জন্মদিনে প্রণাম
অজয় দাশ গুপ্ত
সত্তর দশকের শেষ দিকে আমি ছিলাম চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র। কলেজের গ্যালারীতে বাংলা পড়াতেন এক শিক্ষক। বই দেখে প্রথাগত ভাবে পড়াতেন না তিনি। শরৎচন্দ্রের শ্রী কান্ত পড়াতেন আমাদের। ঠিক সময়ে হুড়মুড় করে এসে ক্লাশে ঢুকে পড়তেন। একদিন ঢুকেই বলতে শুরু করলেন ইন্দ্রনাথ চরিত্র টি কত খারাপ। মদ খায়, ভাঙ খায়, বাসাবাড়িতে থাকে না। বলতে বলতে মনে বিদ্বেষ ঢুকিয়ে থেমে গেলেন।
সবার কাছে জানতে চাইলেন কেমন এই ইন্দ্রনাথ? একবাক্যে সবাই বললাম বদ।এবার মুচকি হেসে আবেগ তাড়িত হয়ে শুরু করলেন ইন্দ্রনাথের প্রশংসা। মরার জাত না মানা, বিধবার দুঃখ বোঝার মত মনের ইন্দ্রনাথ কে মূহুর্তে হিরো করে তুলেছিলেন তিনি। এবার সুর বদলে সবাই ইন্দ্রনাথের ভক্ত হয়ে গেলাম। হতবিহ্বল আমাদের এভাবেই শেখাতেন ভালো মন্দের তফাৎ।
তাঁর কাছে প্রথমবার শুনি সত্যজিৎ রায়ের অাকাশচুম্বি জনপ্রিয়তার কথা। জানতে পারি কতটা পাগল বিদেশের মানুষ তাঁকে এক নজর দেখার জন্য।
চট্টগ্রামের নাটক ও নাট্যজগত আলোকিত করে রাখা মানুষটি যখন ঢাকায় গেলেন তখন বাংলাদেশের নাটক মানেই তাঁর আবেগ তাঁর দুঃখ তাড়িত অভিনয় সুধা। হুমায়ূন আহমেদের একটি নাটকে নূরের সাথে তাঁর অভিনয়, অবেলায় সন্তান হারানো পিতার অব্যক্ত কান্নার সেই দৃশ্য বহুরাত ঘুমাতে দেয় নি।
আমি সিডনি চলে আসার পর তিনি এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু পরিষদের আমন্ত্রণে। তাঁর সাথে এক মঞ্চে কথা বলা আমার জন্য ছিলো সবচেয়ে কঠিন কাজ। অথচ কী অবলীলায় কী উদারতায় আপন করে নিয়ে বলেছিলেন, জানো অজয় আসার পথে বিমানে তুমি আর সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের লেখার কথা বলতে বলতে এসেছি আমি। জানতাম, আমাকে সাহস যোগানোর জন্যই এমন করে বলা।
একটা বিষয় আজীবন অনুসরণ করছি তাঁর ভাষণ থেকে শিখে। সে বার সিডনি বড় উত্তপ্ত। স্বাধীনতা বিরোধীর সফর নিয়ে। সে প্রতিবাদ সভায় তিনি বলেছিলেন, যে জিহ্বা দিয়ে তিনি পবিত্র কোরান পাঠ করেন, যে জিহ্বা দিয়ে মায়ের নাম উচ্চারণ করেন, যা দিয়ে মাতৃভূমি বাংলাদেশের নাম বেরিয়ে আসে সে জিভ দিয়ে তিনি এ নাম বা এদের নাম উচ্চারণ করবেন না। ঠিক তাই, আমি তুমি সে করে করে বলে ঠিকই শত্রু চিনিয়ে দিয়েছিলেন।
প্রিয় অধ্যাপক, শিক্ষক, নাট্যকার, অভিনেতা, লেখক মমতাজ উদ্দীন নিজেকে বলতেন মম- তাজউদ্দীন আহমেদ।ধীরে ধীরে অভিভাবক শূন্য হয়ে পড়ছি আমরা। সে কারণেই ক্রান্তিলগ্নে অভিভাবক হীন আমরা। ১৮ জানুয়ারি শুভ জন্মদিন স্যার।প্রণাম।
{ মমতাজউদদীন আহমদ (১৮ জানুয়ারি ১৯৩৫ – ২ জুন ২০১৯) ছিলেন একজন প্রখ্যাত বাংলাদেশি নাট্যকার, অভিনেতা ও ভাষাসৈনিক।[১] তিনি স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ যিনি এক অঙ্কের নাটক লেখায় বিশেষ পারদর্শিতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। নাটকে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ১৯৭৬ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও ১৯৯৭ সালে একুশে পদক লাভ করেন।[২]}
লেখক: প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক।