প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের পুত্র তানভীর ইমামের সাবেক স্ত্রীর গুলশানের বাড়িতে অননুমোদিত ও আইনবহির্ভূত তল্লাশি চালিয়ে তছনছ, ভাঙচুর ও লুটপাটের চেষ্টার ঘটনায় ব্যাপক সমালোচনা ও ধিক্কারের পর তিন জনকে আটক দেখিয়েছে পুলিশ।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাইভ করার মাধ্যমে তাণ্ডব চালানো গুলশানের ওই বাড়িটি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা, একাত্তরের মুজিবনগর সরকারের ক্যাবিনেট সচিব এইচ টি ইমামের পুত্র তানভীর ইমামের। ওই বাড়িটিকে এইচ টি ইমামের বাড়ি দাবি করে সেখানে হাজার কোটি টাকা গচ্ছিত রাখা হয়েছে, আওয়ামী লীগের নেতারা লূকিয়ে আছেন, অবৈধ অস্ত্র, সোনাদানা রয়েছে গোপন কুঠুরিতে- এমন গুজব ছড়ানো হয় মধ্যরাতে।
যার ওপর ভিত্তি করে মব তৈরি করে বিএনপির স্থানীয় নেতারা এবং বৈষম্যবিরোধী সমন্বয়করা মিলে। দরজা ভেঙে তল্লাশি করতে ঢোকে তারা। তাদের সাথে ছিল এলাকার কিশোর গ্যাংয়ের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরাও। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের লাইভে এসময় এই উগ্রবাদীদের সাথে কিছু ইউটিউবার এবং টিকটকারকেও দেখা যায়। সবাই মিলে মধ্যরাতে জ্বালাও-পোড়াও স্লোগান দিয়ে ওই বাড়িতে ঢুকে পড়ে।
শতাধিক উগ্রবাদী বাড়িটিতে ঢোকার আগে তথাকথিত মিডিয়াকর্মীদের নিয়ে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে স্লোগান দেয়। পরে বাড়িটিতে ঢুকে তল্লাশির অজুহাতে লণ্ডভণ্ড করে দেয় আসবাবপত্র ও অন্যান্য সামগ্রী। বড় আকারের লোহার মুগুর নিয়ে ভেতরের একটি কক্ষের দরজা ভেঙে ফেলে উন্মত্ত উগ্রবাদীরা। এসময় তারা জিনিসপত্র ভাঙচুর ও লুটপাটের চেষ্টা করে। যা লাইভ ভিডিওতে দেখা গেছে।
গুলশান-২ এ শাহাবুদ্দিন পার্কের পাশের ওই বাড়ির সামনে লোকজন জড়ো হয় রাত ১২টার দিকে। বিএনপির অঙ্গসংগঠন জাতীয়তাবাদী কেন্দ্রীয় চালকদলের সাধারণ সম্পাদক জুয়েল খন্দকারের নেতৃত্বে তারা জড়ো হয়ে দাবি করেন, এই বাড়ি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা প্রয়াত এইচটি ইমামের ছেলে তানভীর ইমামের। সেখানে বিপুল অস্ত্র ও অর্থ লুকিয়ে রাখা হয়েছে।
লোকজনের দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ার দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরাসরি প্রচার করেছে বেশ কয়েকটি বেসরকারি টেলিভিশিও। তাতে দেখা যায়, ‘আওয়ামী লীগের দালালেরা হুঁশিয়ার সাবধান’ স্লোগান দিয়ে দরজা ভেঙে ঢুকে পড়া লোকজন বাড়ির আলমারি, জুতা রাখার বাক্স, বিছানাপত্র সব ওলটপালট ও তছনছ করছে। এসময় সেখানে পুলিশ সদস্যরা উপস্থিত থাকলেও তাদের কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি।
সেখানে ঢুকে পড়া বিএনপি কর্মী শাকিল আহমেদ বলেন, এই বাড়িতে তানভীর ইমামের মেয়ে আছে, যার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। বাড়িতে অনেক অবৈধ জিনিসপত্র রয়েছে। এসব খবর পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে দেওয়া হলেও তারা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তাই আমরা নিজেরাই তল্লাশি চালাচ্ছি।
খবর পেয়ে রাত সাড়ে ১২টার পর সেখানে পুলিশ যায়। রাত দেড়টার দিকে যান সেনা সদস্যরা। ততক্ষণে ওই বাড়ির ভেতরে সবকিছু তল্লাশির নামে তছনছ করে ফেলা হয়।
গুলশান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোখলেছুর রহমান রাত ২টার দিকে বলেন, “এটি তানভীর ইমামের সাবেক স্ত্রীর বাড়ি। যার সঙ্গে ২০-২৫ বছর আগেই তানভীর ইমামের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় বলে আমরা জেনেছি।”
