হামিমুর রহমান ওয়ালিউল্লাহ
“একীভূত অর্থনীতিতে এখন তো গ্রাম আর শহরে পার্থক্য নাই। টাকার অবনমন হয়েছে; এতে আমদানি খরচ বেড়েছে। বিভিন্ন পণ্যে ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। সুদের হার বেশি হওয়ায় উৎপাদন খরচও বেশি,” বলেন মুস্তাফিজুর রহমান।
গত ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৩৪ শতাংশ। অর্থাৎ আগের বছর একজন ভোক্তা যে পণ্য কিনেছেন ১০০ টাকায়, ২০২৪ সালে তাকে সে পণ্য কিনতে খরচ করতে হয়েছে ১১০ টাকা ৩৪ পয়সা।
প্রায় সারা বছর গ্রামের মানুষকেও পণ্য কিনতে এমন বাড়তি টাকা খরচ করতে হয়েছে। তার ওপর অর্থবছরের মাঝপথে এসে. অর্থাৎ নতুন বছরের জানুয়ারিতে শতাধিক পণ্য ও সেবায় মূল্য সংযোজন কর-ভ্যাট, আবগারি ও সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে সরকার।
রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য পূরণে সরকারের এই পদক্ষেপ মূল্যস্ফীতি আরও উসকে দেবে বলছেন অর্থনীতিবিদরা, তাতে গ্রামের স্বল্প ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ আরও চাপে পড়বে।
মূল্যস্ফীতির জটিল হিসাব না বুঝলেও গোপালগঞ্জের মকসুদপুরের রনি ঠাকুর বলছিলেন তার দুরবস্থার কথা। ক্যান্সারে বাবার মৃত্যুর পর পড়ালেখা ছেড়ে তিনি সংসারের হাল ধরেন। মা-ছেলে দুইজনের পরিবারের আয়ের একমাত্র উৎস কৃষি জমি।
জিনিসপত্রের উচ্চমূল্যের কারণে কুলিয়ে উঠতে না পারা বছর পঁচিশের রনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বোনের বাড়ির মেহমান এলে ‘রীতিমত বিপাকেই’ পড়ে যান তিনি।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে খরচের চাপ সামলাতে জমি বিক্রি করার কথা তুলে ধরে হতাশা প্রকাশ করেন রনি।
সরকারি হিসাবেই দেখা যায়, ২০২৪ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্তই খাদ্য বহির্ভূত পণ্যে মূল্যস্ফীতি শহর থেকে গ্রামে বেশি ছিল। এর সঙ্গে খাদ্য পণ্যেও এ ধারা দেখা গেছে এপ্রিল, অগাস্ট ও অক্টোবরে।
আন্দোলন, সংঘাত, বন্যা ও ক্ষমতার পালাবদলে সৃষ্ট অস্থিরতায় গ্রামে অগাস্ট ও অক্টোবরে এ ধারা দেখা গেলেও এপ্রিলের কারণ অজানা।
গ্রামে মূল্যস্ফীতি কেন বেশি, সেটি খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে, বিদেশ থেকে আমদানি করা ও অন্য এলাকা থেকে যোগান দেওয়া পণ্যের দাম চড়া।
কৃষিপণ্যের মধ্যে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের দাম তুলনামূলক কম থাকে। তবে অন্যগুলোর দামে শহরের সঙ্গে পার্থক্য কম। বরং মূল্যস্ফীতি বাড়লে কোনো কোনো পণ্যের দাম শহরের চেয়ে বেড়ে যায়।
মকসুদপুর এলাকার দোকানি নয়ন শেখ পেঁয়াজ, রসুন, মশলা পণ্যের সঙ্গে কিছু কাঁচামালও বিক্রি করেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সরকার বদলের সময় ও বন্যায় দাম চড়া থাকলেও এখন সবজির দাম পড়তির দিকে। সমস্যা হয় মশলা জাতীয় পণ্যে, যেগুলো অন্য জেলা থেকে আনতে হয়, সেগুলোর দাম বেশি।
