উন্মত্ত উগ্রবাদীদের জঙ্গি হামলার মুখে গত বছরের ৫ই আগস্ট দেশত্যাগ করেন বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত কয়েক বছরে একাধিকবার শেখ হাসিনা তাঁর বিভিন্ন বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন, মার্কিন সরকারের (বাইডেন প্রশাসন) অর্থায়নে পরিচালিত সংস্থার যোগসাজশে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এমনকি শেখ হাসিনা ৫ই আগস্টের পর দেওয়া বেশ কয়েকটি বক্তব্যে একই কথার পুনরাবৃত্তি করেছেন।
৫ই আগস্টের আগে এবং পরবর্তী কিছুদিন শেখ হাসিনার এই দাবিগুলোকে নিছক রাজনৈতিক বক্তব্য হিসেবে ভাবা হলেও ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ক্রমশ অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়ে আসে। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা মাইক বেনজ বিষয়টি নিয়ে খোলাখুলি কথা বলার পর তা নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনা। আর এর মধ্য দিয়ে সামনে আসতে শুরু করেছে অনেকগুলো ষড়যন্ত্রের ঘটনা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে বিদেশি রাষ্ট্রে সরকার পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতো তার তথ্য-প্রমাণ উঠে আসছে।
মূলত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দিয়েই ঘটনার সূত্রপাত। তিনি শপথ নেওয়ার পরেই নির্বাহী আদেশ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সব ধরনের বিদেশিসহায়তা স্থগিত করে দেন। স্থগিত হওয়া এসব তহবিলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডি’র নাম। সংস্থাটির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি বিদেশিসহায়তা দিতো। তাদের বিরুদ্ধেই উঠেছে বিদেশি সরকার পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের অভিযোগ।
শুধু বাংলাদেশ নয়, অনেক দেশে সরকার পরিবর্তনের পেছনে আছে সংস্থাটির ভূমিকা। উঠে এসেছে এমন তথ্য-প্রমাণ। বিশেষ করে ২০২৪-এ বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে আলোচিত ছিল বাংলাদেশে রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের নেপথ্যে মার্কিন হস্তক্ষেপের বিষয়টি।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সাবেক কর্মকর্তা মাইক বেনজ অভিযোগ করেছেন, তার দেশ ভারত ও বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে হস্তক্ষেপ করেছে। তারা মিডিয়া প্রভাব, সোশ্যাল মিডিয়া সেন্সরশিপ এবং সরকারবিরোধী আন্দোলনগুলোর অর্থায়নের মাধ্যমে এই হস্তক্ষেপ করেছে।
বেনজ জানান, যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত এজেন্সিগুলো গণতন্ত্র প্রচারের নামে বিভিন্ন দেশের জাতীয় নির্বাচনকে প্রভাবিত করা, নির্বাচিত সরকারকে অস্থিতিশীল করে তোলা এবং সেসব দেশের সরকারগুলোকে ওয়াশিংটনের কৌশলগত স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে। মার্কিন সরকারের অনুগত হিসেবে কাজ করতে পারে, এমন পাপেট সরকার বসাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হস্তক্ষেপ করেছে।
বেনজ অভিযোগ করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির কিছু অংশে ইউএসএআইডি, থিঙ্ক ট্যাঙ্ক এবং বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো রয়েছে। ভারতের ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপির বিপক্ষে অনলাইন আলোচনা প্রভাবিত করেছে। এই গ্রুপগুলো একত্রিত হয়ে নির্বাচনী ন্যারেটিভ তৈরিতে কাজ করেছে। এসব গ্রুপের তৈরি ন্যারেটিভ জনগণকে বিভ্রান্ত করেছে। তারা বলার চেষ্টা করেছে যে, মোদির রাজনৈতিক সফলতা মূলত ভুয়া তথ্যের ফল এবং এটি গণমাধ্যমের ওপর সেন্সরশিপের ভিত্তি তৈরি করেছে।
বেনজ আরও দাবি করেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে চেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, বিশেষতঃ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারকে দুর্বল করতে। বাংলাদেশ এবং চীনের মধ্যে ক্রমশ বাড়তে থাকা অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্কের কারণে মার্কিন নীতিনির্ধারকরা একে তাদের আঞ্চলিক প্রভাবের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছিলেন।