তিনি আরও বলেন, “বাড়িতে টাকা ও অস্ত্র আছে অভিযোগ করে ছাত্র পরিচয়ে কিছু মানুষ মিছিল নিয়ে ঢুকে পড়ে। আমাদের ধারণা, এর সাথে কিছু অছাত্রও ছিল। পুলিশ ওই বাড়িতে যাওয়ার পর তারা আবার মিছিল করতে করতে বেরিয়ে যায়। বাড়ির কোনো কিছু খোয়া গেছে কিনা বা কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা মালিকের সঙ্গে কথাবার্তা বলে নিশ্চিত হতে পারব।”
তার দাবি, পুলিশ যাবার আগেই বাড়ির সবকিছু তছনছ করে ফেলা হয়েছে।”
যদিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভিডিওতে দেখা গেছে উগ্রবাদীরা যখন ভাঙচুর চালাচ্ছিল, তখনও সেখানে পুলিশ সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
বাড়ির কেয়ারটেকার ও গাড়িচালক বলেন, রাতে লোকজন হঠাৎ ঢুকে পড়ে। প্রথমে আমরা তাদের ঠেকানোর চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আমাদের মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে তারা দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে পুরো বাড়ি তছনছ করে ফেলেছে।
কেয়ারটেকার বলেন, এটা এইচ টি ইমাম স্যারের বাড়ি নয়, এটা উনার বেয়াই রহমান স্যারের বাড়ি। উনার মেয়ের সঙ্গে এইচ টি ইমাম স্যারের ছেলে তানভীর ইমাম স্যারের বিয়ে হয়েছিল অনেক বছর আগে। ২০০১ সালে উনাদের ডিভোর্স হয়ে যায়। রহমান স্যার ও তার স্ত্রী মারা গেছেন। তার মেয়ে এই বাড়িতে থাকেন।”
এই ভাঙচুর-তাণ্ডব-লুটপাট চলাকালে এলাকার এবং বাইরের অনেক লোকও উৎসাহ নিয়ে বাড়িটিতে ঢুকে পড়েছিল। গণমাধ্যমকর্মীদের তারা জানান, কী হচ্ছে দেখার জন্য আর ফেসবুকে ‘ছাড়ার’ জন্য ভিডিও করতে তারাও ঢুকে পড়েছেন বাড়িতে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাইভে দেখা যায়, বিএনপির এক নেতা- জাতীয়তাবাদী চালক দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক জুয়েল খন্দকার হম্বিতম্বি করছেন, সবাইকে নির্দেশ দিচ্ছেন। তার নেতৃত্বেই সবকিছু ঘটছে, এমনটা বোঝা যায়।
গণমাধ্যমের কাছে জুয়েল দাবি করেন, এখানে আওয়ামী লীগের লোকজন লুকিয়ে আছে বলে তথ্য পেয়েছেন। তাছাড়া, বাড়িতে অস্ত্র এবং কোটি কোটি টাকা লুকানো রয়েছে বলেও জেনেছেন। তারা প্রথমে সেনাবাহিনীকে জানালে পুলিশকে জানাতে বলা হয়। পুলিশকে বলার পরেও না আসায় তারা দেড়-দুইশ ছাত্র-জনতা বাড়িতে তল্লাশি চালাতে ঢোকেন।
তাণ্ডবের পর রাত ১টার দিকে জুয়েল জানান, তারা তল্লাশি করে কিছু পাননি।
এ ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা দেখা দিলে তিনজনকে আটক দেখিয়েছে গুলশান থানা পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় মামলা প্রক্রিয়াধীন।
আটককৃতরা হলো- শাকিল খন্দকার (২৪), জুয়েল খন্দকার (৪৮) এবং শাকিল আহমেদ (২৮)। জুয়েল খন্দকার ও শাকিল খন্দকার সম্পর্কে পিতা-পুত্র।
প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, শাকিল আহমেদ (২৮) একসময় ওই বাড়িতে কেয়ারটেকারের কাজ করতো। সে-ই মূলত জনতাকে ২০০-৩০০ কোটি টাকা পাওয়া যেতে পারে তথ্য দিয়ে সেখানে তল্লাশি চালালোর জন্য উসকানি প্রদান করে।
এর আগে গত পরশু রাত সাড়ে ১০টার দিকেও একই অজুহাতে একদল জনতা বাড়িটিতে প্রবেশের চেষ্টা করে। কিন্তু পুলিশ এসে তাদের বুঝিয়ে সেখান থেকে সরিয়ে দেয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই মর্মে আবারও সতর্ক করছে যে, কেউ যেন আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়। কোথাও কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে যেন সঙ্গে সঙ্গে নিকটবর্তী থানাকে অবহিত করা হয়। সরকার দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সচেষ্ট রয়েছে ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানে বদ্ধপরিকর।
সাবস্ক্রাইব
সর্বশেষ খবরের সাথে আপডেট থাকুন।
আওয়ামী লীগ নেতার সাবেক পুত্রবধূর বাড়িতে মবের লুটপাট-ভাঙচুর, সমালোচনার পর আটক ৩
Previous Articleডাকাত আতঙ্কে সিলেটে লাঠিসোটা নিয়ে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায়