মনজুরুল হক
সহসা নির্বাচন হচ্ছে না। অন্তত গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ছয় সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনুস যে মন্তব্য করেছেন তাতেই বোঝা যাচ্ছে। ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’ বৈঠক নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো যে আশাবাদের বেলুন ওড়াতে শুরু করেছেন তা ফাটতে সময় লাগবে না। বৈঠকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এলডিপি, জাতীয় পার্টি (কা.জা), নাগরিক ঐক্য, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিশ, গণসংহতি আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটি, গণঅধিকার পরিষদ, কয়েকটি বাম গণতান্ত্রিক দলসহ ২৬টি দল অংশ নেয়। অবশ্য অধিকাংশ মিডিয়া বামদের নামোচ্চাারণ করেনি! ৪৯টি নিবন্ধিত দলের এক-তৃতীয়াংশ দলের বৈঠককেই ইউনূসের প্রেস উপদেষ্টা ‘সকল রাজনৈতিক দলের বৈঠক’ বলছেন। এ নিয়ে অবশ্য অংশ নেওয়া দলগুলোর মনে কোনও প্রশ্ন ওঠেনি।
📍
বৈঠকের সভাপতি ড. ইউনূস। সঙ্গে ছিলেন ছয় কমিশনের প্রধানগণ এবং ঐকমত্য কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক আলী রীয়াজ। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, “ছয় কমিশনের পুরো প্রতিবেদন নিয়ে দেশের রাজনৈতিক দল ও সিভিল সোসাইটির সঙ্গেও কথা বলবে ঐকমত্য কমিশন।“
তার মানে আবারও এই কয়টি দলের সঙ্গে আগামী মার্চে গঠিতব্য ছাত্রদের নতুন দল ও অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্যদের আরেকটি দল নিয়েই কাজকারবার হবে।
📍
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, “জুলাই—আগস্টে যে অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান হলো তার পরবর্তিতে বাংলাদেশের পূর্ণজন্ম, এটা যে একটা পলিটিক্যাল সলিউশনে আমরা যাচ্ছি, কীভাবে ডেমোক্রেটিক ট্রানজিশন হবে তার একটি সূচনা। আমরা আশা করছি, ছয়টা কমিশন যে রিপোর্টগুলো দিয়েছে সেগুলো নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পলিটিক্যাল পার্টির এই কমিশনের আলাপ হবে। ঐকমত্যের ভিত্তিতে যে সিদ্ধান্ত হবে, রাজনৈতিক দলগুলো তাতে স্বাক্ষর করবে সেটাই হবে ‘জুলাই চার্টার’। সেই জুলাই চার্টারের ওপর নির্ভর করে আমাদের নির্বাচনের তারিখটা হবে। আপনারা দেখেছেন যে, প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, মোস্ট লাইকলি ইলেকশনটা হবে ডিসেম্বরের মধ্যে।”
📍
কী বোঝা গেল? গত ছয় মাসে দেখা গেছে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ, জুলাই-আগস্ট ঘোষণাপত্র, সংবিধান বাতিল, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধকরণসহ অনেকগুলো ইস্যুতে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ তৈরি করে রেখেছিল। প্রতিপক্ষের ওপর চরম অরাজকতা, অস্থিরতা, জনজীবনের উৎকণ্ঠা, চরম অনিরাপত্তা, সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন, অর্থনীতির নাভীশ্বাস, মবভায়োলেন্স, মুক্তিযুদ্ধের সকল স্থাপনা আর স্মৃতিচিহ্ন ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার মত কাজগুলো নির্বিঘ্নে করতে দিয়েছে সরকার। উল্টো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সরকারি টাকায় ‘কিংস পার্টি’ গঠনের উদ্যোগ নিয়ে কেটেছে তাদের ‘প্রথম ইনিংস’। এবার তারা শুরু করবেন-‘দ্বিতীয় ইনিংস’।
📍
কী কী ঘটতে পারে ‘দ্বিতীয় ইনিংসে?’ ওই বৈঠকে কবে নাগাদ নির্বাচন হবে তার কোনও সুনির্দিষ্ট তারিখ বলা হয়নি। উপরন্তু জুড়ে দেওয়া হয়েছে বেশ কয়েকটি শর্ত। ‘ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন? ‘আশ্বাস পেয়েছেন’ ফখরুলরা’! অথচ সরকার বলছে-“ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ ৬ মাস। নির্বাচন কবে? নির্ভর করছে রাজনৈতিক দলগুলোর উপর। সংস্কার নির্ভর করছে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ওপর। এখন গণঅভ্যুত্থানের সনদ, তার ভিত্তিতেই নির্বাচন। সব শেষে ড. ইউনূস বলেছেন-‘নির্বাচন আগামী ডিসেম্বরেও হতে পারে।“ ‘ডিসেম্বরেও হতে পারে’ শব্দটি খেয়াল করার বিষয়। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন না হলে বলা যাবে ‘হবেই’ তা তো বলিনি।
আগামী ছয় মাসে তারা যে কাজগুলো হাতে নেবেন তাকে স্পষ্টতই বলা যায়- ‘টালবাহানার ইনিংস’। আসুন দেখা যাক কোন কোন ‘কার্ড খেলবেন তারা?
