।। মনজুরুল হক ।।
সারাদেশে ছিনতাই-ডাকাতিসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতির প্রেক্ষাপটে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবির মধ্যেই ২৪ তারিখ রাত ৩টায় সংবাদ সম্মেলন ডেকে এসব অপরাধমূলক কার্যক্রমের জন্য ‘আওয়ামী দোসরদের’ দায়ী করে তিনি বলেছিলেন: “আওয়ামী যারা এই কাজগুলো করছে, তাদের আমি ঘুম হারাম করে দেব, তারা কোথাও স্থান পাবে না। দিনে রাতে যেখানে থাকুক (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)।”
📍
এর পরদিন ২৫ ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যে- “নিজেদের মধ্যে পরস্পরে কাদা ছোড়াছুড়ি বন্ধ করে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। যদি নিজেরা কাদা ছোড়াছুড়ি করেন, দেশ ও জাতির সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে। আমি সতর্ক করে দিচ্ছি, পরে বলতে পারবেন না যে সতর্ক করিনি।
আজকে একটা কথা পরিষ্কার করে বলতে চাই- আমার অন্য কোনো আকাঙ্ক্ষা নাই, একটাই আকাঙ্ক্ষা, দেশ ও জাতিকে সুন্দর জায়গায় রেখে সেনা নিবাসে ফেরত আসব।
আমার মনে হয় আমরা নির্বাচনের দিকেই ধাবিত হচ্ছি, ১৮ মাসের কথা বলেছিলাম। ডিসেম্বরের মধ্যে একটা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রত্যাশা করছি।
সেনাপ্রধান বলেন, সাত মাসে আমার অনেক হয়েছে। এনাফ ইজ এনাফ। আমি চাই আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর দেশ রেখে যেতে।“
📍
সেনাপ্রধানের এই বক্তব্যের ভেতরে অব্যক্ত আরও অনেক কথা আছে যা তিনি বলেননি। স্মরণ করা যেতে পারে ৫ আগস্ট দুপুরের পর তিনি সংবাদমাধ্যমে দেশের, জনগণের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে জনগণকে আশ্বস্ত করেছিলেন। সে সময় তাঁর উপর পুরোপুরি ক্ষমতা হাতে নেওয়ার অভ্যন্তরীণ চাপও ছিল। তিনি তা না করে সরকারকে বাইরে থেকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে আসছিলেন। গত সাত মাসে দেশ আজকে যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে তাতে দেশে এবং বর্হিবিশ্বে সেনাবাহিনীর সুনাম ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।
📍
তিনি যে “সাত মাসে আমার অনেক হয়েছে। এনাফ ইজ এনাফ। আমি চাই আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর দেশ রেখে যেতে।“ বলেছেন, তার নেপথ্য কারণ হলো সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচনের রোডম্যাপ দেওয়া হয়নি। যে সম্ভাব্য সময়গুলোর ককথা বলা হয়েছে তাও ‘যদি’ ‘কিন্তু’ নির্ভর।📍
যেহেতু তিনি জাতির দায়িত্ব নিয়েছেন, এখন এই অরাজক অবস্থা কতদিন বরদাস্ত করবেন? সরকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সাত মাসেও নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। তিনি গত বছর বলেছিলেন-’১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে’। সেটাও সরকার গুরুত্ব দেয়নি। মনে রাখতে হবে ড. ইউনূস ক্ষমতা গ্রহণের আগে শর্ত দিয়ে বলেছিলেন-“আমাকে কমপক্ষে ৬ বছর সময় দিতে হবে। আমার কথা শুনতে হবে। তা না হলে আমি চলে যাবো।“ অর্থাৎ সেনাবাহিনী প্রধান যে প্রেক্ষিতে বলেছেন- ‘সাত মাসে আমার অনেক হয়েছে। এনাফ ইজ এনাফ।‘ ওদিকে সরকার নির্বাচনের ব্যাপারে যে মোটেও সিরিয়াস নয় সেটা বিভিন্ন প্রেক্ষিতে সরকারের পদক্ষেপ থেকে অনুমান করা যায়।
📍