ফাঁস হওয়া নথির বরাতে বেনজ জানান, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে পরিচালিত সংস্থাগুলি, যেমন- এনইডি (ন্যাশনাল এনডৌমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি) এবং এর সহযোগীরা বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার পরিকল্পনা চালিয়েছে। এই কৌশলগুলোর মধ্যে ছিল আন্দোলনকারী সংগ্রহ, সংখ্যালঘু গোষ্ঠীদের সক্রিয় করা এবং সাংস্কৃতিক ও জাতিগত উত্তেজনা ব্যবহার করে, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মাঝে সামাজিক বিভাজন সৃষ্টি করা।
নথিপত্র থেকে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের করের টাকা ব্যবহার করে বাংলাদেশি র্যাপ সঙ্গীতের জন্য অর্থায়ন করা হয়েছিল, যা সরকারবিরোধী মনোভাব প্রচারের জন্যই তৈরি করা হয়েছিল। সেসব সঙ্গীতের লিরিক, সুরারোপ সবকিছুতে সহযোগিতা ছিল এসব সংস্থার। বেনজ জানান, এই গানগুলো কৌশলে সরকারবিরোধী আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছিল, যাতে বড় ধরনের বিক্ষোভ সৃষ্টি করা যায়।
বেনজ জানান, এই গোষ্ঠীগুলো তাদের কৌশল বাস্তবায়নে থিঙ্ক ট্যাঙ্ক, সংবাদমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে। আর এটি তারা করেছে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের সরাসরি তত্ত্বাবধান ছাড়াই। রাজনৈতিক নেতাদের সংস্পর্শ না থাকায় এই পরিকল্পনাগুলোকে সরকারপক্ষ ষড়যন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে পরিচালিত এসব সংস্থার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ অতীতেও ছিল। এসব সংস্থা মঙ্গোলিয়ায় (১৯৯৬), হাইতিতে (২০০১) ও উগান্ডায় (২০২১) সরকার পরিবর্তনে যুক্ত ছিল। এসব কর্মকাণ্ডের পেছনে সরাসরি সংযুক্ত ছিল ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই)। এই সংস্থাটি মূলত এনইডি ও ইউএসএআইডি’র বৃহত্তর লক্ষ্য বাস্তবায়ন করছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক বিনষ্ট করা এবং বাংলাদেশের সরকার পরিবর্তন ষড়যন্ত্রে যেন ভারত হস্তক্ষেপের সুযোগ না পায়, তা নিশ্চিত করা।
এনইডি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মতো আইআরআইকেও অনুদান দেয়। যারা দাবি করে, তারা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়া শক্তিশালী করতে কাজ করছে। এটি এনজিও হিসেবে নিবন্ধিত। মার্কিন কংগ্রেসের তহবিলের ওপর নির্ভরশীল প্রতিষ্ঠানটি ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে হলেও এটি প্রতিবছর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থসহায়তা পায়। অন্যদিকে ইউএসএআইডি সরকারি সংস্থা। এটি বিদেশিসহায়তা ও উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে।
দ্য সানডে গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের মার্চে আইআরআই যখন ইউএসএআইডি ও এনইডি’র কাছ থেকে অনুদান পায়, তখন থেকেই শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে সরানোর প্রকল্প শুরু হয়। এই কর্মসূচির নাম ছিল “প্রমোটিং অ্যাকাউন্টিবিলিটি, ইনক্লুসিভিটি, অ্যান্ড রিসিলিয়েন্সি সাপোর্ট প্রোগ্রাম” (পিএআইআরএস)। এই প্রকল্পটি টানা ২২ মাস চলে এবং ২০২১ সালের জানুয়ারিতে শেষ হয়।
এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের নাগরিকদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বাড়ানো এবং সরকারবিরোধী পক্ষের কার্যক্রমকে শক্তিশালী করে তোলা। সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয় তুলে ধরতে চিত্রশিল্পী, সংগীতশিল্পী ও অন্যদের জন্য অ্যাডভোকেসি অনুদান দেওয়া হয়। এসব কার্যক্রম প্রায় ৪ লাখ দর্শক-শ্রোতার কাছে পৌঁছানো হয়। সুশীল সমাজের ব্যক্তি ও বিভিন্ন সংগঠন এই তথাকথিত উদ্যোগকে সমর্থন দেয়। সক্রিয় কর্মী ও উদ্যোগীদের চিহ্নিত করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, যাতে তারা পরবর্তীতে নেতৃত্ব দিতে পারে।
এছাড়া, শেখ হাসিনার সরকারকে অস্থিতিশীল করতে করোনা মহামারির সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। সেসময় নেত্র নিউজসহ কয়েকটি গোষ্ঠী উপুর্যপুরি গুজব প্রচার চালিয়েছে দেশকে অস্থিতিশীল করতে। তবে পরিকল্পনা অনুযায়ী ফল পায়নি ষড়যন্ত্রকারীরা। কারণ, শেখ হাসিনার সুদূরপ্রসারী চিন্তা-ভাবনার কারণে মৃত্যুহার কমিয়ে রাখা সম্ভব হয়। একইসাথে অর্থনৈতিক ধসও ঘটেনি। বরং নিয়ন্ত্রিত লকডাউন এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষা নীতির কারণে অর্থনীতি দ্রুত পুনরুদ্ধার হয়।
