে মাসে, কিন্তু চেয়ারপার্সনের লন্ডনে থাকার কারণে প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়েছে। সম্প্রতি, একটি অস্পষ্ট কাউন্সিল প্রক্রিয়া ঘোষণা করা হয়েছে, যা সদস্যদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান বর্তমান সভাপতি এবং সেক্রেটারিকে পছন্দ করেন, তা সত্ত্বেও অনেকেই এই অবস্থান নিয়ে অসন্তুষ্ট। নেতারা সন্দেহ করছেন যে তারেক রহমান তাদের ধরে রাখতে চান কিন্তু সরাসরি দায় নিতে চান না, তাই এই গোপনীয়তা এবং প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে।
সিন্ডিকেটের গভীর প্রভাব
যুক্তরাজ্যে অনেক যোগ্য ব্যক্তি থাকা সত্ত্বেও, দলের সাধারণ কর্মীরা তারেক রহমানের দ্বারা আরোপিত অশিক্ষিত নেতৃত্বকে পছন্দ করেন না। আবদুর রহমান সানির পছন্দ সবসময় প্রাধান্য পাবে বলে সন্দেহ করে, যা সিন্ডিকেটের গভীর প্রভাবকে প্রতিফলিত করে।
উপসংহার
১ জানুয়ারি, কাউন্সিল স্থগিত হওয়ার পর, তারেক রহমান মাহিদুর রহমানকে একটি নতুন কাউন্সিল ১৫ জানুয়ারি আয়োজন করতে নির্দেশ দেন। ফলাফল সরাসরি তারেক রহমানের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়। এই গোপনীয়তা এবং হস্তক্ষেপ যুক্তরাজ্য বিএনপি রাজনীতিতে গভীরভাবে প্রভাবিত সিন্ডিকেটের অবস্থানকে নির্দেশ করে, যা তারেক রহমান দ্বারা সংগঠিত।
হাওয়া ভবন কি?
হাওয়া ভবন ঢাকা, বাংলাদেশের বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর রাজনৈতিক কার্যালয়। এটি ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি সরকারের সময় আলোচিত হয়েছিল, একটি অনানুষ্ঠানিক শক্তি কেন্দ্র হিসাবে। “হাওয়া ভবন” শব্দটি প্রায়ই সেই সমান্তরাল শাসন কাঠামো বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হয়, যেখানে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত সরকারী কাঠামোর বাইরে নেওয়া হত। এই অফিসটি ব্যাপক দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগের সাথে সম্পর্কিত ছিল। সমালোচকরা বলেন যে এটি পৃষ্ঠপোষকতা এবং কৃপণতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল, যা গণতান্ত্রিক শাসন এবং স্বচ্ছতাকে দুর্বল করেছিল।
তারেক রহমান কে?
তারেক রহমান একজন বিশিষ্ট বাংলাদেশী রাজনীতিবিদ, বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি প্রাক্তন বাংলাদেশী প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র। তারেক রহমান বিএনপির মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, বিশেষত তার মায়ের স্বাস্থ্য হ্রাসের কারণে তিনি দলীয় কার্যক্রমে নেতৃত্ব দেন।
- দুর্নীতি অভিযোগ: তারেক রহমান সরকারের সময়ে এবং পরবর্তী সময়ে অনেক দুর্নীতি, চাঁদাবাজি এবং মানি লন্ডারিং অভিযোগের মুখোমুখি হন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মামলা ছিল ঘুষ এবং কিকব্যাক থেকে লক্ষ লক্ষ ডলার চুরি করা।
- গ্রেফতার এবং আটক: ২০০৭ সালে, সামরিক-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে, তারেক রহমান একাধিক দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার হন। তিনি এক বছরেরও বেশি সময় ধরে আটক ছিলেন, যেখানে তিনি নির্যাতনের অভিযোগ করেন।
- যুক্তরাজ্যে নির্বাসন: ২০০৮ সালে, তারেক রহমান চিকিৎসার জন্য জামিনে মুক্তি পান এবং স্ব-আরোপিত নির্বাসনে যুক্তরাজ্যে চলে যান। সেই থেকে তিনি লন্ডনে বসবাস করছেন এবং সেখান থেকে বিএনপির রাজনীতিকে প্রভাবিত করছেন।