।। মনজুরুল হক ।।
গত কয়েকদিন ধরে ‘সেনাবাহিনীতে ক্যু’ এমন খবর চাউর হয়েছে। বিশেষ করে সেনাপ্রধান ২৫ ফেব্রুয়ারি খোলামেলা বক্তব্য দেওয়ার পর সরকারের রুষ্ঠ প্রতিক্রিয়ার ধারণা করা হচ্ছিল-এবার সেনাপ্রধান পাল্টা নেবেন, কেননা এটা তো পরিষ্কার ৫ আগস্টের পর রাষ্ট্রের নিরাপত্তার দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। তার বদলে তিনি মধ্য আফ্রিকায় বাংলাদেশি সেনাদের কন্টিনজেন্ট পরিদর্শনে গেলে গুজব ডালপালা বিস্তার করতে থাকে।
🔘
সরকার পক্ষের অতি পণ্ডিতরা বলতে থাকেন-‘তিনি পালিয়েছেন বা তাঁকে আর দেশে আসতে দেওয়া হবে না’। পরে মনের মাধুরী মিশিয়ে চাউর করা হয়-‘এবার ‘চুপ্পুকে’ হঠিয়ে ড, ইউনূস ক্ষমতা পাকাপোক্ত করবেন’। উঠে আসে ‘আইএসআই-এর প্রিয়ভাজন’ কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল লে. জে. মোহাম্মদ ফয়জুর রহমান ‘সিনে’ আসবেন। মনে করা হয় তিনি জামাত তথা র্যাডিক্যাল ইসলামিস্টপন্থী। কয়েক মাস ধরেই আইএসআই কানেক্টেড।
🔘
বিভিন্ন সূত্র মতে সেনাপ্রধান যখন আফ্রিকায় তখন বেসামরিক সফরে একজন ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তার নেতৃত্বে চার জনের একটি দল MOA চুক্তি করতে বাংলাদেশে আসেন। অথচ তারা বাণিজ্য উপদেষ্টা বা এই জাতীয় কারও সঙ্গে বৈঠক করেননি। তারা এখানে বসে কী করেছিলেন জানা যায়নি। তবে রেজাল্ট হিসাবে দেখা গেল ৭ মার্চ যেদিন হিজবুতের ‘মার্চ ফর খিলাফত’ কর্মসূচি ঘোষণা হয়েছে, ওই দিন বিকেলে বা সন্ধ্যায় সেনাপ্রধানের দেশে ফেরার কথা থাকলেও তিনি ৭ ঘন্টা আগে অকস্মাৎ ফেরেন। অসমর্থীত সূত্র মতে তিনি শাহজালালের বদলে তেজগাঁও আর্মি নিয়ন্ত্রণাধীন বিমানবন্দরে ল্যান্ড করেন।
বানচাল হয়ে যায় একটি ‘ওয়েল ডিসাইসিভ প্ল্যান’। আরও বানচাল হয়ে যায় হিজবুতের মিছিলের ডেস্টিনেশন।
🔘
ধারণা করা যায় সেনাপ্রধানকে শাহজালাল বিমানবন্দরেই কনফ্রন্টেশনে ফেলা হতো। তিনি গ্রেফতারও হতে পারতেন। তার চেয়ে ভয়ঙ্কর কিছুও ঘটতে পারত। জনাব রহমান জেনারেল ওয়াকারকে সরাতে একটা মিটিং ডেকেও আশানুরূপ সাড়া পাননি।
এরপর জোর গুজব রটে যায় তার কয়েকজন অনুগামী অফিসারসহ লেফটেন্যান্ট জেনারেল মোহাম্মদ ফয়জুর রহমান ‘গৃহবন্দী’।
🔘
প্রকৃত ঘটনা হলো সম্ভবত ৯ তারিখ রাতে সেনাপ্রধান জরুরি সভা আহ্বান করেন। সেখানে কথিত ‘একাধিক পক্ষের’ সকল কর্মকর্তারা ছিলেন। সেনাপ্রধান অন্যান্য অনেক কথার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটি স্মরণ করিয়ে দেন-‘দেশের মানুষ আমাদের উপর দেশরক্ষার দায়িত্ব দিয়েছে। আমরা যেন সে কাজ সকল দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে পালন করতে পারি।‘
🔘
লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম কামার-উল-হাসানের নেতৃত্বে যে সদলবলে পাকিস্তানের সেনাপ্রধানের সঙ্গে দেখা করে এসেছেন, সেটা গুজব নয়। বাংলাদেশে গত কয়েক মাসে একাধিকবার আইএসআই-এর প্রতিনিধিরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল সফর করেছেন, সেটা গুজব নয়। আইএসআই-এর পরামর্শে পাকিস্তান লালমনিরহাটের পরিত্যাক্ত এয়াপোর্ট রিনোভেশন করে সেখানে যুদ্ধবিমান ডেপ্লয় করতে চায় সেটাও গুজব নয়।
🔘
বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে মতাদর্শীকভাবে মোটা দাগে দৃশ্যত তিনটি ধারা বিদ্যমান। গত কয়েকদিনের গুজব এবং চাপান-উতর-এ সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানের অবস্থান আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে মজবুত হয়েছে।
🔘
যে র্যাডিক্যাল গোষ্ঠীর বাড়াভাতে ছাই পড়েছে তারা রটিয়েছেন-সেনানিবাসে মাইল্ড ক্যু হয়েছে। আওয়ামী লীগপন্থীদের অনেকে মনে করেন সেনাপ্রধান র্যাডিক্যাল ইসলামিস্টদের প্রতি নমনীয়। ৫ আগস্টে তিনি সবার আগে ‘জামাত’এর নাম বললেন, আসিফ নজরুলকে ‘স্যার’ বললেন, এসব কিছু ম্যাটার করে না। মধ্যপন্থা অবলম্বন করে যথাসময়ে কফিনের শেষ পেরেকটি তিনিই মারবেন এ ব্যাপারে সন্দেহ নাই। আগেও বলেছি-বাংলাদেশের ইতিহাসে মার্চ বরাবরই অগ্নিগর্ভ মাসের নাম। ১১ মার্চ, ২০২৫
লেখক: সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।