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শুরু থেকেই প্রায় প্রতিটি কাজের মধ্য দিয়ে একটি বিশেষ রাজনৈতিক ধারার প্রতি ‘পক্ষপাতিত্ব ও অনুরাগ’ এবং অন্য একটি বিশেষ ধারার প্রতি বিরাগ ও ‘প্রতিহিংসার’ প্রকাশ ঘটিয়ে চলছে। এমতাবস্থায় বর্তমান সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান অসম্ভব।
📍
এরই মধ্যে এমাসেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রাজনৈতিক দল ঘোষণা করতে যাচ্ছে। এতে করে স্পষ্ট যে দেশে ৫০টি নিবিন্ধিত দল থাকলেও আওয়ামী লীগকে বাদ রেখে নির্বাচন হবে প্রধানতঃ তিনটি দলের মধ্যে- বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রদের নতুন দল নিয়ে। সরকারের অভিপ্রায়ও তাই। এই বিশেষ এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকার একের পর এক যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে তাতে করে সংকটের সমাধান হবে না, বরং বাড়বে। সুকৌশলে সরকারের সমর্থক একটি মহল দেশকে বিভক্ত করে দিচ্ছে। নিজেদের ব্যর্থতার সকল দায় চাপাচ্ছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের উপর। দেশের প্রধান দল আওয়ামী লীগ ছাড়া নির্বাচন করার পরিকল্পনা করছে। বাস্তবতা হলো দেশের প্রধান দল আওয়ামী লীগ ছাড়া নির্বাচন তারা করতেই পারেন তবে সেটা দেশে ও বর্হিবিশ্বে বৈধতা পাবে না এটা নিশ্চিত।
অন্তত সেনাপ্রধানের-“শুড বি ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ইনক্লুসিভ ইলেকশন অ্যান্ড দ্যাট ইলেকশন শুড বি উইদিন ডিসেম্বর।“ বক্তব্যটি আরও শক্তিশালী করেছে-“অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন” শব্দটি যোগ হয়ে।
📍
তাহলে সেবানাহিনী প্রধান এখন কী করতে পারেন?
প্রথম অপশনঃ সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে পঞ্চদশ সংশোধনীর নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার বিধান বাতিলের রায় বাতিল হয়েছে, সুতরাং পঞ্চদশ সংশোধনীপূর্ব সংবিধানের আলোকে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে সেই সরকারের হাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ক্ষমতা হস্তান্তর করিয়ে সংবিধাননির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা। এই পদক্ষেপ ব্যর্থ হলে-
দ্বিতীয় অপশনঃ যেহেতু রাষ্ট্রপতি দেশের সাংবিধানিক প্রধান এবং সশস্ত্র বাহিনীরও প্রধান হিসাবে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক জরুরি অবস্থা জারি করে রাষ্ট্রপতির অধীনে ‘সর্বদলীয় জাতীয় সরকার’ গঠন করে সকল দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা।
📍
কেবলমাত্র এভাবেই সেনাবাহিনী প্রধান যেমনটি বলেছেন- “আমার অন্য কোনো আকাঙ্ক্ষা নাই, একটাই আকাঙ্ক্ষা, দেশ ও জাতিকে সুন্দর জায়গায় রেখে সেনা নিবাসে ফেরত আসব। সাত মাসে আমার অনেক হয়েছে। এনাফ ইজ এনাফ। আমি চাই আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর দেশ রেখে যেতে।“ সেটার বাস্তবায়ন সম্ভব।
📍
নির্বাচন বিষয়ে সরকারের রোডম্যাপ না দেওয়া, গড়িমসি করে কালক্ষেপণ করার পেছনে কোনো মহৎ উদ্দেশ্য নেই। দেশে এখন যে নৈরাজ্য অরাজকতা, বিচারহীনতা, বিশৃঙ্খলা, অর্থনৈতিক সংকট, সংঘাত ও সংঘর্ষময় অস্থির পরিস্থিতি বিরাজ করছে তা থেকে মুক্তি মিলবে না। এভাবে একটি দেশ চলতে পারে না। জনগণের আশা-আকাঙক্ষা দূরের কথা, ন্যূনতম জীবনের নিরাপত্তা দেওয়াই এখনকার বড় চ্যালেঞ্জ। আর সেটা কেবলমাত্র হতে পারে একটি নির্বাচিত সরকারের হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব থাকলে।
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