মনজুরুল হক
মুহাম্মদ ইউনূসকে যারা ক্ষমতায় বসিয়েছে, গ্যালারিতে বসা সেই স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদীদের কাছে হাততালি পাওয়ার জন্য তিনি একটার পর একটা ব্যর্থ চাল দিচ্ছেন। কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকে এক দফার আন্দোলনের মধ্যে যখন ‘খুনি হাসিনার ফাঁসি চাই’-এর সঙ্গে উঠে আসল-‘ভারতের কালো হাত ভেঙে দাও’, ‘দিল্লি না ঢাকা’… তখনই বোঝা গেছে কোটা তো নয়ই, এমনকি হাসিনার সঙ্গে তাদের টার্গেট ভারত, কারণ এই ভারতের “ষড়যন্ত্রে ও সহায়তায় একাত্তর সালে পাকিস্তান ভেঙেছিল। বাংলাদেশ ভারতের ‘গোলামি’ মেনে নিয়েছিল”।
🔮
তার পর পরই দেশজুড়ে মুক্তিযুদ্ধের যতো স্মৃতি ছিল সব ধ্বংস করা হল। ঘোষণা করা হলো- ‘একাত্তরে পুরোটা হয়নি, এবার ২০২৪-এ বাংলাদেশ স্বাধীন হলো’।
অবুঝ মানুষ মনে করল ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে। দেশ এখন মুক্ত। দেশের মানুষ এখন স্বাধীন। তাই নির্বাচন, নির্বাচিত দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর এসব তুচ্ছ। এর পর থেকেই ইউনূস এন্ড কোং-এর মূল কাজ হয়ে উঠল ভারতবিরোধীতার আবেগ উসকে দেওয়া।
🔮
গত ৫৩ বছরের মধ্যে এবারই প্রথম ভারত-বাংলাদেশ যুদ্ধাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তার জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী মুহাম্মাদ ইউনূস। তার যেন প্রতিশ্রুতিই ছিল ভারতকে যুদ্ধে টেনে আনা। প্রধানত: মনে করা হয় তার সরকার চালানোর অযোগ্যতা, দেশের অস্থিরতা এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য তীব্র জাতীয়তাবাদী জোশ দরকার, যা আসতে পারে প্রতিবেশী ভারত বাংলাদেশকে আক্রমণ করলে।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরে দেশে এবং দেশের বাইরে বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশকে ঘিরে এক ধরণের টেনশন তৈরি হয়েছে। আগে এই অঞ্চলে যে ভারসাম্য ছিল তা নষ্ট হয়েছে মুহাম্মদ ইউনূসের কর্মকাণ্ডে। এর ফলে দেশে এবং দেশের বাইরে চক্রান্তকারী শক্তি নতুন করে গুটি চালতে শুরু করেছে। ইউনূসের পাকিস্তানের সঙ্গে মাত্রাতিরিক্ত দহরমমহরম যতো বেড়েছে ততই ভারতের রক্তচাপ বেড়েছে। এর উপর ইউনূস এবং তার উপদেষ্টা ও সমন্বয়করা ভারত সম্পর্কে এমন সব বক্রোক্তি করেছে যা সহজভাবে নিতে পারেনি ভারত।
🔮
প্রধান উপদেষ্টার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম পশ্চিমবাংলা, ত্রিপুরা, আসাম জড়িয়ে ‘গ্রেটার বাংলা’র ম্যাপ হাজির করে ভারত ভেঙে নতুন বঙ্গভূমি কায়েমের ফর্মূলা দিল যা মোটেও ঝোঁকের বশে করা নয়।
এরপর শুরু হল ইউনূসের বাজে কথা এবং বেশি কথা বলা। এ কারণে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক সর্বকালের তলানিতে। নিজে স্বীকার করছেন-ভারতকে ছাড়া বাংলাদেশের অর্থনীতি পঙ্গু হয়ে যাবে। অথচ নিজেই ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক তিক্ত করে তুললেন।