একই ধরণের আরেকটি প্রকল্প ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পরিচালিত হয়। এতে এনইডি মোট ৯ লাখ ডলারের অনুদান দেয়। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে যুবক ও নারীদেরকে সরকারবিরোধী অবস্থানে নিয়ে আসা। এজন্য আইআরআই নারী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, জনপ্রতিনিধি এবং সম্ভাব্য প্রার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে কাজ করেছে। যেন তারা ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে।
এছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রনেতাদেরও এই কার্যক্রমের আওতায় আনা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট নথিতে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কিছু দুর্নীতির গালগল্প রচনা করা হয়েছে। সেইসাথে এসব কথিত দুর্নীতির সাথে ভারতকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। তাতে উল্লেখ করা হয়, শেখ হাসিনা পুনঃনির্বাচনে ভারতের সমর্থন নেবেন। নির্দিষ্ট কিছু ছাত্রনেতাদের গোলটেবিল আলোচনায় আমন্ত্রণ জানানো হয়, সেখানে আওয়ামী লীগের সেইসব কথিত দুর্নীতি বিষয়ে স্ক্রিপ্টেড বার্তা তাদের মাথায় ঢোকানো হয়।
প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার সরকার পতন পরিকল্পনার তদারকিতে যুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তারা হলেন— সাউথ এশিয়া সাবকমিটির সদস্য ক্রিস মারফি (ডি-সিটি), ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক পরিচালক সুমনা গুহ, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু, সারা মারগন এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা (ইএপি) ফ্রান্সিসকো বেঙ্কোসমে, তিনি আবার অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালে থাকাকালীন বাংলাদেশ বিষয়ে কাজ করেছেন।
শেখ হাসিনার সরকার ফেলতে পিএআইআরএস কর্মসূচি বহুমুখী কৌশল গ্রহণ করে, যা বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় পরিচালিত অন্যান্য আন্দোলনের মতো ছিল। এতে জামায়াতে ইসলামীসহ কিছু ধর্মীয় উগ্রপন্থী সংগঠন এবং মার্কিন অর্থায়নপুষ্ট বাংলাদেশি সুশীল সমাজের ব্যক্তিবর্গকে যুক্ত করা হয়। এর ফলে সহিংস আন্দোলন পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তোলে। এই সুশীল সমাজ আন্দোলনের প্রকাশ্য মুখ হিসেবে কাজ করে। যেন শেখ হাসিনার সরকারবিরোধী ও মার্কিন মদদপুষ্ট রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের অবস্থান সুসংহত করতে পারে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর মার্কিন ডিপ স্টেটের ষড়যন্ত্ররে ঘটনাগুলো ক্রমশ প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে এনইডি যুক্তরাষ্ট্রে ও আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক কংগ্রেসম্যান রন পল অভিযোগ করেন, এনইডি জনগণের করের টাকা অপব্যবহার করছে।
তিনি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের অনুগত বিদেশি রাজনীতিকদের সহায়তা দিতে এই অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। এটি গণতন্ত্র প্রচারের নামে আসলে বিদেশি নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করছে। বিদেশে সরকার পতন ঘটাতে কাজে লাগানো হয়েছে। এই পদ্ধতিটি ‘সফট মানি’ ব্যবহার করে বিদেশি নির্বাচন প্রভাবিত করছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।”
এনইডি’র বিতর্কিত কার্যক্রম কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে সমালোচিত হয়ে আসছে। ১৯৮০-এর দশকে কংগ্রেসম্যান বার্নি ফ্র্যাঙ্ক সংস্থাটির অর্থায়ন কমানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, সরকারের উচিত নয় জনগণের করের টাকা এভাবে বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা। বিশেষ করে, বিদেশি শ্রমিক সংগঠনগুলোকে সহায়তা দেওয়ার জন্য জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ ব্যয় করা ঠিক নয়।
নিউইয়র্ক টাইমসের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এনইডি হাইতির গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে দুর্বল করে দেশটিতে অস্থিরতা বাড়িয়েছে। পত্রিকাটির সাবেক প্রতিবেদক স্টিফেন কিনজার নিউইয়র্ক রিভিউ অব বুকসে লিখেছেন, সিআইএ ও ইউএসএআইডি’র সঙ্গে মিলে এনইডি বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে সহায়তা করে। এসব গোষ্ঠীর লক্ষ্য মার্কিন পলিসির বিপক্ষে থাকা সরকারগুলোর পতন ঘটানো। এতে স্পষ্ট যে, এনইডি’র কর্মকাণ্ড বিদেশি হস্তক্ষেপেরই ধারাবাহিক অংশ, যা অনেক সময় স্থানীয় গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতার ক্ষতি করে।
