ফারুক যোশী
নর্থ ইংল্যান্ডের প্রায় চার লাখ বাংলাদেশি জনগণ ফুঁসে উঠেছে। গ্রেটার ম্যানচেস্টার, লিভারপুল, লিডস, ইয়র্কশায়ার, বার্মিংহাম, স্কটল্যান্ডসহ এ অঞ্চলের বিভিন্ন সংগঠন আন্দোলন করছে, এমনকি সাংবাদিকদের সংগঠনও প্রতিবাদ জানাচ্ছে, সভা করছে জনসচেতনতার জন্য। হাইকমিশনসহ দেশের সর্বোচ্চ জায়গায় স্মারকলিপি দিচ্ছে। বাংলাদেশের বর্তমান প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ম্যানচেস্টার-সিলেট ফ্লাইট বন্ধের পাঁয়তারা রুখতে এ আন্দোলন। গত কয়েক বছর থেকে বিমান ভালোই চলছিল। ম্যানচেস্টার এয়ারপোর্টে বিমানের যাত্রীদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা-অসুবিধা দেখাশোনা করা হচ্ছে খুবই আন্তরিকভাবে। এমনকি ফ্লাইট চলাকালেও যাত্রীসেবার মান মোটামুটি ভালোই বলা যায়। অর্থাৎ ছোটখাটো অভিযোগ ছাড়া বিমানের ম্যানচেস্টার ফ্লাইট নিয়ে নর্থ ইংল্যান্ডের বাংলাদেশি জনগণ বলতে গেলে খুবই ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন।
এই যখন ম্যানচেস্টার-সিলেট ফ্লাইটের সফলতা, ঠিক তখনই যেন শুরু হয়েছে এ ফ্লাইটটি বন্ধের তৎপরতা। অনলাইনে টিকেট বেচাকেনা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে আগামী ২৭ এপ্রিলের পর থেকে। অর্থাৎ ২৭ এপ্রিলের পরে আর কোনো টিকেট বুকিং নিচ্ছে না বিমান ম্যানচেস্টার-সিলেট ফ্লাইটের। যদিও বিমান এ নিয়ে কোনো ঘোষণা দেয়নি, তবে কার্যত ওই সময় থেকেই ফ্লাইট আর চলছে না, এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে। কিন্তু মানুষতো জেনে গেছে এ ফ্লাইট বন্ধেরই পাঁয়তারা চলছে।
রাষ্ট্র জনগণের কল্যাণেই কাজ করে থাকে। বিমান রাষ্ট্রের সম্পত্তি, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। বাণিজ্যিক সব প্রতিষ্ঠান সব সময় সমান মুনাফা করে না। লাভ-লোকসান দিয়েই চলে একটা রাষ্ট্র। সিলেটে তথা দেশে যখন কোনো মানুষ তার পরিবার নিয়ে যায়, তখন শুধু তারা দেশ ভ্রমণই করে না। সেখানে গিয়ে তারা বিভিন্নভাবে খরচ করে। যে অর্থ তারা টিকেটের জন্য পরিশোধ করতে হয়, তারচেয়ে অন্তত চারগুণ টাকা খরচ করে তারা দেশে। যা দেশের অর্থনীতিতেও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
২. ‘শুরু এবং শেষ’- এ এক খেলা ছিল বিমানের, অর্থাৎ ‘শুরু হয় বন্ধ হয়’ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ম্যানচেস্টার বিমানবন্দর থেকে তৃতীয়বার ফ্লাইট শুরু হয়েছিল করোনা মহামারির আগে। মহামারি সারা পৃথিবীকে স্তব্ধ করে দিলে এ ফ্লাইটও স্থির হয়ে যায়। কোভিড-পরবর্তী আবারো চালু হয় বিমানের ম্যানচেস্টার-সিলেট সরাসরি ফ্লাইট। শুরুতে সপ্তাহে দুটো ফ্লাইট পরিচালনা করলেও শেষে তিনটা ফ্লাইটে নিয়ে আসা হয়। ব্রিটেনের ছুটিকালে যাত্রীদের চাপ সামাল দিতে না পেরে কর্তৃপক্ষ এ সিদ্ধান্তটি নিয়েছিল। কিন্তু বাণিজ্যিক হিসেবে এটা লাভজনক ছিল না। কারণ ছুটিকালীন সময় ছাড়া অন্যান্য ‘অফ সিজনে’ সারা