বাংলাদেশে ২০০৭-০৮ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জনগণের প্রত্যাশার চেয়ে জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তাদের ভাবনাকে যুক্তরাষ্ট্র বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল। এর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্ব ছিল নির্বাচনের সময়সীমার ওপর। ওই সময়ে বাংলাদেশ নিয়ে মার্কিন এই নীতি বড় ভুল ছিল বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক উপরাষ্ট্রদূত জন ড্যানিলোভিচ।
গত শনিবার রাজধানীতে এক আলোচনায় বাংলাদেশে ২০০৭-০৮ সালের রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে নিজের দেশের ভূমিকা নিয়ে এমন মন্তব্য করেন সাবেক এই মার্কিন কূটনীতিক। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা নিয়েছিল। ওই ঘটনা ওয়ান ইলেভেন বা এক-এগারো নামে পরিচিত। জন ড্যানিলোভিচ ওই সরকারের আমলে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের রাজনৈতিক কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করতেন।
‘নতুন ভোরের পথে ঢাকা: গণ-অভ্যুত্থানের পরবর্তী বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের নতুন গতিপথ’ শীর্ষক ওই আলোচনার আয়োজন করে গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস)। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস-বিস) মিলনায়তনে ওই আলোচনায় আরও অংশ নেন বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলাম। তিনি ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বে ছিলেন।
সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমানের সঞ্চালনায় আলোচনা অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তৃতা করেন সংস্থার চেয়ারম্যান মুনিরা খান। এরপর সঞ্চালকের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন সাবেক ওই দুই মার্কিন কূটনীতিক। শেষ পর্বে আমন্ত্রিত অতিথিদের বিভিন্ন প্রশ্নেরও উত্তর দেন তাঁরা।
অনুষ্ঠানে সাবেক এই দুই মার্কিন কূটনীতিক বাংলাদেশে নিজেদের অভিজ্ঞতার পাশাপাশি গত ১৫ বছরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন। বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অধোগতি, ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের সম্পর্ক, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান–পরবর্তী বাংলাদেশ, ভবিষ্যতের পথযাত্রাসহ নানা বিষয়ে তাঁরা নিজেদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং প্রত্যাশার কথা তুলে ধরেন।
প্রসঙ্গ এক-এগারো
সাবেক কূটনীতিক জন ড্যানিলোভিচের কাছে সঞ্চালক জিল্লুর রহমানের প্রশ্ন ছিল ২০০৭-০৮ সালের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মার্কিন কূটনীতিকদের ভূমিকার বিষয়ে। এ সময় জন ড্যানিলোভিচ জানান, ওই পর্ব নিয়ে কিছু সংবেদনশীল বিষয় রয়েছে, যেগুলো জনসমক্ষে প্রকাশ করার সুযোগ নেই। কারণ, তাঁকে এবং উইলিয়াম মাইলামকে যাঁরা তথ্যগুলো দিয়েছেন, তাঁদের সুরক্ষার স্বার্থে তা তাঁরা দুজন গোপন রাখছেন।
একপর্যায়ে জন ড্যানিলোভিচ বলেন, ‘(মার্কিন কূটনীতিক হিসেবে) আমি প্রথম স্বীকার করছি, ২০০৭-০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র বড় ভুল করেছিল। তবে রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিস (ঢাকায় তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত) কিংবা আমার সহকর্মীরা এক-এগারো ঘটাননি। আমি মনে করি না, কোনো গোপন ‘কফি গ্রুপ’ সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বাংলাদেশের জনগণকে বাস্তবায়ন করার নির্দেশ দিয়েছিল। তখন (সেনাসমর্থিত সরকার দায়িত্ব নেওয়ার আগে) অবশ্যই বাংলাদেশ যে পথে এগোচ্ছিল, তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বেশ কিছু উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ ও সেনাবাহিনীর মতো আমাদেরও লক্ষ্য একই রকম ছিল।’
জন ড্যানিলোভিচ ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের পরের বিষয়টিও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘১৯৯০ সালে গণতন্ত্র নিয়ে যে অঙ্গীকার করা হয়েছিল, তা থেকে বিচ্যুতি ঘটেছিল। ফলে মৌলিক গণতান্ত্রিক সংস্কারের প্রয়োজন ছিল। তাই সংস্কারের এজেন্ডায় আমরা সমর্থন দিয়েছিলাম। আমরা সেনাসমর্থিত সরকারকে সমর্থন দিয়েছিলাম। আমরা সব পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতাম। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে আমাদের বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা ছিল। বিপুলসংখ্যক জনগণের কণ্ঠস্বরের যে প্রতিফলন হওয়ার কথা ছিল, সে সময়ে তা হয়নি।’
জন ড্যানিলোভিচ বলেন, ‘আমরা এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরের গোষ্ঠীসহ অনেকেই জেনারেল ও ব্রিগেডিয়ারদের ভাবনাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলাম। গুরুত্ব দিইনি বাংলাদেশের জনগণ কী চেয়েছিল সে বিষয়ে। আমরা নাগরিক সমাজের সঙ্গে কথা বলতাম। আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলতাম। আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গেও কথা বলতাম। হয়তো সেনাবাহিনীর কথাই আমরা বেশি শুনেছিলাম। আংশিকভাবে সম্ভবত সে কারণেই গণতন্ত্রের উত্তরণ নিয়ে যে প্রত্যাশা ছিল, তা বাস্তবায়িত হয়নি।’
সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নিজেদের ভুলের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে জন ড্যানিলোভিচ বলেন, ‘আমাদের দ্বিতীয় ভুলটি ছিল নির্বাচনের সময়সীমার ওপর বেশি জোর দেওয়া। নির্বাচন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের দীর্ঘ সময়ের রায় (ম্যান্ডেট) ছাড়া কোনো সরকার পরিচালিত হতে পারে না। আর নির্বাচিত সরকারকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া উচিত। ওই সময় মৌলিক কিছু সংস্কারের প্রয়োজন ছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংস্কারের এজেন্ডাও এগিয়ে নিচ্ছিল। কিন্তু একটা সময়ে এসে এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে নির্বাচনের আয়োজন করে দায়িত্ব হস্তান্তরই তাদের প্রধান অগ্রাধিকার।’
একপর্যায়ে তখনকার সরকার রাজনৈতিক দলের ওপর থেকে তাদের সব ধরনের প্রভাব হারিয়ে ফেলে বলে মন্তব্য করেন জন ড্যানিলোভিচ। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের বোঝাপড়াটা হয়েছিল গোপনে।
সাবস্ক্রাইব
সর্বশেষ খবরের সাথে আপডেট থাকুন।
ওয়ান-ইলেভেনে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের ভূমিকায় বিরাট ভুল ছিল: সাবেক মার্কিন কূটনীতিক
Previous Articleধর্ষিতা আছিয়া যেন ভণ্ডদের ধোঁকার উপলক্ষ না হয়