বাংলাদেশ ছাড়াও এনইডি বিভিন্ন দেশে তাদের এমন কূটকৌশল ও গোপন কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। ২০২২ সালে এটি তাইওয়ানে ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টির সঙ্গে মিলে একটি গ্লোবাল অ্যাসেম্বলির আয়োজন করে। যার উদ্দেশ্য ছিল তথাকথিত গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে একত্রিত করা।
২০২৩ সালের জুলাইয়ে এনইডি’র প্রেসিডেন্ট ডেমন উইলসন তাইওয়ান ফাউন্ডেশন ফর ডেমোক্রেসির ২০তম বার্ষিকীতে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েনকে ‘ডেমোক্রেসি সার্ভিস মেডেল’ দেয়। দেখা যায়, এনইডি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক আন্দোলনগুলোকে সমর্থন দেয়। তাদের এই কার্যক্রম স্পষ্টত, তাইওয়ান ও চীনের মধ্যে উত্তেজনা ও সংঘাতের ঝুঁকি তৈরি করেছে।
এনইডি’র দাবি, তারা কোনো রাজনৈতিক প্রচারণায় অর্থায়ন করে না। যদিও এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তারা বিভিন্ন দেশের জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করেছে গোপনে। নিকারাগুয়া ও মঙ্গোলিয়ায় নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে এনইডি সক্রিয়ভাবে কাজ করেছে। এছাড়া, পূর্ব ইউরোপে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারগুলোকে পতন ঘটাতেও ভূমিকা রেখেছে। ভেনেজুয়েলায় এটি বিরোধী দলগুলোকে সরাসরি সহায়তা করেছে।
একই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারকে উৎখাতের পেছনে এনইডিসহ অন্য সংস্থারও নাম এসেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে।
দ্য ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের গত ১০ই ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, হাঙ্গেরিয়ান-আমেরিকান ধনকুবের জর্জ সরোসের সংগঠনগুলো রাজনৈতিক বিষয়ে প্রভাব বিস্তার ও বিভিন্ন দেশকে অস্থিতিশীল করতে ইউএসএআইডি থেকে ২৬০ মিলিয়ন ডলার অনুদান পেয়েছে। এসব দেশের মধ্যে ভারত এবং বাংলাদেশের নামও রয়েছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র সোশ্যাল মিডিয়া এক্সে উল্লেখ করেছে, “জর্জ সরোস ২৬০ মিলিয়ন ডলার পেয়েছিলেন ইউএসএআইডি’র কাছ থেকে। এই অর্থ ব্যবহার করা হয়েছে শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, ইউক্রেন, সিরিয়া, ইরান, পাকিস্তান, ভারত, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে অস্থিরতা সৃষ্টি, সরকার পরিবর্তন ও ব্যক্তিগত লাভের জন্য।”
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১৫ বছরে ইউএসএআইডি সরোসের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ২৭০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থ দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে এমন একটি সংগঠন- ইস্ট-ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট, যা সরোসের ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশনের সঙ্গে সংযুক্ত, তারা ইউএসএআইডি থেকে তহবিল পেয়েছে। এই তথ্য প্রকাশের পর আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক আন্দোলনে মার্কিন সরকারের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
ভারতের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল- ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) দীর্ঘদিন ধরে সরোসকে অভিযুক্ত করে এসেছে এই বলে, যে- সরোসের প্রতিষ্ঠানগুলো ভারতের বিরোধী দলগুলোকে সমর্থন ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সমালোচকদের অর্থায়ন করছে। বিজেপি নেতাদের দাবি, সরোসের উদ্যোগ ভারত সরকারে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির লক্ষ্যে এবং জাতীয় রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে।
তথ্যসূত্র : টাইমস অব ইন্ডিয়া, ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস, এক্স, দ্য সানডে গার্ডিয়ান, নিউ ইয়র্ক টাইমস
সাবস্ক্রাইব
সর্বশেষ খবরের সাথে আপডেট থাকুন।
শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে আইআরআই, এনইডি ও ইউএসএআইডি’র সম্মিলিত চক্রান্তের স্বরূপ
Previous Articleপ্রাথমিকের সাড়ে ৬ হাজার শিক্ষক নিয়োগ বাতিলের রায় স্থগিত
Next Article আমাদের কিছুই আর রইলো না