।। কাজী সালমা সুলতানা ।।
জাতীয় পতাকা একটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। একটি রাষ্ট্রের নাগরিকের অহংকার। তাই পতাকা রূপায়ণের মাঝে ফুটে ওঠে দেশের নাগরিকের পরিচয়, সব নাগরিকের গর্ব করার উপাদান। জাতীয় পতাকার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে সব দেশের নাগরিকই সদা সচেষ্ট থাকে। বাংলাদেশের মতো রক্ত দিয়ে কেনা পতাকার ক্ষেত্রে মর্যাদাবোধের জায়গাটি আরও বেশি স্পর্শকাতর। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরও পতাকা নিয়ে নতুন বিতর্ক তৈরি করা হচ্ছে। আর পতাকা তৈরির সঙ্গে যাঁরা সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তাঁদের নীরবতা ইতিহাস বিকৃত করার পথকে সহজ করে দিচ্ছে। জাতীয় পতাকা কখন, কেন, কীভাবে তৈরি হলো, সেই ইতিহাস বলার আগে রূপায়ণের ঘটনার আগের কিছু ইতিহাস প্রাসঙ্গিকভাবেই চলে আসে। ১৯৬২ সালের নভেম্বরে তৎকালীন ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন বাংলায় রূপান্তরের প্রশ্নে এক বৈঠকে বসেন। আলোচনায় এই তিন নেতা একমত হন এবং ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে প্রগতিশীল চিন্তার কর্মীদের নিয়ে একটি গোপন সংগঠন গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেন। এ সংগঠনের নাম দেওয়া হয় ‘স্বাধীন পূর্ব বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’। ১৯৬৬ সালের মধ্যে তারা গোটা পূর্ব বাংলায় সংগঠনের বিস্তৃতি ঘটাতে সক্ষম হন। ছাত্রলীগের অন্য নেতারা মনে করতেন বিষয়টি সংগঠনের অভ্যন্তরের উপদলীয় বিষয়। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের সব কর্মকাণ্ড এ তিন নেতার মাধ্যমে পরিচালিত হতো। তাঁদের পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ বা স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এই নিউক্লিয়াস স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের মাধ্যমে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার আন্দোলনকে স্বাধীনতা আন্দোলন এবং স্বাধীনতার আন্দোলনকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের দিকে নিয়ে যেতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ৬ জুন ১৯৭০ সালে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের নিউক্লিয়াস সদস্য কাজী আরেফ আহমেদ তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ১১৬ নম্বর কক্ষে ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ, ডাকসুর সহসভাপতি আ স ম আবদুর রব ও ছাত্রনেতা মনিরুল ইসলামকে (মার্শাল মনি) ডেকে পতাকা তৈরি করার জন্য বলেন। তিনি জানান, এখন এটি ব্যাটালিয়ন পতাকা হিসেবে ব্যবহার করা হবে এবং পরবর্তীকালে জাতীয় পতাকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হবে। এ সময় মনিরুল ইসলাম ও আ স ম আবদুর রব একমত হন পতাকার জমিন অবশ্যই গাঢ় সবুজ রঙের (বটল গ্রিন) হতে হবে। শাজাহান সিরাজ বলেন, লাল রঙের একটা কিছু পতাকায় থাকতে হবে। এরপর কাজী আরেফ আহমেদ গাঢ় সবুজের ওপর লাল সূর্যের একটি পতাকার নকশা তৈরি করেন। পতাকার নকশা দেখে সবাই একমত হন।
এ সময়ে কাজী আরেফ আহমেদ প্রস্তাব করেন, লাল সূর্যের মাঝে সোনালি রঙে পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র দিতে হবে, না হলে পাকিস্তানিরা আমাদের স্বাধীনতা নিয়ে যে নানা অপপ্রচার করে থাকে, পতাকা নিয়েও তা-ই করবে। পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের ন্যায়সংগত আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করতে ‘ভারতের হাত আছে, ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের কাজ বা ভারতীয় এজেন্টদের কার্যকলাপ’ বলে অপপ্রচার করত। এ ছাড়া এই সময়ে পাকিস্তানিরা বাঙালির আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্য, পূর্ব পাকিস্তান এবং মিয়ানমারের আরাকান রাজ্য নিয়ে একটি কাল্পনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অপপ্রচার চালাত। এ কাজে সরকারের প্রশাসনযন্ত্রেরও সাহায্য নেওয়া হতো। কাল্পনিক এ রাষ্ট্রের নাম তারা দিয়েছিল ‘ইউনাইটেড স্টেটস অব বেঙ্গল’ বা ‘বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র’। এ ধরনের অপপ্রচার থেকে রক্ষা পেতে পতাকার লাল সূর্যের মাঝখানে সোনালি আঁশ ও পাকা ধানের রঙে বাংলাদেশের মানচিত্র রাখার কথা বলেন কাজী আরেফ আহমেদ। এ বিষয়ে তাঁরা একমত হন এবং পতাকা নিয়ে আলাপ করতে সিরাজুল আলম খানের কাছে যান। সার্জেন্ট জহুরুল হক হলেরই তিন তলার একটি কক্ষে সিরাজুল আলম খান প্রায়ই থাকতেন।
স্বভাবতই স্বাধীনতা কার্যক্রমের একজন ঊর্ধ্বতন নেতা হিসেবে তাঁর অনুমোদন তাঁরা নিতে গেলেন। পতাকা তৈরিসহ সব কার্যক্রম সম্পর্কে তাঁকে জানানো হলো। তিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, যে নামেই পতাকা প্রদর্শন কর না কেন, সে পতাকাকে জনগণের ভবিষ্যৎ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা হিসেবে ভেবে নিতে কোনো বাধা থাকবে না। এরই মধ্যে এখানে যোগ দেন ছাত্রনেতা কামরুল আলম খান খসরু, স্বপন কুমার চৌধুরী, হাসানুল হক ইনু, ইউসুফ সালাহউদ্দিন আহমেদ ও নজরুল ইসলাম। তাঁরা সবাই স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের সদস্য। কামরুল আলম খান খসরু, স্বপন কুমার চৌধুরী, হাসানুল হক ইনু ও নজরুল ইসলামকে পাঠানো হলো পতাকা সেলাই করে আনতে। ছাত্রলীগ অফিস বলাকা ভবনে এবং এখানে অনেক দরজির দোকান আছে। তাই তাঁরা নিউমার্কেটে গেলেন। গভীর রাত দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে। ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে অ্যাপোলো নামক দোকান থেকে সবুজ ও লাল রঙের লেডি হ্যামিলটন কাপড় কিনে অপর এক রঙের দোকানিকে জাগিয়ে সোনালি রং ও তুলি কিনে নিয়ে তাঁরা যান বলাকা ভবনে। সেখানে দরজির দোকান থেকে দরজিকে ঘুম থেকে তুলে পতাকা তৈরি করা হয়।