মনজুরুল হক
“আজকের বৈষম্যবিরোধী এবং নাগরিক কমিটির ছাত্র নেতাদের চোখে-মুখে ক্ষমতার বিচ্ছুরণ দেখা যাচ্ছে। তারা কেউ অটোম্যাটিক রাইফেল হাতে ঘুরছে না, কিন্তু তাদের সঙ্গে যে হিডেন কামান-বন্দুকের ক্ষমতা রয়েছে। সেটাই তাদেরকে প্রবল ক্ষমতাধর করেছে। দ্বিগুণ বয়সী প্রাজ্ঞ পণ্ডিত ব্যক্তিও তাদের চোখে চোখ রাখতে পারছে না। এটাই পাওয়ার।
#️⃣
এমন পাওয়ার থেকে সিদ্ধান্ত আসল ৩১ ডিসেম্বর ‘জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ করতে হবে। সেবার ইউনূসের ‘এনজিও সরকার’ নিজেদের বিপদ বুঝতে পেরে তারিখ পিছিয়ে কোনও মতে সামাল দেয়। ১৫ জানুয়ারি আবার তারা ছক কষে ১৬ তারিখেই সকল দল নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হবে। এই ঘোষণা না থাকায় নাকি তাদের ‘বিপ্লব’ মান্যতা পাচ্ছে না। এবারের উদ্যোগও লেজেগোবরে করে ফেলেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং নাগরিক কমিটি।
#️⃣
১৬ তারিখের বৈঠকে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম দলগুলোকে আমন্ত্রণ করেছেন মেসেজ দিয়ে। যেটা অনেক দলেরই পছন্দ হয়নি। বলা হয়েছিল-‘সর্বদলীয় বৈঠক’। সর্বদলীয় বৈঠক বলতে সরকার কী বোঝে এই প্রশ্ন তুলে সিপিবি, নাগরিক ঐক্য ও এলডিপি বৈঠকে যোগ দেয়নি। এই ‘সর্বদলীয়’ বৈঠকে অংশ নেয় নিবন্ধপ্রাপ্ত ৪৮টি দলের মাত্র ৮টি নিবন্ধিত দল ও দুটি ছাত্র সংগঠন।
#️⃣
বিএনপি কেন যেতে চায়নি তার কারণ-সরকারের পক্ষ থেকে যে উপদেষ্টা দলগুলোকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তার আচরণে বেজায় চটেছে বিএনপির সিনিয়র নেতারা। টেলিফোনে কোনও ভদ্রতা ও সৌজন্য না দেখিয়ে একদিনের মধ্যে মতামত দেওয়ার কথা জানান। বিষয়টি বিএনপির মতে অনেকটা ‘আদেশ’ স্টাইলে। বিএনপির হাইকমান্ড এমতাবস্থায় বৈঠক বর্জনের সিদ্ধান্ত নিলে সরকারের পক্ষ থেকে মিনিমাইজ করা হলে বিএনপি মুখ রক্ষার্থে বৈঠকে যোগ দেয়। জামায়াত, খেলাফত মজলিশ ও নাগরিক কমিটির ২ জন করে দাওয়াত দিলেও বিএনপিসহ বাকিদের বলা হয় ১ জন আসতে। দাওয়াতের ধরণ নিয়ে আপত্তি করলে উল্টে অসৌজন্যমূলক আচরণ করা হয়। বৈঠক শেষে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন- ‘বৈঠক ফলপ্রসূ হয়েছে এবং সকল দল ঘোষণাপত্র প্রকাশের ব্যাপারে একমত হয়েছে।‘
#️⃣
সরকারের টেকনিক পরিষ্কার- ঘোণাপত্রে নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশনের মতই বলা হয়েছে- ‘আমরা ঘোষণা প্রদান করলাম যে ১৯৭২ এবং ১/১১ কালের রাজনৈতিক বন্দোবস্তের পরিবর্তন ঘটানোর জন্য আমাদের একটি নতুন ‘জনতন্ত্র’ (রিপাবলিক) প্রয়োজন, যা রাষ্ট্রে সকল ধরণের নিপীড়ন শোষণ ও বৈষম্যের অবসান ঘটাবে… ইত্যাদি ইত্যাদি…।‘ এই প্রসঙ্গে বিএনপিসহ কয়েকটি দলের আশঙ্কা জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশের নামে সরকার অনির্দিষ্টকালের জন্য নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার কূটকৌশল চালাচ্ছে।
#️⃣
