
ছামির মাহমুদ
আমাদের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন বহুমাত্রিক আবেদনে অনন্য। জাতির চলার পথে চেতনার অনন্ত উৎস ২১ ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। জাতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ এ অধ্যায়ে সিলেটবাসীর উজ্জ্বল অংশগ্রহণ এখানকার স্বতন্ত্র প্রাণশক্তির পরিচায়ক।
ভারতবর্ষ ভাগের পরপরই পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি ওঠে সিলেট থেকেই। পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম ১৯৪৭-এর নভেম্বর কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ, সিলেটের উদ্যোগে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়।
সিলেটের মাটিতে আরবি, উর্দু, ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য চর্চায় বিশেষ খ্যাতি থাকলেও মাতৃভাষার প্রশ্নে ও দাবিতে সিলেটবাসীকে খুঁজে পাওয়া যায় আন্দোলনের প্রথম সারিতেই। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তমদ্দুন মজলিস ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করে।
কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ, সিলেট ১৯৪৭-এর ৯ নভেম্বর নিজস্ব হল রুমে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে একটি আসর ডাকে। যেখানে শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক মুসলিম চৌধুরী ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ শীর্ষক একটি মূলপ্রবন্ধ পাঠ করেন।
এরপর ওই বছরের ৩০ নভেম্বর ওই সংগঠনের প্রস্তাবে বড় পরিসরে সিলেট আলিয়া মাদরাসার হল রুমে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা দুটিতে সভাপতিত্ব করেন খ্যাতনামা রস সাহিত্যিক ও অনুবাদক মতিন উদদীন আহমদ।
ওই সময় পূর্ব পাকিস্তানের কোথাও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুরু হয়নি। এর অনেক পরে ১৯৪৮-এর ফেব্রুয়ারি বা মার্চে ঢাকাসহ পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি ওঠে।
সিলেটের সচেতন কবি-লেখক-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী সমাজের কাছ থেকে ওঠা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবি জনগণের দাবিতে পরিণত হয়।
ক্রমে ক্রমে সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের নিরিবিলি আওতা হতে তৎকালীন সিলেটের ঐতিহ্যবাহী গোবিন্দচরণ পার্কে (বর্তমান হাসান মার্কেট) সিলেটে ভাষা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ সংগ্রামের সূচনা হয়। ওখানেই বাংলা ভাষার পক্ষে সভা-সমাবেশ হতো।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সিলেটের গোবিন্দ চরণ পার্কের ঐতিহাসিক ভূমিকা রয়েছে। বন্দরবাজারের আজকের হাসান মার্কেটের নাম ছিল তখন গোবিন্দ পার্ক। সিলেটের সকল আন্দোলন সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু এখন যেমন কোর্টপয়েন্ট, রেজিস্টারি মাঠ তেমনি সেকালে ছিল গোবিন্দ চরণ পার্ক।
এই পার্কের জায়গায় ১৯৫৯ সালে গড়ে তোলা হয় বর্তমান হাসান মার্কেট। এটি বর্তমানে সিলেট সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন একটি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের শপিংমল। এখানে গোবিন্দ চরণ পার্কের কোনো স্মৃতিচিহ্ন রাখা হয়নি। ফলে এই ঐতিহাসিক পার্কটি সম্পর্কে নতুন প্রজন্মের অনেকেই জানেনই না।
সেই ৪৭ এর শেষ এবং ৪৮ এর শুরুর দিকে প্রায় প্রতিদিন শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মিছিলসহ বিক্ষুব্ধ জনতা গোবিন্দ চরণ পার্কে জড়ো হতেন। লোকজন আসতেন শহরের বাইরে থেকেও। অংশ নিতেন সভা-সমাবেশে। শাসকদের চক্রান্তের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠতো গোবিন্দ চরণ পার্ক। আন্দোলন সংক্রান্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও নেওয়া হতো সেইসব সভা-সমাবেশ থেকে।