📍
১. শুরু হবে সংস্কার খেলা। ছয় কমিশিনের সংস্কার সংযোজন-বিয়োজন করে জল ঘোলা করবেন সময় পার করার জন্য। যেমন আলী রিয়াজ ৭২ সালের সংবিধানের আমূল পরিবর্তন, বাংলাদেশের নাম পাল্টে ফেলার মত কয়েকটি বিতর্কীত প্রস্তাব দিয়েছেন। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন পেশ করেছে আরও বিতর্কীত প্রস্তাব। দেশকে চারটি প্রদেশে ভাগ করে ক্যাডার সার্ভিসও ভাগ করা হবে। এ নিয়ে তীব্র অসন্তোষ শুরু হবে জনপ্রশাসনে। এর ফলে রাজনৈতিক দলগুলো প্রস্তাবের বিরোধীতা করলে বলা হবে-‘সংস্কার নির্ভর করছে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ওপর। যেহেতু তারা বিরোধীতা করছেন, সুতরাং এর নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনের সুযোগ নেই।‘
📍
২. গণভোট। এক্তিয়ারের বাইরেই সংবিধান সংস্কার কমিশন গণভোটের প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে। এর পক্ষে থাকবে সরকার সমর্থক দলগুলো, এবং বিএনপিসহ নির্বাচনপন্থী দলগুলো করবে বিরোধীতা। খেলা শুরু…. ।
📍
৩. স্থানীয় সরকার নির্বাচন। বিএনপিসহ অনেক দল জাতীয় নির্বাচনের আগে এটা চায় না। অথচ সরকার ও তাদের সমর্থক দলগুলো আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায়। বিএনপির আশঙ্কা আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে তাদের মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মধ্যে অন্তর্ঘাতী বিবাদ শুরু হবে, যার ফলে দলটি হয়ে পড়বে নিয়ন্ত্রনহীন। দখলবাজী আর চাঁদাবাজী নিয়ে ইতোমধ্যেই তাদের অর্ন্তকলহ চলছে।
📍
৪. আওয়ামী লীগকে নিষদ্ধ করা। গত অক্টোবরে বিএনপিসহ জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন, হিউম্যান রাইটসসহ আন্তর্জাতিক পক্ষ সতর্ক করায় সরে আসলেও আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ইস্যুটি সরকার মাঝে মাঝেই একটু ‘খেলিয়ে’ দেখে। তাদেরকে নির্বাচন করতে না দেওয়া বিদেশিরা মেনে নেবে না। সে কারণে সেসব থেকে দৃষ্টি ফেরাতে এই ‘নিষিদ্ধকরণ’ ইস্যুটি আবারও সামনে এনেছে সরকার। শোনা যাচ্ছে আগেরবার বিএনপির অমত থাকলেও এবার নাকি তারা নিষিদ্ধের পক্ষে মত দিয়েছে। আরও শোনা যাচ্ছে তারেক জিয়ার সকল মামলা তুলে নেওয়ার টোপ দিয়ে বিএনপিকে রাজি করিয়েছে সরকার। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও পণ্যের অগ্নিমূল্য কখনও সরকারের নিয়ন্ত্রনে ছিল না এখনও নেই। যখনই এইসব নিয়ন্ত্রনহীন অবস্থা হয় তখনই আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের প্রসঙ্গ তুলে জনগণের দৃষ্টি ফেরাতে চায়।
📍
৫. হালনাগাদ ভোটার তালিকা। এই ইস্যুকে সহজেই সরকার ২০২৬-এর মার্চ-এপ্রিলে টেনে নিয়ে যাবে। ভোটার তালিকা জুনে হালনাগাদ করা শেষ হলেও ভোট দিতে পারার চূড়ান্ত কাজগুলো শেষ হতে হতে আগামী বছর মার্চ-এপ্রিল।
📍
৬. আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি। বর্তমানের চরম অরাজকতা আরও বেড়ে যাবে নির্বাচনের হাওয়া বইতে শুরু করলে। তখন বলা হবে-‘পুলিশের বর্তমানে যে অবস্থা তাতে তাদেরকে দিয়ে ল-এন্ড অর্ডার মেইনটেন করা সম্ভব না। পুলিশের ভেতরে এখনও প্রায় ৮০ ভাগ লীগ আমলের ‘দালাল’ রয়ে গেছে। এদের সংস্কার না করে নির্বাচনের রিস্ক নেয়া যাবে না।‘
📍
