।। মুনমুন শারমিন শামস।।
হাতের মুঠো গলে সব বেরিয়ে যাচ্ছে। আমার আর আমাদের যা কিছু ছিল – ছিল তো নেহাৎ সামান্য কিছু, তাও অসামান্য মনে হতো!
একুশের বইমেলা, একাডেমির মাঠ, নতুন বইয়ের ঘ্রাণ। হারিয়ে গেল। এই দীর্ঘ জীবনে এ প্রথম বইমেলায় যাইনি একটা দিনও। দেশের বাইরে থাকলেও ফেব্রুয়ারিতে দেশে এসেছি শুধুমাত্র বইমেলার জন্য। এবার সেই বইমেলার কথা ভাবতেও ইচ্ছে করেনি। নতুন বই প্রকাশের চিন্তাও আসেনি। ইচ্ছেই হয়নি আসলে।
একটা প্রভাতফেরি ছিল। রাত ১২টায় সারা শহর জুড়ে নেমে আসতো অপার্থিব এক সুর – আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি…
সেই সুরটা এইবার আর কানে বাজেনি। দেখা হয়নি শহীদ মিনারে আঁকা আলপনাদের সাথে। ফুল হাতে খালি পায়ে নত মস্তকে দাঁড়ানো হয়নি। হারিয়ে গেল তাও।
একটা বিজয় দিবস ছিল। সবুজ লাল দিন ছিল। শহরজুড়ে উৎসব ছিল। মেলা ছিল। সন্তানের হাত ধরে ঘুরঘুর করবার ছিল। হলো না আর।
একটা পূজা পার্বণ ছিল। লাল শাড়ি পরে মণ্ডপে মণ্ডপে ঘোরা ছিল। মিলে মিশে বেঁচে থাকা ছিল। সব স্তব্ধ হয়ে গেল।
একটা শহর ছিল। সে শহরে রাত নামতো উৎসব হয়ে। সেহরিতে পুরান ঢাকা, ধানমন্ডি, এখানে ওখানে তরুণ বৃদ্ধ সকলের আনন্দ হতো খুব। অন্ধকারে ঢেকে গেল সেইসব। সন্ধ্যের পর আকাশের দিকে তাকিয়ে গোধূলির গন্ধ পেতাম। এই নগরে। সেই গন্ধ মিলিয়ে গেছে, দুশ্চিন্তার দুর্গন্ধে চাপা পড়ে গেছে। দল বেঁধে ছুটে আসা দানবের হাতে রক্তের দাগ, লোভের হিশ হিশানি! আমাদের সন্ধ্যেগুলো চুরি হয়ে গেছে।
একটা বাড়ি ছিল। দোতলা বাড়ি। সেই বাড়ির ভাঁজে ভাজেঁ ইতিহাস লেখা ছিল। সেই বাড়ির আধো আলো আধো ছায়ায়, পুরোনো ভেজা গন্ধে আমরা নিজেদের খুঁজে পেতাম। যতবার পার হতাম সেই সড়ক, ততবার মনে পড়ে যেত শুধু আমাদের জন্য লেখা একটা অহংকারী গল্পের কথা। ৩২ নামের একটি সংখ্যা আমাদের আত্মার ভেতরে চকমকি পাথর হয়ে আগুন জ্বালাতো।
সেই বাড়িটা হারিয়ে গেল। আমাদের পোড়া চোখ, ছিন্নভিন্ন হওয়া মন, ধ্বসে পড়া আত্মা স্তব্ধ নির্বাক হয়ে গেল বুলডোজারের সামনে। আগুনের লালাভ শিখায়। আমরা দেখলাম, কি বীভৎসতা জমে উঠেছে চারপাশে। কী নিকৃষ্ট রসে ভিজে যাচ্ছে দেশ। প্রজন্ম। আমরা।
সব হারিয়ে গেল। সব শেষ হয়ে গেল। আমাদের আর কিছুই রইল না।