“এগুলো তো আর আমাদের এলাকায় উৎপাদন হয় না। আমাদের কিনতে হয় মহাজন থেকে। তারা কেনে আবার বর্ডার অঞ্চল থেকে (আমদানি পণ্য)। এগুলোর দাম এখনও চড়া।”
কোন পণ্যের কেমন দাম জানতে চাইলে নয়ন বলেন, “ফুলকপি এখন ১০ টাকা কেজি। মুলা ৫ টাকা। মরিচ বিক্রি করি ৫০ টাকা কেজি। বেগুন এসবের দামও কম। এগুলো এখন আমাদের ইউনিয়নেই ক্ষেত করে (ফলায়)। এলাকায় ক্ষেত-খামারি আছে।
“কিছু আবার ইউনিয়নে নাই, কিন্তু উপজেলার মধ্যেই আছে। তাই এগুলো যখন যা লাগে আনা যায়। ঘাটতি নাই। দামও কম।”
তিনি বলেন, “রসুনের দাম ২০০ টাকার ওপর। জিরা ৬০০-৭০০ টাকা। শুকনা মরিচ ৫০০ টাকা। আমদানি করা যখন আসে তখন দাম কমে। দেশি পণ্য দিয়ে তো বাজার চলে না। এগুলোর ঘাটতি আছে।”
মাছের বাজার চড়া
একই এলাকার মাছ বিক্রেতা জলিল মাতবর বলেন, “সব মাছের দাম বেশি। আমরাই কমে পাই না। চাষের ভাল মাছ কিনতেও হাজার টাকা খরচা আছে।”
তবে প্রাকৃতিক উৎসের মাছের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আগে কই মাছ বিক্রি করতাম ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা। এখন হাজার টাকায় বিক্রি। শিং মাছের দাম ১০০০ টাকা থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা।”
গতবছর অগাস্টের বন্যায় পুকুর তলিয়ে মাছ বেরিয়ে যাওয়া বাড়তি দামের কারণ হতে পারে বলে মনে করেন এ ব্যবসায়ী।
চালের দাম গ্রামাঞ্চলে ঢাকার তুলনায় কিছুটা কম। কুমিল্লার লাকসাম এলাকার গোলাম কিবরিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তিনি ৫০ কেজির এক বস্তা ব্রি আটাশ চাল কিনেছেন ৩ হাজার টাকা দরে। এর আগে কিনেছেন ২ হাজার ৮০০ টাকা দরে।
গত সপ্তাহে ঢাকার মিরপুর এলাকার একটি দোকানে একই চাল ৫০ কেজির বস্তা বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ১৫০ টাকা দরে।
বেকারি পণ্যের দাম বেশি
মকসুদপুরের বেকারি ও কনফেকশনারি পণ্যের দোকানি সুমন বলেন, “সব পণ্যের দামই গত কয়েক মাসে বেড়েছে। ২-৫ টাকা করে বাড়ায় চোখে লাগেনি।”
কেক, বিস্কুট, শিশু খাদ্য, বিভিন্ন রকমের মিষ্টান্ন, চানাচুর, চিপস, চকোলেট, ফাস্ট ফুড ও বাসার প্রয়োজনীয় সামগ্রী রয়েছে তার বিক্রির তালিকায়।
এসবের কিছু পণ্যের ভ্যাট বেড়েছে চলতি বছরের বাজেটেই। তখন থেকেই দাম বেশি। অর্থবছরের মাঝপথে আবার সেসব পণ্যের কোনো কোনোটির ভ্যাট বেড়েছে।
সুমন বলেন, “শুনেছি ভ্যাট নাকি বাড়ছে। তবে এখনও আমার কাছে আসেনি। আমার দোকানে আগের দামেই পণ্য মিলছে এখনও। নতুন পেলে হয়ত বাড়বে।”
ফলের বাজারও চড়া অনেক আগে থেকে। বিদেশি ফলে বাড়তি শুল্ক আরোপ করায় আপেল, কমলা, মাল্টা, কমলা, খেজুর এসব পণ্যের দাম বেশি।
আমদানিকৃত এসব ফলের শুল্ক বাড়ানোয় আবার দাম চড়তে দেখা যায় গ্রামীণ বাজারে।
সরকারি হিসাব কী বলছে
মূল্যস্ফীতি বা দাম বাড়ার পরিসংখ্যান ও সময়ের সঙ্গে এর ওঠা-নামার পরিসংখ্যান প্রকাশ করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)।
সংস্থার হিসাবেই গ্রামাঞ্চলে খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি শহরাঞ্চলকে ছাড়িয়ে যাওয়ার রেকর্ড ছিল বিদায়ী বছরের নয় মাস জুড়েই।