এরই মধ্যে দুটি বিদেশি বন্ধুরাষ্ট্র সরকারের কর্মকাণ্ডে আপত্তি জানিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সরকারের কর্মকাণ্ডে সরাসরি নেতিবাচক মনোভাব জানিয়ে দিয়েছে। তারা মনে করছে সরকার মূল সমস্যার দিকে নজর না দিয়ে উন্মাদনা বজায় রাখার চেষ্টা করছে। বিশেষ করে জাতিসংঘের তদন্তদল তাদের অসন্তষ্টির কথা জানিয়ে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক পক্ষগুলো জুলাই-আগস্টের হত্যামামলা, মামলা দায়ের প্রক্রিয়া, অভিযুক্তদের গ্রেফতার ও আইসিটি প্রসিকিউশনের টিমের কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
এসব বিষয় নিয়ে বিদেশি দুই রাষ্ট্রদূত সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সাথে দেখা করে একটি মামলার রেফারেন্স তুলে ধরেছেন। ৬ জানুয়ারি ঢাকার চিফ জ্যুডিশিয়াল মেজিস্ট্রেট আদালতে দায়ের হওয়া একটি মামলায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক পোশাক কর্মীকে গুলি করে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৩৪৪ জন সাবেক সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। একজন পোশাক কর্মীকে হত্যাচেষ্টার জন্য কীভাবে ৩৫০ জন সাংসদের মধ্যে ৩৪৪ জন আসামি হয় এটা তারা জানতে চেয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতারা গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে হুমকি দিলেও সরকার কেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না তাও জানতে চাওয়া হয়েছে।
#️⃣
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতারা যতই লম্ফঝম্ফ করুন, তাদের লম্ফঝম্ফে যতই নষ্ট বামদের একাংশ নারদ মুনির মত খঞ্জরি বাজিয়ে সঙ্গ দিক, ইউনূস সাহেবকেই পশ্চিমা দেশগুলোর প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। তিনি যে তা পারবেন না সেটিও জানেন। তাই এসব থেকে বাঁচতে তাকে একটার পর একটা দুর্বল স্ক্রিপ্টের পিকিউলিয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে।
#️⃣
দুঃখজনক হলো বৈষম্যবিরোধী ও নাগরিক কমিটির ছাত্র নেতারা যাকে তাকে যখন-তখন হুমকি দিচ্ছে, কলম-হাত ভেঙে ফেলার হুমকি দিচ্ছে, মিডিয়া হাউসে গিয়ে ১০ জন সাংবাদিকের চাকরিচ্যুতির নির্দেশ দিচ্ছে, সীমান্তের ঘটনা নিয়ে ফের দিল্লি মার্চের ঘোষণা দিচ্ছে, সংবিধান ছুঁড়ে ফেলছে, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সকল কিছু মুছে ফেলছে, ‘আদিবাসী’ বিতর্কে পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের পেটাচ্ছে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা টেনে হিঁচড়ে রাস্তায় ফেলছে……. অথচ দেশের তাবড় তাবড় রাজনৈতিক দলগুলো যারা দাবী করে তারাই দেশবাসীর একমাত্র মনোনীত প্রতিনিধি, সেই তারা মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন! আর এইসব অনাচার, অনিয়ম, হুমকি-ধামকির জন্য জবাবদিহি করতে হচ্ছে বিদেশি রাষ্ট্রদূতদেরকে।
#️⃣
এমন ভেড়ুয়া মেরুদণ্ডহীন আপোষকামী রাজনীতিবিদদের আস্তাকুড়ে ছুঁড়ে ফেলার সময় এসেছে, কিন্তু মুশকিল হলো জনগণ যে ছুঁড়ে ফেলবে, তারও একটি নেতৃত্ব নেই। তাই জনগণকেও এইসকল ভাঁড়দের সহ্য করে যেতে হচ্ছে।”
১৭ জানুয়ারি ২০২৫