কৌশিক মজুমদার
বাঙালী ঠিক কবে থেকে ভালবাসতে শিখল? আর তা খুঁজতে গিয়েই যা দেখলুম, তাতে একগাল মাছি। বাঙালী এই হালে ভালবাসতে শিখেছে। প্রাচীন যুগ তো বাদই দিন মশাই, এমনকি মধ্য যুগেও বাঙালী ভালবাসত না। খেয়াল করবেন এতজন বৈষ্ণব কবি এত এত লাইন প্রেমের কবিতা লিখে মন আর চোখ ভরালেন, তাঁদের একজনও একটি লাইনেও ” ভালবাসা” শব্দটা লিখলেন না!!!
তবে তাঁরা কি লিখতেন? লিখতেন মূলতঃ প্রেম, প্রীতি আর তাঁর চেয়েও বেশী ” পিরীতি”। চণ্ডীদাস লিখেছেন,
“কালিয়া প্রেমের মধু” কিংবা
” আমি তো দুঃখিনী, কুলকলঙ্কিনী/ হইনু করিয়া প্রীত” অথবা
” আপন সুখেতে করে যে পিরীতি/ তাহারে বাসিব পর”।
শেষ বাক্যটা মনে রাখবেন পিরীতির সঙ্গে “বাসিব” শব্দটাও আছে। ওটা আমাদের পরে কাজে লাগবে।
তাহলে ঠিক কবে ভালবাসা এই পিরীতি- কে হটিয়ে দারুণভাবে আমাদের মনের কোমল পর্দায় রিনরিনে ধ্বনি তুলল? একই সঙ্গে প্রীতি নেহাত শুভেচ্ছার বড় বোন হয়ে আর পিরীতি নাম বদলে পিরিত হয়ে বেশ একটা অশ্লীল অশ্লীল গন্ধ বয়ে নিয়ে এল? ( অবশ্য ইদানীং আবার পিরীতি গানে জায়গা পাচ্ছে, প্রেম পিরিতে হাবুডুবু পরাণ আমার যায়/ বুকটা করে সামথিং সামথিং টেল মি উপায়… ইত্যাদি। মানে পিরিতের দিন ফিরছে বোধহয়য়)… পাশাপাশি প্রেম বেশ গম্ভীর। সিরিয়াস সিরিয়াস ব্যাপার। ” হাবুদা আর পেঁচিদি পিরিত করে”, “হাবুদা আর পেঁচিদি ভালবাসে” আর “হাবুদা আর পেঁচিদি প্রেম করে”… বলে দেখুন লাস্টটা নিজের কানেই কেমন কেমন ঠেকবে। হাবু আর পেঁচি নাম থেকে গোটা স্পটলাইট প্রেমে গিয়ে পড়বে। আমাদের হোস্টেলে এক দাদা ছিল। মাঝে মাঝেই তাঁর প্রেমিকার ফোন আসত। সে তীব্র থমথমে মুখে ফিসফিস করে কীসব যেন বলত। একবার এক নভিস “কি হয়েছে দাদা? সিরিয়াস কিছু?” বলাতে ” দেখছিস না প্রেম কচ্ছি!” বলে মুখঝামটা খেয়েছিল।
সে যাই হোক। ভালবাসা শব্দের কথা বলছিলাম। ভালবাসার দুই অংশ- ভাল আর বাসা। এর মধ্যে ভাল শব্দটা আদৌ বাংলা না। হিন্দি বা মৈথিলী। স্বয়ং গুরুদেব লিখেছেন “ভালো’ শব্দ ভদ্র শব্দজ, “বড়ো’ বৃদ্ধ হইতে উৎপন্ন, “ছোটো’ ক্ষুদ্র শব্দের অপভ্রংশ। মূল শব্দগুলির শেষবর্ণ যুক্ত– যুক্তবর্ণের অপভ্রংশে হসন্ত বর্ণ না হওয়ারই সম্ভাবনা।” সোজা কথায় ভাল আছি মানে ভদ্রস্থ আছি। ঠিকঠাক আছি। চলে যাচ্ছে। আর “বাসা” শব্দ বাসনা- র উৎস। ১৩১৭ সালে সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায় খগেন্দ্রনাথ মিত্র লিখেছেন ” বাসি শব্দটিও এখন বাসি হইয়া গিয়াছে। যদিও বিক্রমপুর অঞ্চলের সম্ভাষণে ” কেমন বাসতে আছেন?” শুনা গিয়া থাকে।” বাসা শব্দের মানে তাই ইচ্ছে, আকুতি।অর্থাৎ, ভালবাসা মানে ভদ্রস্থ থাকার বাসনা। যা মোটামুটি সবার থাকে…
হায় রে! এদিকে কালে কালে তাঁর মানে এমন বদলেছে যে অভিধান খুললে ভালবাসা মানে পাই “কোনও জিনিস বা ব্যক্তি-বিশেষকে প্রাণাধিক বলে জ্ঞান করা; মনোমত মনে করা; প্রীতি, স্নেহ বা শ্রদ্ধা করা….”
এখানেই শেষ করা যেত। কিন্তু করব না; বাসা নিয়ে আর দু চারটে কথা বলবই। এই যে ফেবু জুড়ে কবিতাবাসা, আদরবাসা নিয়ে এত্ত এত্ত খিল্লী, কথাগুলো কি ভুল? ব্যাক টু চন্ডিদা থুড়ি চণ্ডীদাস…
১। ” তোমরা মোরে ডাকিয়া শুধাও না প্রাণ আনচান বাসি”
২। ” কে সাজাল হেন সাজে হেরি বাসি দুখ”
৩। “পরাণ অধিক বাসে”
৪। ” কহিতে বাসি যে ভয়”
কেলো করেছে!! ভদ্রলোক করেছেন টা কি!! আনচান বেসেছেন, দুখ বেসেছেন। অধিক বেসেছেন, পর বেসেছেন আবার ভয়ও বেসেছেন? (যদিও ভালবাসেন নি)
ভাগ্যিস ফেসবুক ছিল না। তাহলে বিদ্যাপতি, বড়ু চণ্ডী আর জুনিয়ার নরহরি সরকার , বাসু ঘোষ, লোচন দাস,জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস একেবারে ট্রোল করে করে মেরে দিত!!
যাই হোক। মরালটা কি খাড়াইল? “সব সত্যি। কবিতাবাসা সত্যি,
গল্পবাসা সত্যি, প্রবন্ধবাসা… মে বি সত্যি, আদরবাসা সত্যি, মনের কথা ফোনের সেটে সত্যি….”
হ্যাপ্পি ভ্যালেন্টাইনস ডে।