তিনি এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা ভারতকে তীব্র ঘৃণা করে। ভারতের সঙ্গে ‘অসম’ চুক্তি বাতিলের হুমকি দেয়। ওই চুক্তি করা নিয়ে হাসিনা-ভারত উভয়েক তীব্র ভৎর্সনা করেছে ইউনূস বাহিনী অথচ হাসিনার আমলে করা দুদেশের চুক্তিগুলোর একটিও বাতিল করতে পারেনি। কেন করেনি বা পারেনি? সেই প্রশ্নের উত্তর নেই।
🔮
৮ আগস্ট ইউনূস ক্ষমতাসীন হওয়ার পর যে মোদী ইউনূসকে অভিনন্দন জানাল সেই মোদী কেন এখন বলছে-‘আমরা অবৈধ সরকারের সাথে বসব না’? কারণ, ইউনূস সরকার আর তার চ্যালাচামুন্ডারা দিনের পর দিন ভারতের পায়ে পা দিয়ে তিক্ততা বাড়িয়েছে।
ভারতীয় পণ্য বয়কট করুন বলে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে তুলল অথচ সেই ভারতের কাছেই অফিসিয়ালি ডিম, পেঁয়াজ, আদা-রসুন থেকে শুরু করে ৫০ হাজার টন চাল কমদামে চাইতে হয়েছে। যার মধ্যে ২৪ হাজার টন ইতোমধ্যে এসেছে। তা বাদে আরও ২৭ ধরণের পণ্য নিয়মিত আসছে।
এরপর হিন্দুদের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়ায় ভীত হয়ে চিন্ময় কৃষ্ণদাসকে গ্রেফতার করা হলো। কী লাভ হল এতে? ভারত সরকারিভাবে তাকে মুক্তি দিতে অনুরোধ করেছিল। রাখেনি। তার সঙ্গে জেল, জামিন নিয়ে যে তামাশা করা হয়েছে তাতে বিশ্বের কাছে দেশের আইন-আদালতের ভাবমূর্তি তলানিতে নেমেছে। ইউনূসের সরকারের সঙ্গে কোনোভাবেও চিন্ময় জড়িত নয়। হুমকি তো নয়ই। তারপরও জামাতের হাততালি পাওয়ার জন্য এবং ভারতকে চটিয়ে দেওয়ার জন্য এসব করলেন ইউনূস।
🔮
তারপর শুরু করলেন পাকিস্তানের সঙ্গে মাত্রাতিরিক্ত মাখামাখি, যেন ভারতকে দেখিয়ে দেয়া যায়। শেখ হাসিনার সময় কি পাকিস্তানের সম্পর্ক ছিল না? অবশ্যই ছিল। তখনও পাকিস্তানি পণ্য বাংলাদেশে যাওয়া-আসা করত। শ্রীলংকায় আনলোড হয়ে অন্য জাহাজে আসত। উনি করতে গেলেন ডাইরেক্ট। জাহাজ সরাসরি আসছে। সে জাহাজে ইন্সপেক্শন হয় না। ফলে বাংলাদেশের বিভিন্ন মহলসহ ভারত মনে করল ‘জাহাজে অস্ত্রশস্ত্র আসছে’! স্বভাবতই চটে গেল ভারত।
🔮
দেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে শেখ হাসিনা তো একা দেশ শাসন করেননি। জিয়া, এরশাদ, খালেদা, ফখরুদ্দীন সকলেই করেছেন। তারা কি পাকিস্তানকে এই সুযোগ দিয়েছিল? দেয়নি কারণ, সেটা দেশের জন্য জরুরি ছিল না। এই প্রথম আগবেড়ে পাকিস্তানকে ওয়াকওভার দিয়েছে ইউনূস। এতে বাংলাদেশের ফায়দা কিছু না্ হলেও পাকিস্তানের হয়েছে। তারা ভারত থেকে খাদ্য পণ্য কিনে চড়া দামে বাংলাদেশে রফতানি করছে।
এই যে আজ যেমন পাকিস্তানের গোয়েন্দ সংস্থা আইএসআই-এর চিফ ঢাকায় তাশরিফ রেখেছেন, সেটা নিশ্চয়ই শীতের শাকসব্জি কিংবা খেজুরের রস খেতে নয়! নিশ্চয়ই বড় কোনও ঘুটুরমুটুর চলছে যার ব্যাকফায়ার হয়ত শিগগিরই দেখা যাবে।
🔮
তিনি গেলেন রাজবাড়ীর সেনা মহড়ায়। সেখানে গিয়ে আগবেড়ে সৈনিকদের বলে বসলেন-‘যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে’। যখন বুঝলেন কথাটা ঠিক হলো না, তখন ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে বললেন-‘সৈনিকদের সর্বদা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়’। তিনি কি জানতেন না বাংলাদেশের তিন দিকের সীমান্তে ভারতই একমাত্র দেশ। তাই যুদ্ধের প্রস্তুতির কথা বললে মায়ানমারের সঙ্গে যুদ্ধ বোঝায় না?