পৃথিবীতেই উড়োজাহাজের বাণিজ্য কিছুটা ঢিলে হয়ে যায়। কিন্তু যাত্রী ভ্রমণের ব্যস্ততাকালে বাংলাদেশ বিমানের ভাড়াও বৃদ্ধি পায় মাত্রাতিরিক্ত। এতে সমালোচনা করছে মানুষ, কিন্তু তারপরও যাত্রী কমেনি ব্রিটেনের শিক্ষাঙ্গনগুলোর ছুটিকালীন সময়ে। বরং চাপ বেড়ে যায়। এমনকি বিমানের আসন বিক্রি তিন মাস আগেই শেষ হয়ে যায়, যা এখনো চলমান। এ হিসেবে ম্যানচেস্টার বিমানের বাণিজ্যিক রুট হিসেবে ভালো হওয়ার কথা। এবং তাই গ্রীষ্মকালীন সময়, ইস্টার কিংবা বড়দিনের ছুটির সময়সহ ছয় মাস ফ্লাইটগুলো থাকে লাভজনক, তিন মাস থাকে লাভহীন আর বাকি তিন মাস থাকে ক্ষতির মাঝে। অর্থাৎ বছর শেষে এ রুটে বিমান বাণিজ্যিকভাবে সফল নয় বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে। এর একটা কারণ ছিল, সপ্তাহে তিনটা ফ্লাইট, যা এখন নামিয়ে আনা হয়েছে দুটো ফ্লাইটে।
সত্যি কথা হলো, বাকি তিন মাস অন্যান্য এয়ারলাইন্সের মতো বিমানেরও যে আসন খালি যায় না, তা নয়। প্রায় পাঁচ বছর আগে আমিরাত এয়ারলাইন্সে একবার ভ্রমণ করেছিলাম আমার আরো দুজন বন্ধুসহ। সেই এয়ারক্রাফটের আসনগুলো এতই ফাঁকা ছিল যে, একেকটা সারিতে লম্বা হয়ে শুয়ে ভালো ঘুম দিয়ে আমরাও ভ্রমণ করেছি। অন্য যাত্রীরাও এ সুযোগ নিয়েছেন। সুতরাং এ সময়ে বিমানও যে ফাঁকা যাবে এতে কোনো সন্দেহ থাকার কারণ নেই।
কিন্তু একটু পেছনের দিকে যদি আমরা ফিরে তাকাই, তাহলে দেখা যাবে প্রথম অর্থবছরে (২০/২১) বিমান (ম্যানচেস্টার-সিলেট ফ্লাইট) যেখানে মুনাফাতো দূরের কথা, লোকসান গুনেছিল ৮৩ কোটিরও বেশি, সেই জায়গায় দ্বিতীয় অর্থবছরে সে ক্ষতির পরিমাণ চলে আসে তার অর্ধেকে অর্থাৎ ৪০ কোটি এবং তৃতীয় অর্থবছরে সে পরিমাণ আরো কমে হয়ে যায় ২০ কোটিরও নিচে। সে হিসেবে বিমান ফ্লাইট এখানে দ্রুতই লাভবান হতে যাচ্ছে। একটু খেয়াল করলে দেখা যায়, গত ৪২ বছর লন্ডন-ঢাকা কিংবা লন্ডন-সিলেট মিলে বিমান হাজার কোটি টাকা ক্ষতি গুনে মাত্র গত বছর থেকে মুনাফা পাচ্ছে। অথচ বিমান পৃথিবীর আরো অনেক রুটে লোকসান দিচ্ছে।
একটা সূত্র বলছে, বিমান মোট ২১টা রুটে যাত্রী বহন চালু রেখেছে। এর মাঝে রোম-ঢাকা (লোকসানের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি), নারিতা-ঢাকা, গোয়ানজো-ঢাকাসহ প্রায় ১৪টা রুটই লোকসানের মুখেই আছে। সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশিদের গৌরবের এ ফ্লাইটটি সরকার ভর্তুকি দিয়েই চালাচ্ছে। সহসা এরা লাভ দেখবে বলেও মনে হচ্ছে না। অথচ বিমানের হিসাব-নিকাষই আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে ম্যানচেস্টার-সিলেট ফ্লাইট অচিরেই ব্যবসাসফল হয়ে উঠছে এবং তা হয় এ বছরই ‘ব্রেক-ইভেন’ হয়ে যাবে, যদি দুটো ফ্লাইট (তিনটা নয়) চালু রাখা যায়। অথচ সফলতার মুখ দেখার মাত্র এক বছর আগেই এ ফ্লাইট বন্ধের চক্রান্তটা শুরু হয়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন রাখা যায়, কেন-ই বা ওই চক্রান্ত?