‘৪৭ থেকে ৫২’ দীর্ঘ প্রায় পাঁচ বছর গোবিন্দ চরণ পার্কে সভা-সমাবেশসহ অসংখ্য কর্মসূচি আয়োজন করা হলেও কখনোই তা খুব সহজ ছিল না। কারণ সিলেটে সেসময় বাংলার পাশাপাশি উর্দু ও ফার্সি ভাষায় সাহিত্য সাধনা করতো বড় একটি অংশ। বাংলার পক্ষে আয়োজিত অনেক কর্মসূচি বানচাল করতে উর্দুপ্রেমীরা তাই হামলাও করেছেন গোবিন্দ চরণ পার্কে
১৯৪৮ সালের আট মার্চ গোবিন্দ পার্কে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে তমদ্দুন মজলিস এবং সিলেট জেলা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন যৌথভাবে একটি জনসভা আয়োজন করে। ৮ মার্চের ওই সভার সভাপতি ছিলেন মাহমুদ আলী। যিনি পরবর্তীতে পাকিস্তানের মন্ত্রীও হয়েছিলেন। সভা শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যে বাংলা বিরোধী পক্ষ লাঠি নিয়ে হামলা চালিয়ে সভাপতির চেয়ার দখল করে নেয়।
ওই হামলায় মাহমুদ আলী, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ (পরবর্তীতে জাতীয় অধ্যাপক) এবং সিলেট তমদ্দুন মজলিসের সম্পাদক দেওয়ান অহিদুর রেজা ও সিলেট জেলা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি আব্দুস সামাদ আজাদ (বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী) প্রমুখ আহত হন। এর মধ্যে মারাত্মক আহত হন তরুণ কর্মী মকসুদ আহমদ।
প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা থেকে জানা যায়, প্রায় মূর্ছিত অবস্থায় মাটিতে ফেলে তাকে টানা হেঁচড়া করা হয়। তার সঙ্গে আরো অনেক কর্মী আহত হন। পুলিশ নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
ওই জনসভাস্থলে এম. এ. বারীর (ধলা) সভাপতিত্বে পাল্টা উর্দুর দাবিতে সভা অনুষ্ঠিত হয়। এম. এ. বারী অবশ্য ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বাংলা ভাষার পক্ষে কাজ করেন। ওই দিনের সভা পণ্ড হয়ে যায় ঠিকই। কিন্তু জনমত প্রভাবিত হয় বাংলার পক্ষে।
এর প্রতিবাদে ১০ মার্চ আরো একটি সভার আহ্বান করা হয়। কিন্তু জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শহরে দুই মাসের জন্য সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে দেন।
সভায় নগ্ন হামলা এবং মকসুদ আহমদকে প্রহারের প্রতিবাদে তমদ্দুন মজলিসের সম্পাদক দেওয়ান অহিদুর রেজা ও মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি আব্দুস সামাদ, পরে মুক্তিযুদ্ধের সময় আজাদ যোগ করে হন আবদুস সামাদ আজাদ স্বাক্ষরিত একটি বিবৃতি নওবেলালে ছাপা হয়।
এতে বলা হয়, ‘সিলেটে গুন্ডামীর নগ্নরূপ বহুদিন হইতে সিলেটবাসী জনসাধারণের অসহ্য হইয়া উঠিয়াছে।’
তবে বাংলাভাষা প্রেমিক জনতার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় উর্দু পক্ষের এদেশীয় সমর্থকরা পিছু হঠতে বাধ্য হয়। ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সেই গোবিন্দ চরণ পার্ক পরবর্তীতে ব্যবসাকেন্দ্র হয়ে যায়।
জাতীয় অধ্যাপক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, জননেতা আব্দুস সামাদ (আজাদ) অধ্যাপক শাহেদ আলী, মুহম্মদ নূরুল হক, আবুল হাসনাত সা’দত খান, জেলা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক জননেতা পীর হবিবুর রহমান ও জেলা সংগ্রাম কমিটির ট্রেজারার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সৈয়দ মোতাহির আলী বাংলার পক্ষে সক্রিয় ছিলেন।
বিজ্ঞজনরা মনে করেন, পৃথিবীর যত ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে সেগুলো সংরক্ষণ করে রাখা হয় নিজ দেশের নতুন প্রজন্মকে ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে উৎসাহিত করার জন্যে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের সিলেটে সেটি করা হয়নি। ভাষা আন্দোলনের স্থানগুলো সংরক্ষণ বা স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়নি। যার কারণে অনেক তরুণ ভাষা আন্দোলনে সিলেটের যে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে সেটি জানে না।
সাবেক অর্থমন্ত্রী ও ভাষাসংগ্রামী আবুল মাল আবদুল মুহিত ‘স্মৃতি অম্লান ১৯৭১’ গ্রন্থে লিখেছেন, সিলেটে শুরু থেকেই আমরা ভাষা নিয়ে বিশেষ তৎপর ছিলাম। এর কারণ বোধ হয় ছিল কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের দশোর্ধ্ব বছরের সাধনা।’