এর মধ্যে তিনমাস কৃষি প্রধান এ দেশের গ্রাম এলাকার খাদ্য মূল্যস্ফীতিও ছাড়িয়ে গিয়েছিল শহরকে।
এ তিন মাসের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এপ্রিলে গ্রামে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ২৫ শতাংশ, যা শহরে ছিল ১০ দশমিক ১৯ শতাংশ। অগাস্টে গ্রামে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৪৪ শতাংশ; যেখানে শহরে ছিল ১১ দশমিক ২৪ শতাংশ।
অন্যদিকে অক্টোবরে গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং শহরে ছিল ১২ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
টানা নয় মাসে খাদ্য বহির্ভূত পণ্যে গ্রামে যে উচ্চ মূল্যস্ফীতির ধারা রয়েছে, সেখানে দেখা যায়, এ সময়ে সবচেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতি ছিল অগাস্টেই, ক্ষমতার পালাবদলের মাসে। সে সময়েই প্রথমবারের মত গ্রামাঞ্চলে খাদ্য বহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতিতে দুই অঙ্কের ঘরে দেখা যায়।
সে মাসে ১০ দশমিক ৪৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতি ছিল খাদ্য বহির্ভূত খাতে। শহরে খাদ্য বহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতি কখনও দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছায়নি। সবশেষে বেশি ছিল মার্চে; যখন খাদ্য বহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭১। শহরে খাদ্য বহির্ভূত এ খাতে মূল্যস্ফীতি আটের ঘরেও দেখা যায় জুন মাসে।
মূল্যস্ফীতির হিসাব কীভাবে
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তির শর্ত হিসেবে বেশকিছু জায়গায় পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। তখন আইএমএফের পরামর্শেই ২০২৩ সাল থেকে মূল্যস্ফীতি হিসাবের পদ্বতিতেও বেশ কিছু পরিবর্তন আনে।
তখন থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরকে ভিত্তি বছর ধরে মূল্যস্ফীতি হিসাব করা হচ্ছে। এর সঙ্গে মূল্যস্ফীতি আমলে নেওয়ার জন্য পণ্য এবং সেবার সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ৩৮৩ ধরনের ৭৪৯ পণ্য; আগে হিসাব করা হতো ৪২২টি পণ্যের বাজার দরের ভিত্তিতে।
নতুন হিসাবের আওতায় এসেছে মদ, সিগারেট, বেভারেজ ও মাদকদ্রব্য, সন্তানের শিক্ষার খরচ, পরিবারের ইন্টারনেটের খরচ, রেস্টুরেন্ট ও হোটেলে খাবারের খরচসহ আরও বেশ কয়েকটি খাত।
নতুন পণ্য এবং সেবার সঙ্গে যোগাযোগ খাতে ইন্টারনেটের ব্যবহার যুক্ত হয়েছে।
সব মিলিয়ে মূল্যস্ফীতির হিসাবের মধ্যে রয়েছে খাদ্য এবং অ্যালকোহলবিহীন পানীয়, অ্যালকোহলযুক্ত পানীয়, তামাক, পোশাক, পাদুকা বা জুতা, আবাসন, জল, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও অন্যান্য জ্বালানি, গৃহসজ্জার সামগ্রী, গৃহস্থালীর সরঞ্জাম ও ঘরের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ, স্বাস্থ্য, পরিবহন, যোগাযোগ, বিনোদন ও সংস্কৃতি, শিক্ষা, রেস্তোরাঁ ও হোটেলসহ বিভিন্ন পণ্য ও পরিবেষা।
বিভিন্ন পণ্য ও সেবায় মানুষের খরচের হিসাবের ভিত্তিতে প্রতি মাসে ভোক্তা মূল্য সূচক (সিপিআই) তৈরি করা হয়। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় এসব পণ্যে ও সেবায় মূল্য কত বাড়ল, তার শতকরা হারই পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতিতে রাখা হয় এবং ১২ মাসের গড় হিসাব করে তৈরি হয় বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতির তথ্য।
এ পদ্ধতি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হলেও এর বেশিরভাগ পণ্যের বা সেবার মূল্য সহজেই উঠা-নামা করে না; ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বা সেবা ভোগ করতে গিয়ে দেশের জনগণ কতটা হাঁসফাঁস করছে তার চিত্র কমই উঠে আসে মূল্যস্ফীতির গড় হিসাবে।
মূল্য সংগ্রহ যেভাবে
বিবিএস সারাদেশের ১৫৪টি জায়গার প্রধান বাজার থেকে মূল্যের তথ্য সংগ্রহ করে। এর মধ্যে শহরের ৯০ ও ৬৪ জেলার গ্রামাঞ্চলের প্রধান বাজার থেকে একটি করে।
শহরের মধ্যে রয়েছে ঢাকা শহর থেকে ১২টি, চট্টগ্রাম শহর থেকে ৪টি, অন্যান্য ৬টি বিভাগীয় শহর থেকে ১৮টি, অন্যান্য ৫৬টি জেলা থেকে ৫৬টি।
প্রতিটি বাজার থেকে এসব পণ্য ও সেবার তিনটি মূল্য সংগ্রহ করা হয়। গ্রামে ও শহরের উভয় ক্ষেত্রেই ২৪২ রকমের ১২৭টি খাদ্য পণ্যের পাশাপাশি ৫০৭ রকমের ২৫৬টি খাদ্য বহির্ভূত পণ্যের মূল্য সংগ্রহ করা হয়।
মূল্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে গ্রামে ও শহরে মাসে একবার এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে প্রতি সপ্তাহে মূল্য সংগ্রহ করা হয়। এসব তথ্য সাধারণত প্রতিটি বাজারের নির্দিষ্ট দোকান থেকে সংগ্রহ করা হয়। পরিষেবার ক্ষেত্রে নির্বাচিত ইউনিট বা পরিষেবাদাতা থেকে সংগ্রহ করা হয়।
পরে মূল্যস্ফীতির সূচক তৈরিতে প্রতিটি পণ্যের গড় মূল্য বিবেচনা করা হয়।
আলাদা করে খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতির হিসাব করা হয়; এটি গ্রাম ও শহরের ক্ষেত্রেও আলাদা করা হয়। এবং সবগুলো মিলিয়ে গড়ে একটি সার্বিক মূল্যস্ফীতির চিত্রও দেখানো হয়।
গ্রামের আসল চিত্র উঠে আসে কমই
বিবিএস যেভাবে মূল্যস্ফীতির হিসাব করে তাতে প্রত্যন্ত অঞ্চলের চিত্র কমই আসে। তাছাড়া নির্ধারিত দোকান থেকে তথ্য নেওয়ায় প্রকৃত চিত্র না পাওয়ার শঙ্কা থেকেই যায়।
বিবিএসের যারা মূল্যস্ফীতির সূচক তৈরির দায়িত্বে রয়েছেন তাদের ভাষ্য অবশ্য ভিন্ন। যুক্তি হিসেবে তারা আন্তর্জাতিক প্রটোকলের কথা বলেন।
সংস্থাটির এক জৈষ্ঠ্য কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা বাজারে যে দাম পাচ্ছি, তাই-ই তুলে ধরছি। এখন উপজেলা, ইউনিয়ন অনেক বিষয় থাকলেও আমাদের তার সুযোগ নাই।
“সারা বিশ্বেই জাতিসংঘের একটা পদ্ধতি আছে মূল্যস্ফীতি নিরূপণের। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ কারো নাই; আমাদেরও নাই।”
তবে আইএমএফের মডেলে অনেক পণ্য থাকায় মূল্যস্ফীতির চিত্র বোঝা কঠিন বলে নতুন করে যেসব পণ্যের দাম কমবেশি স্থির, তাদের নিয়ে একটি তালিকা করার কথা রয়েছে।
বিবিএসের এ কর্মকর্তা বলেন, “বর্তমানে আইটেম অনেক বেশি। অর্থনীতিবিদ ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে পরামর্শ করে পরবর্তীতে নতুন একটি তালিকা করা হবে। যেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও দাম তুলনামূলক স্থির থাকে, এমন পণ্যের আলাদা তালিকা করা হবে।”
মূল্যস্ফীতি নির্ধারণে তালিকায় থাকা অ্যালকোহলবিহীন পানীয়, অ্যালকোহলযুক্ত পানীয়, তামাক, আবাসন, জল, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও অন্যান্য জ্বালানি, গৃহসজ্জার সামগ্রী, গৃহস্থালী ও ঘরের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের সরঞ্জাম, স্বাস্থ্য, পরিবহন, যোগাযোগ, বিনোদন, সংস্কৃতি ও শিক্ষা পণ্য ও পরিষেবার দাম সাধারণত হঠাৎ ওঠা-নামা করে না।
সরকারের তরফে বা অন্য যে কোনো কারণে দাম বাড়লেও সে দামেই আবার স্থির থাকে।
মূল্যস্ফীতি হিসাব করার ক্ষেত্রের এসব পণ্যের মূল্য অন্তর্ভুক্ত করায় এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে থেকে মূল্যের তথ্য সংগ্রহ না করায় গ্রামের মূল্যস্ফীতির তথ্য কমই উঠে আসে।
দাম হঠাৎ ওঠা-নামা করে চাল, ডাল, ভোজ্য তেল, পেঁয়াজ, মরিচ, কাঁচামাল ইত্যাদির ক্ষেত্রে। সরবরাহে কোনো কারণে সংকট তৈরি হলেই তার প্রভাব পড়ে তাৎক্ষণিক বাজারে। এর সঙ্গে সিন্ডিকেট করে ও কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়ানোর ব্যাপার তো আছেই।
বিবিএস পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের একটি সংস্থা। এ দপ্তরের উপদেষ্টা নিজেই এর তথ্য, কীভাবে এসব পরিমাপ ও নিরূপণ করে তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
৮ জানুয়ারি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠক পরবর্তী ব্রিফিংয়ে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বিবিএসের সাম্প্রতিক প্রকাশিত তথ্য নিয়ে নিজের সন্দেহের কথা বললেও তা ‘চোখ বন্ধ করে’ প্রকাশ করে দিতে হয় বলেছেন।
বিবিএস প্রকাশিত সর্বশেষ জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, “এখন পর্যন্ত যেহেতু আগের নিয়ম বলবৎ আছে কাজেই চোখ বন্ধ করে প্রকাশ করে দিতে হয় আমাকে। কিন্তু আমি ওটা দেখিও না।”
জিডিপি বিষয়ে কথা বললেও উপদেষ্টা বিবিএস নিয়ে উপদেষ্টার সন্দেহের কথা ছিল সামগ্রিক অর্থে। নতুন পরিসংখ্যা আইন হলে সার্বিক পরিস্থিতি বদলের আশাও প্রকাশ করেন তিনি।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, “আমাদের নতুন যেই সংশোধিত পরিসংখ্যান আইন তৈরি করতে যাচ্ছি, আশা করি করতে পারব। সেখানেও বিবিএস তাদের যতটুকু সক্ষমতা আছে এবং বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় প্রবৃদ্ধির হিসাব, মূল্যস্ফীতির হিসাব, কর্মসংস্থানের হিসাব, মজুরির হিসাব এগুলো তারা যা দেয় সেটাই পাবলিশ করতে পারবে।”
গ্রামে কেন বেশি?
বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন মনে করেন, গ্রামীণ পর্যায়ে মূল্যস্ফীতি বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ হতে পারে মূল্যস্তর কম হওয়া।
তিনি বলেন, “মূল্যস্ফীতি আর মূল্যস্তর এক জিনিস না। চাল, ডাল, মাছ এগুলোর কিন্তু মূল্য কম গ্রামে। সমস্যা হলে মূল্য কম হওয়ায় এখানে যখন মূল্যস্ফীতি হয়, তখন হার বেশি দেখায়।”
উদাহারণ দিয়ে জাহিদ হোসেন বলেন, “ধরা যাক একই পণ্যের এক জায়গায় দাম ৫০ টাকা, অন্যখানে তার দাম ১০০ টাকা। এখন উভয় জায়গায় দাম পাঁচ টাকা বাড়লে নিম্নস্তরের মূল্যের ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির হার বাড়বে ১০ শতাংশ; উচ্চ মূল্যস্তরের জায়গায় এটি হবে ৫ শতাংশ।”
গ্রামের ক্ষেত্রে যেহেতু কৃষি পণ্যের মূল্যস্তরই কম, ইদানীং কালে দাম বাড়ায় মূল্যস্ফীতি তাই এ ক্ষেত্রে বেশি হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
যেসব পণ্য আমদানি করা হয়, তা সরবরাহ হয়ে গ্রামে পৌঁছাতেও বাড়তি পরিবহন খরচ লাগে, সে কারণে এসব খাদ্য পণ্য ও খাদ্য বহির্ভূত পণ্যের দাম সেখানে বেশি হবে বলেছেন এই অর্থনীতিবিদ।
তিনি বলেন, “চট্টগ্রাম বন্দরে মাল খালাস হয়ে যে দাম হয়, কুষ্টিয়ায় যেয়ে তো আর সে দাম থাকবে না।”
গ্রামীণ পর্যায়ে মূল্যস্ফীতি বাড়ার বড় কারণ হিসেবে সামষ্টিক অর্থনীতির চলমান সংকটকেই তুলে ধরেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ-সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান।
তিনি বলেন, “একীভূত অর্থনীতিতে এখন তো গ্রাম আর শহরে পার্থক্য নাই। গ্রামে উচ্চ মূল্যস্ফীতি না হওয়ার কোন কারণ নেই।
“টাকার অবনমন হয়েছে; এতে আমদানি খরচ বেড়েছে। বিভিন্ন পণ্যে ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। সুদের হার বেশি হওয়ায় উৎপাদন খরচও বেশি।
“বিনিয়োগের জন্য ব্যবসায়ীরা যে ঋণ নিয়েছেন এখন পরিশোধ করতে হচ্ছে তার লক্ষ্যের চেয়ে বেশি। এ অবস্থায় উৎপাদন বাড়িয়ে যে সরবরাহ বাড়াবেন, তা পারছেন না।”
তিনি বলেন, “আশা করেছিলাম, সরকার জোরালোভাবে সরবরাহ চেইনে ব্যত্যয় যেন না হয় সেটি নিশ্চিত করবে। মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য যেন না হয় সেটি নিশ্চিত করবে। কিন্তু তারা সেটা পারেনি।”
অর্থবছরের মাঝপথে আবার ভ্যাট বৃদ্ধি
অর্থবছরের মাঝপথে এসে জাতীয় রাজস্ব রোর্ড-এনবিআর ৯ জানুয়ারি শতাধিক পণ্য ও সেবায় মূল্য সংযোজন কর-ভ্যাট, আবগারি শুল্ক ও সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে।
