হরিশংকর জলদাস
আগের বইমেলা আমার কাছে অনেক মনোমুগ্ধকর ছিল। প্রাণবান ছিল। এখন দেশে তো একটি বিপ্লব হয়ে গেছে। এই বিপ্লবের কারণে মেলায় ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া কী হয় এবার নিজের চোখে দেখব। বাস্তব অভিজ্ঞতায় যখন দেখব, তখন হয়তো উভয় মেলা নিয়ে মূল্যায়ন করা যাবে। তবে আমি আশা করছি, বইমেলা সব সময় যেহেতু আনন্দের মেলা হয়, প্রাণের মেলা হয়, এবারও তেমনি আনন্দমুখর হবে।
প্রথমত, বাংলাদেশের বইমেলা হলো দীর্ঘতম বইমেলা। পৃথিবীর আর কোনো দেশে এত দীর্ঘ মেলা হয় না। ফ্রাংকফুট, লেবানন, মিসর, লন্ডন, প্যারিস, আমেরিকা—কোথাও এত দীর্ঘদিন ধরে বইমেলা হয় না। এমনকি ভারতেও এত দীর্ঘ হয় না। এবার যেমন কলকাতার বইমেলা শুরু হলো মাত্র বারো দিনের জন্য। এত দীর্ঘ সময় লেখক-পাঠককে ধরে রাখা একটা কৃতিত্বের বিষয়। বাঙালিদের ভেতর এক ধরনের আবেগ কাজ করে। মেলা যখন শেষের দিকে পৌঁছে যায় তখন সাহিত্যপ্রেমী, লেখক-পাঠকদের অনেককে বলতে শুনেছি যে আরো কয়েক দিন যদি বইমেলাটা বাড়ানো যেত, আরো আনন্দ হতো। এই বিষয়গুলো সব সময় আমাদের আক্ষেপ দিয়ে আসছে। তবু তো একটা সময় বইমেলা শেষ হয়। আরো একটা কথা স্বীকার করতেই হবে। আমাদের বইমেলা শুরু হওয়ার পর প্রথম প্রায় দশ-পনেরোটা দিন প্রকাশকরা বই নিয়ে বসে থাকেন। বইমেলা নিষ্প্রাণ হয়ে থাকে। পনেরো দিনের পরই পাঠকরা আসতে থাকে। তবু আমি বলব, দীর্ঘ বছর ধরে এই আটাশ বা উনত্রিশ দিনের যে মেলাটি হয়ে আসছে, তা এভাবেই চলুক। আরো উজ্জ্বল হোক, আরো প্রাণময় হোক।
আমার কাছে যেটা মনে হয়, বইমেলায় তো শুধু তরুণরা যায় না, প্রবীণরাও যান। তাঁরা বই কেনেন ভালো। শুনতে খারাপ লাগলেও আমি বহু বছর ধরে দেখেছি, তরুণ-তরুণীরা হাত ধরাধরি করে মেলায় ঢুকে হাত ধরাধরি করেই বের হয়ে যায়। তাদের হাতে কোনো বইয়ের প্যাকেট থাকে না। অনেকেই সেখানে আনন্দবিলাস করতে যায়। যত মানুষ মেলায় যায়, তারা যদি প্রত্যেকে একটা বইও কিনত, তাহলে বইমেলার কী যে স্বর্গীয় অবস্থা হতো, তা বলে বোঝানোর মতো না।
বইমেলায় যাঁরা যান, বই কেনেন, সেই প্রবীণদের জন্য, এমনকি তরুণদের জন্যও তাঁরা হাঁটতে হাঁটতে প্রায়ই ক্লান্ত হয়ে পড়েন। তাঁদের জন্য যদি বসার সুব্যবস্থা থাকত, ভালো হতো। তারপর ওয়াশরুমও পর্যাপ্ত নয়। বিশেষত নারীদের জন্য এটি বেশ জরুরি। বিশ্বের অনেক দেশের বইমেলায় মুভিং ওয়াশরুম আছে। আমাদেরও থাকা দরকার। এ ছাড়া পানীয় জলেরও সুব্যবস্থা করা খুবই জরুরি।
মেলায় মানুষকে অপমান করার যে প্রবণতা, এগুলো বাদ দেওয়া উচিত। গত বইমেলায় এমন হয়েছে। কোনো লেখক আমাদের পছন্দ নয় বলে তাঁকে দুয়োধ্বনি দিয়ে, মিছিল করে মেলা প্রাঙ্গণ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। এমনটি উচিত নয়। প্রত্যেক লেখকের লেখার অধিকার আছে। বই প্রকাশের অধিকার আছে। সে বই যদি রাষ্ট্রদ্রোহের বই না হয়, ধর্মে আঘাত করা না হয়, তাহলে সমস্যা কোথায়। প্রত্যেক লেখকেরই সম্মান আছে। সেটুকু তাদের দেওয়া উচিত। কারো বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা, অপদস্থ করার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে বলে মনে করি।
এ ছাড়া বইমেলা আরো উচ্ছ্বাসপূর্ণ, প্রাণবন্ত করার জন্য বাংলা একাডেমিরও বেশ ভূমিকা আছে। প্রকাশকরা বহু বছর ধরে চেয়েছেন এই মেলা আয়োজনের দায়িত্ব। তাঁরা বারবার বলছেন, মেলায় নতুনত্ব আনবেন। কিন্তু বাংলা একাডেমি তা করছে না। অথচ তারা নতুন কিছু করতে পারছে না। ঘুরেফিরে সেই পুরনো পরিচালনা পদ্ধতিতেই প্রতিবছর মেলা পরিচালনা করছে। সময় পাল্টেছে, সব কিছু আধুনিক হচ্ছে। বইমেলায়ও আধুনিকতার ছোঁয়া লাগতে হবে। তা না হলে পরিচালকদের হাতে বইমেলার দায়িত্ব তুলে দওেয়া উচিত। তাতে বইমেলা আরো আর্কষণীয় হবে।
এবার বইমেলায় আমার দুটি বই বের হচ্ছে। একটি পৌরাণিক উপন্যাস ‘শূর্পণখা’। বের করবে কথাপ্রকাশ। অন্যটি ‘ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া’, ভ্রমণ বই বাতিঘর থেকে বের হচ্ছে।