এইসব ‘কার্ড খেলে দেওয়া’র পর রাজনৈতিক দলগুলো নিশ্চয়ই বসে থাকবে না। বিশেষ করে বিএনপি ও জামাত। এই দুটো দলকে ‘ট্যাকল করা’র জন্য জন্য ইতোমধ্যে সরকার আরও দুটো ট্রাম্পকার্ডের ব্যবহার শুরু করেছে। বিএনপির জন্য রয়েছে তারেক রহমানের প্রত্যাহারকৃত মামলাগুলো ফের চালু করার হুমকি। আর জামাতকে বাগে রাখার জন্য তাদের নিবন্ধন প্রাপ্তি আরও পিছিয়ে দেওয়া। নির্বাচন কমিশনে জামাতের নিবন্ধন নেই। আগের বার তাার ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করেছে। আর দুবার বয়কট করেছে। এবার ‘নিজেদের সরকার’ বসানোর পরে এখনও তারা নিবন্ধন ফেরত পায়নি।
📍
বিএনপি-জামাত এখন বিভিন্ন ইস্যুতে মুখোমুখি। তাদের এই দ্বন্দ্ব আরও উসকে দেওয়া হবে। জামাত সরকারের মতই স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে চায়, যার ঘোর বিরোধী বিএনপি। ছাত্র শিবিরের হাতে ছাত্রদলের একাধিকবার মার খাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। বিএনপির ১৬ বছরের আন্দোলনকে জামাতসহ ইসলামিস্ট দলগুলো তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না। এতে করে দুই দলের মুখোমুখি সংঘর্ষও সরকারের প্ল্যান সাকসেসফুল করবে। এতেও যদি পরিস্থিতি যথেষ্ট ঘোলাটে না হয়, কিংবা নির্বাচন দূরের কথা, জনজীবনই বিপন্ন হয় এমন অবস্থা ‘ক্রিয়েট’ করার জন্য শুরু হবে আরও বিপুল মাত্রার ‘অর্গানাইজ ক্রাইম’। যা ঘটানোর জন্য ২০/২২ লাখ জ*ঙ্গিভাবাপন্ন তৈরি হচ্ছে যাদের মধ্যে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা রিফিউজি রয়েছে। পাসপোর্ট থেকে ‘পুলিশ ভেরিফিকেশন’ তুলে দিয়ে তাদের অবাধে বাঙালি কমিউনিটিতে মিশে যাওয়া সুযোগও দেওয়া হয়েছে সম্প্রতি।
📍
অর্থাৎ ড. ইউনূস যে ‘ডিসেম্বরেও হতে পারে’ বলেছেন, সেই ডিসম্বরের আগেই এইসব ‘পাকা মাথার মেটিক্যুলাসলি ডিজাইনড প্ল্যানে’ এখন থেকে ধীরে ধীরে শুরু হয়ে ডিসেম্বর এবং আগামী বছরজুড়ে দেশজুড়ে এমন এক নৈরাজ্য শুরু হবে যা দেখে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোসহ বিদেশিরাও বলতে বাধ্য হবেন-‘এখনই নির্বাচনের পরিবেশ নেই’। কী বুঝলেন?
📍
এতসব ‘মারেফতি খেলা’ দেখেও এক শ্রেণীর পতিত বাম দলগুলো মুখস্ত ডেমোক্র্যাটিক উদ্ধৃতি আউড়ে পেছন চাপড়ে আমোদ পেতেই পারেন কারণ তাদের দৌড় ওই ‘ফ্যাসিবাদী’ সরকার হঠিয়ে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ার লক্ষ্যে অবাধ-সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার কায়েম করার ইউটোপীয় বাসনা পর্যন্ত। মোটা দাগে সরকার তাদেরকে মাঝে মাঝে দাওয়াত করে চা-কফি খাওয়াচ্ছে, পাশে দাঁড়িয়ে ফটোসেশন করাচ্ছে। প্রতিদানে তারাও সরকারের আস্থাভাজন হওয়ার জন্য নিয়ম করে সরকারের গুনগান গাইতে থাকবে। ড. ইউনূসও তার দীর্ঘদিনের অভিপ্সা- ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থান পাকাপোক্ত করবেন।
📍
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এক মাঘে যেমন শীত যায় না, তেমনি প্রতি ডুবেই শালুক মেলে না। এই বিষয়টি নিশ্চিতভাবেই ক্ষমতাবলয়ে ঘুরপাক খেতে থাকা লোকজনের মাথায় থাকে না। আমরা সাধারণ মানুষ যেমন ভয় পাচ্ছি, তেমনি আপনাদেরও রিফ্লেকশন ইমেজে ভয় পাওয়া উচিৎ এতগুলো মানুষ নিয়ে ছিনিমিনি খেলার জন্য।
…………………………………
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