৩. ২০২২-এর জানুয়ারিতে এক লেখায় উল্লেখ করেছিলাম ‘বাণিজ্যিক সফলতা আছে এ রুটের। আছে দ্রুত মুনাফা বানানোর সম্ভাবনা। কিন্তু তারপরও ম্যানচেস্টার থেকে সরাসরি ফ্লাইট উড্ডয়নের ব্যাপারে বিশেষত কতিপয় প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর বিরোধিতা ছিল। এরই একজন যিনি আমার সামনে প্রকাশ্যেই বাংলাদেশ বিমানের ম্যানচেস্টার ফ্লাইট চালুর বিরোধিতা করেছেন একটা গণমাধ্যমে।
বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, ম্যানচেস্টারের ওই ট্রাভেল ব্যবসায়ী বিমানের এজেন্ট হয়েই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন এ ব্যবসায়। অধুনা তিনি নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে ট্রাভেল ব্যবসার ঝাঁপি বন্ধ করলেও বিমানের এজেন্ট হিসেবে টিকেট বিক্রি চালিয়ে যাচ্ছেন অনলাইনে। লন্ডনের কিছু ব্যবসায়ীও এরকম চরম বিরোধিতা করেছেন ম্যানচেস্টার-বাংলাদেশ ফ্লাইটের। এই ব্যাপারটি এখনো আছে। অন্যদিকে বিমানের কিছু অসাধু পদস্থ কর্মকর্তাও ওই ব্যবসায়ীদের ম্যানচেস্টার-সিলেট ফ্লাইট বন্ধের ব্যপারে তৎপরতা চালাচ্ছেন বলে গুঞ্জন আছে। অন্যদিকে লোকসান গোনার সময়ে কিংবা সারা বছরই এ রুটের যাত্রীদের ট্রানজিট চালু করতে পারে বিমান কর্তৃপক্ষ। যেমন ম্যানচেস্টার থেকে সিলেট হয়ে ভ্রমণ করা ফ্লাইটটি যদি জেদ্দায় ট্রানজিট দেয়া যায়, তাহলে লোকসান পুষিয়ে আনা যাবে। অন্যদিকে বহু উচ্চারিত নিউইয়র্ক-সিলেট ফ্লাইট ম্যানচেস্টারে ট্রানজিট দিয়ে শুরু করতে পারলে তা-ও লাভের দিকেই এগিয়ে যাবে। সিলেট থেকে নিউইয়র্ক রুটে বিমানের ফ্লাইট চালু করার দাবি দীর্ঘদিনের। এখনো এ রুটে বিমানের সেবা চালু হয়নি। এ কারণে ম্যানচেস্টার ফ্লাইটকে ট্রানজিট দিয়ে নিউইয়র্ক রুটে চালু করার চিন্তাভাবনা ছিল। বিগত দিনে সরকারের তরফ থেকে এ ব্যাপারে আশ্বাসও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই আশ্বাস আর বাস্তবায়িত হয়নি।
এগুলো ফ্লাইট বাঁচানোর যুক্তি। অথচ আগেই উল্লেখ করেছি, এ রুটের বাণিজ্যের খতিয়ান বলছে, এক বছরের মধ্যেই এ রুট লোকসান থেকে মুক্ত হয়ে যাচ্ছে। অথচ এ খতিয়ানের দিকে নজর না দিয়ে লাভজনক ম্যানচেস্টার-সিলেট ফ্লাইট বাতিলের চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। তাই নর্থ ইংল্যান্ডে মানুষের প্রতিবাদ অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং তা শুধু নর্থ ইংল্যান্ডের বাংলাদেশি মানুষের প্রয়োজনেই নয়, বাংলাদেশের প্রয়োজনেও এ ফ্লাইট চালু রাখা জরুরি।
ফারুক যোশী : কলাম লেখক। faruk.joshi@googlemail.com