এর মধ্যে তার আদেশে ভারত সীমান্তে তুরস্ক থেকে আনা ড্রোন ওড়ালেন ভারতকে ওয়ার্নিং দিতে। আরও ঘোষণা করলেন-তুরস্ক থেকে ট্যাঙ্ক কিনবেন। অথচ তিনি চাল কেনার পয়সা পাচ্ছেন না।
🔮
রাশিয়ার সাথে রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র’র দুর্নীতি নিয়ে ঝামেলা বাঁধালেন ইউনূস। ‘গ্লোবাল ডিফেন্স কর্পে’-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫০০ কোটি ডলারের বেশি অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে দুদক অভিযোগটি আমলে এনে তদন্ত করবে ঘোষণা করে। এর পর পরই রাশিয়ার প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা রোসাটম। তারা বিবৃতিতে বলে-‘হাসিনা পরিবারের ৫০০ কোটি ডলার আত্মসাতের তথ্য মিথ্যা’। এই খবর পৌঁছে প্রেসিডেন্ট পুতিনের কাছে। তিনি সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে বলেন-‘রোসাটম রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। এদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলা মানে রাশিয়ার বিরুদ্ধে তোলা। এটা বাংলাদেশকে প্রমাণ করতে হবে।‘
🔮
এরকম আরও খেলো এবং খোঁড়া যুক্তিতে একের পর এক তীর্যক আক্রমণ করে ভারতকে ‘শত্রু’ বানিয়েছেন। রাশিয়া ও মায়ানমারকে চটিয়েছেন। তারপর নির্বাচনে পরাজিত হয়েছে তাকে ক্ষমতায় বসানো বাইডেনের দল। এখন বাইডেনের সেইসব অনুচরদের বিচারের মুখোমুখি করবে ট্রাম্প। চীনকে পটাতে জামাতকে পাঠিয়েছিলেন। তারা খালি হাতে ফিরেছে। শেষ পর্যন্ত দেউলিয়া পাকিস্তান ছাড়া আন্তর্জাতিক মহলে ইউনূসের কোনও বন্ধু নেই।
ভারত এতদিন নিশ্চুপ থেকেছে। আবালবৃদ্ধবণিতার উসকানিতেও রা-কাড়েনি। এ জন্য ভারতের সরকার মিত্র ও বিরোধীদের রোষের মুখেও পড়েছে। আসলে ভারত এতদিন ‘মওকা’ খুঁজছিল। সেটা ট্রাম্পের বিজয়ের ফলে এসেছে। এবার ভারত নড়েচড়ে বসেছে। তারই আলামত হলো সীমান্তের অরক্ষিত অঞ্চলে কাঁটাতারের বেড়া। ভারতের মাটিতে অবৈধভাবে প্রবেশ করলে-‘শ্যুট অ্যাট সাইট’ সিদ্ধান্ত, এবং মধ্যপ্রদেশের একটি বেসরকারি সংস্থা যারা বাংলাদেশের ৬০/৭০ ভাগ খাদ্য পণ্যের সাপ্লায়ার, তাদের এক্সপোর্ট বন্ধ করা।
🔮
এর পর পরই আসতে যাচ্ছে মোদীর লবিংয়ে ট্রাম্পকে দিয়ে মুহাম্মাদ ইউনূসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ানো। ট্রাম্পের সঙ্গে ব্যক্তিগত টানাপোড়েন তো আছেই। সেইসঙ্গে মোদী-দোভাল-জয়সওয়ালের কূটচালে ট্রাম্প প্রশাসন থেকে স্যাঙ্কশন আসছে মোটামুটি নিশ্চিত। এসবের কিছুই ঘটত না যদি মুহাম্মদ ইউনূস জামাতসহ অপরাপর মৌলবাদী গোষ্ঠী এবং ভারতফোব-এ আক্রান্ত পাকিস্তানপন্থীদের উসকানিতে ‘আলাদীনের চেরাগ’ দিয়ে সবকিছু করতে পারার, সবাইকে দেখে নেওয়ার দম্ভ না দেখাতেন। তিনি বাংলাদেশ নিয়ে ‘জুয়ায়’ নেমেছেন। দেশের প্রায় ১৮ কোটি মানুষের ১৮ হাজারও নেই যারা তাকে সমর্থন করে। তারপরও এপাশের-ওপাশের ক্ষমতা বলে তিনি আওয়ামী লীগের উপরকার বিদ্বেষ নির্বিকারভাবে জনগণের উপর ঢালছেন। এটাই তার গত ছয় মাসের অ্যাচিভমেন্ট।