এ তালিকায় রয়েছে ওষুধ, রেস্তোরাঁ, মিষ্টি, ফল, পোশাক, টিস্যুসহ বর্তমান সময়ের জরুরি সব পণ্য। ভোক্তা পর্যায়ে ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে ৫ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়। এসব পণ্যের মধ্যে প্রক্রিয়াজাত খাবারও আছে।
সরকারের এই পদক্ষেপের সমালোচনা এসেছে ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, অর্থনীতিবিদদের কাছে থেকে।
১৬ জানুয়ারি বাংলাদেশে অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) এক সংবাদ সম্মেলনে প্রাণ আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী বলেন, “এনবিআর তো কোম্পানির কাছে ভ্যাট চায়; পণ্যের দামের সঙ্গে ভ্যাট যুক্ত থাকে। এখন ভ্যাট বাড়ালে পণ্যের দামও তো বাড়াতে হবে, নইলে ওজন কমাতে হবে।”
সমাধান কী
মূল্যস্ফীতির তালিকায় পণ্য ও সেবার সংখ্যা বেশি থাকায় প্রকৃতি চিত্র বোঝা যায় না। তাই ‘কোর ইনফ্লেশন’ বের করে সেভাবে সরকারকে নীতি গ্রহণের পরামর্শ অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনের।
তিনি বলেন, “এখানে বাস্কেট (পণ্য তালিকা) এত বেশি বড়, এগুলোর অনেক পণ্যের তেমন বেচাকেনাও নাই। এইজন্যই কোর ইনফ্লেশনের আইডিয়া। সারা বিশ্বেই এটা আছে।
“এখান থেকে খাদ্য ও জ্বালানি বাদ দেওয়া হয়। যেসব পণ্যে হঠাৎ কোনো এক্সটার্নাল কারণে মূল্য বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে, সেগুলো বাদ দিয়ে করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক বিবিএসের তথ্য নিয়ে এটার হিসাব করে, কিন্তু নিয়মিত প্রকাশ করে না।”
বাড়তি মূল্যস্ফীতি ও ভ্যাট বাড়ানোর প্রভাব গ্রামের মানুষ কীভাবে সামাল দেবে, এই প্রশ্নে উত্তরে তিনি বলেন, এখানে স্বল্প মেয়াদী নীতি নিয়ে সমাধান খুব কঠিন। শুধু সংকোচন নীতি দিয়ে হবে না।
“বাজারের যে সমস্যা আছে, চাঁদাবাজি বন্ধ ও সরবরাহ সংকট কাটানো, তা লাগবে। তবে স্বল্প মেয়াদে গ্রামে সেটাও কঠিন। এক্ষেত্রে বাজেট সহায়তার মাধ্যমে তাদের স্বস্তি দেওয়ার পরামর্শ দেন এ অর্থনীতিবিদ।
তিনি বলেন, “স্বল্প মেয়াদে বাজেটের মাধ্যমে সামাজিক সহায়তা কর্মসূচি যোগ না করলে তাদের স্বস্তি মিলবে না। তাদের তো আয়ও কম। গ্রামে আয় বাড়ছে না।
“ফলে এখানে কেবল মূল্যস্ফীতি কমালেই হবে না; মূল্যস্তরও কমাতে হবে। সঙ্গে কর্মসংস্থান এবং সামাজিক সহায়তা না বাড়ালে কষ্টটা থেকেই যাবে।”
সময়মত আমদানি, উৎপাদন ও বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করে মধ্য মেয়াদি বিনিয়োগ ও উৎপাদন বৃদ্ধি, স্বল্প মেয়াদে নিম্ন ও স্থির আয়ের মানুষের জন্য ফ্যামিলি কার্ড করা, টিসিবির পণ্য সরবরাহ বাড়ানোর মাধ্যমে এ সমস্যার স্বল্প ও মধ্য মেয়াদে সমাধানের পরামর্শ দিয়েছেন আরেক অর্থনীতিবিদ মুস্তাফিজুর রহমান।
বিডি নিউজ টুয়ানটিফোর ডট কম।