তিনি আরও লিখেছেন, ১৯০৬ সাল থেকে এই প্রতিষ্ঠান সিলেটে একটি প্রগতিশীল, আত্মসচেতন, উন্নতমনা মুসলমান তরুণ সমাজ গঠনে ব্রত হয়। আমার কৈশোরে আমি এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হই এবং তরুণ বয়সেই এর আজীবন সদস্য হই। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরেই এই প্রতিষ্ঠান দাবি করে বসলো যে, পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হবে।
১৯৪৭-এর নভেম্বর মাসে সাহিত্য সংসদের উদ্যোগে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক শুরু হলো। স্মরণ থাকে যেন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কিন্তু শুরু হয় অনেক পরে, ১৯৪৮ এর ফেব্রুয়ারি বা মার্চে। সাহিত্য সংসদ ১৯৪৭-এর ৯ নভেম্বরে একটি আসর ডাকে যেখানে শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক মুসলিম চৌধুরী ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন।
এরপর এ বিষয়ে আর একটি বড় আলোচনা সভা হয় সিলেট আলিয়া মাদরাসায় নভেম্বরের ৩০ তারিখ। যেখানে প্রবন্ধ পাঠ করেন তরুণ সংসদকর্মী হোসেন আহমদ। আর এ দিন বিশেষ বক্তব্য রাখেন সুপ্রসিদ্ধ পণ্ডিত ও সাহিত্যিক ড. সৈয়দ মুজতবা আলী।
এই দুই সভায় সভাপতিত্ব করেন কথা সাহিত্যিক মতিন উদ্দিন আহমদ। তারপরও ৮ ডিসেম্বর আরেক সভা হয় সংসদের সভাপতি শিক্ষাবিদ নজমুল হোসেন চৌধুরীর সভাপতিত্বে। ওই সভায় প্রবন্ধ পাঠ করেন বর্তমানে জাতীয় অধ্যাপক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ।
গ্রন্থে আরও উল্লেখ্য করা হয়, এইসব আলোচনা সভার প্রথম দিকে আমাদের বয়সী অনেক তরুণ উপস্থিত ছিলেন কিন্তু দ্বিতীয় সভায় শহরের সুধী সমাজ ভেঙে পড়ে। তাই বিতর্কে আমাদের উৎসাহ আরো বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। ১৯৪৮-এর প্রদেশব্যাপী ভাষা আন্দোলন তাই আমাদের একটু বেশি করেই দোলা দেয়।
১৯৪৮ সালের ১১ জানুয়ারি পাকিস্তানের যানবাহন ও যোগাযোগ মন্ত্রী আব্দুর রব নিশতার সিলেটে আসেন। সিলেট মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন আব্দুস সামাদ আজাদ এবং মহিলা মুসলিম লীগ জেলা শাখার সভানেত্রী বেগম জোবেদা খাতুন চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি মহিলা প্রতিনিধি দল মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি জানান।
সে বছরই সিলেটের নারীরা পূর্ব পাকিস্তানের মূখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দীনের কাছে জোবেদা খাতুন চৌধুরী, সৈয়দা শাহেরা বানু (আবুল মাল আবদুল মুহিতের মা), সৈয়দা লুৎফুন্নেসা খাতুন, সৈয়দা নাজিবুন্নেসা খাতুন, প্রমূখ নারী নেতৃবৃন্দের স্বাক্ষরিত একটি স্মারকলিপি দেন।
ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকেই এভাবেই সক্রিয় ছিলেন সিলেটের ভাষা কর্মীরা। নওবেলাল, আল-ইসলাহ ও সুধীজনদের সাহসী ভূমিকায় বাংলার পক্ষে জনমত প্রবল হয়ে ওঠে। যার ফলে ১৯৫১ সালের ডিসেম্বরে খাজা নাজিম উদ্দীনের বক্তব্যের রেশ ধরে সিলেট আবারো ভাষা আন্দোলন সোচ্চার হয়ে ওঠে।
নবগঠিত সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক হন পীর হবিবুর রহমান। সেই কমিটির সদস্যরা হলেন মাহমুদ আলী, আব্দুর রহিম (লালবারী), নূরুর রহমান, সা’দত হোসেন, মনির উদ্দিন (পিপি) সহ অনেকেই। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি গোবিন্দ চরণ পার্কে একাধিক সভা হয়। ওইদিন রাতে ঢাকার খবর পেয়ে শহরে কান্না ও ক্ষোভের সঙ্গে শোভাযাত্রা বের হয়। জিন্দাবাজারে বর্তমান শুকরিয়া মার্কেটে সাপ্তাহিক নওবেলালের অফিসই ছিলো ভাষা আন্দোলন কর্মীদের অফিস। ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক ও পরিণত পর্যায়ে সিলেটের অনেক গণ্যমান্য পরিচিত মুখ ছিলেন। যাদের সার্বিক সহযোগিতা ও কঠোর আন্দোলনের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি আমাদের মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার।