।। আহমাদ ইশতিয়াক ।।
সৈয়দ মুজতবা আলীকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, আপনার দেখা সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী লেখক পাঠক এবং রুচিশীল মানুষ কে?
মুজতবা আলী বিন্দুমাত্র অপেক্ষা না করেই বলেছিলেন, আবু সয়ীদ আইয়ুব।
মজার বিষয় হলো বাংলা ভাষার এই কিংবদন্তির মাতৃভাষা কিন্তু বাংলা ছিলো না। ছিলো উর্দু। অথচ তাঁদের তিন পুরুষ ধরে কলকাতায়। অথচ তাঁদের কেউই বাংলা শিখতে আগ্রহী ছিলেন না।
তিনি বলেছিলেন ও, ‘উর্দুতে ‘গীতাঞ্জলি’ পড়ে মুগ্ধ হয়ে মূল বাংলা ভাষায় ‘গীতাঞ্জলি’ পড়বার দুর্দম আগ্রহই আমাকে বাংলা শিখতে বাধ্য করে।’
অথচ বাংলা ভাষার উপর তাঁর দখল আর দক্ষতা দেখে কেউ শুনলে চোখ আকাশে উঠবে।
তাঁর লেখা “পান্থজনের সখা” পড়লে বোঝা যায় তিনি কতো উচ্চমানের প্রাবন্ধিক। প্রতিটা লাইন যেন অমিয় সুধার মতো। রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে এতো নির্মোহ আর অসাধারণ আলোচনা!
কিংবা “আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ”। যেখানে তিনি দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ সময়ের চেয়ে কতোখানি এগিয়ে।
রবীন্দ্র-ভাবনা আইয়ুবের মনে উদিত হয়েছে মূলত তিরিশের দশকের কবিদের কবিতার পাঠক ও ভাবচেতনায।
আবু সয়ীদ আইয়ুব রবীন্দ্র অনুরাগী ছিলেন ঠিক, আবার রবীন্দ্রনাথের গান, প্রবন্ধ সবকিছুই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ ও করেছেন তিনি।দ্বিধা করেননি সেটা বলতে।
আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ নিয়েই বলি।
আইযুব ‘আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে রবীন্দ্রসাহিত্য আলোচনা করতে গিয়ে অন্য ভাষার লেখকদের প্রসঙ্গ টেনেছেন, তুলে এনেছেন রবীন্দ্রোত্তর বাংলা সাহিত্যের কবিদের প্রসঙ্গও।
আইয়ুব লিখেছিলেন—’বাংলাসাহিত্যে অনেকেই প্রতিভার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে গেছেন তাঁদের সাহিত্যসৃষ্টিতে। রিল্কের ডুইনো এলিজিস, এলিয়টের ফোর কোয়াটেট্স, মান্-এর ম্যাজিক মাউন্টে, কামুর আউট সাইডার, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝি, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের “পথের পাঁচালি”, বুদ্ধদেব বসুর তপস্বী ও তরঙ্গিনী সর্বদেশকালের সৎ সাহিত্যের স্থান পাওয়ার যোগ্য।’ গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি দেশি-বিদেশি সাহিত্যের প্রতিভাবানদের প্রসঙ্গে খোলামেলা কথা বলতে দ্বিধা করেননি।
আধুনিক কালের কবি সাহিত্যিকদের সাহিত্যকর্মের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মের তুলনামূলক আলোচনা প্রসঙ্গে আইয়ুব লিখেছিলেন—”আধুনিক কালের বাঙালী কবিদের মধ্যে অমিয় চক্রবর্তী যদিও আমার প্রিয়তম কবি তবুও বিষ্ণু দে এবং সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে রাজনৈতিক মতবিরোধ আমাকে বাধা দেয়নি। তাঁদের কবিতার গুণমুগ্ধ পাঠক হতে; তেমনি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এবং সাম্প্রতিককালের বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে সাহিত্যে মতভেদ সত্ত্বেও আমি মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করি, তাঁদের সৃজনশীলতা সাহিত্যকর্মে স্থায়ী ঐতিহাসিক মূল্য; যেমন স্বীকার করি আরও একটু স্তরে বোদলেয়র, ভেলেরি, ফকনার এবং কাফকার সৃষ্ট প্রতিভা। এরা সবাই আধুনিক।’
এক জায়গায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর ঈশ্বরভাবনা প্রকাশ করতে গিয়ে লিখেছিলেন, ‘অর্ধেক মানবী তুমি, অর্ধেক কল্পনা।’ আইয়ুব সেই প্রসঙ্গে আলোকপাত করলেন, ভক্ত কি ভগবানকে বলতে পারে না – ‘অর্ধেক সত্য তুমি, অর্ধেক আমারই রচনা?’
কতোটা আত্মস্থ আর ধারণ করলে এমনটা অনুধাবন সম্ভব!। কিংবা পথের শেষ কোথায় প্রবন্ধ সংকলন। যেটি
কবির কবিতার আধ্যাত্মিক উপাদান বিশ্লেষণ করতে গিয়ে একটি কবিতা থেকে কথাটি উল্লেখ করেছেন তিনি। এক প্রবন্ধে তিনি দারুণ ভাবে উল্লেখ করে লিখেছিলেন “মানুষের জীবন যদি অভিশপ্ত হয়ে থাকে, তবে অভিশাপ মোচনের দায়িত্বও মানুষের ওপরই বর্তায়, সত্য বা মিথ্যা দেবতার ওপর নয়।”
তাঁর প্রজ্ঞা আর জ্ঞান যেন সমুদ্রের মতো ছিলো।
তাঁর বিয়েটাও এক আশ্চর্য ঘটনা। তিনি তখন বিশ্বভারতীতে দর্শন বিভাগে নিজাম অধ্যাপক।তাও কিছুদিন ছিলেন। সেখানে পরিচয় হলো গৌরি দত্তের সঙ্গে।
তাঁর ছাত্রী ছিলেন দর্শনের প্রখ্যাত অধ্যাপক ধীরেন্দ্রমোহন দত্তের কন্যা গৌরী দত্ত। পরিচয়ের পরে প্রেম।
১৯৫৪ সালে একদিন আবু সৈয়দ আইয়ুব ও গৌরী দত্তের বিয়ে হলো। এই অসমবয়সী আন্তঃধর্মীয় বিবাহ সে সময় আলোড়ন ফেলেছিলো। গৌরীকে দত্তকে আর আজীবন মেনে নেননি তাঁর বাবা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তাঁদের দাম্পত্য নিয়ে সৈয়দ মুজতবা আলী লিখেছিলেন, তাঁর দৃষ্টিতে সবচেয়ে রুচিশীল ও প্রজ্ঞাবান দম্পত্তি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা অসামান্য। বিশেষ করে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষের প্রতি তাঁর যে মমতা আর সহায়তা ছিলো তা অনস্বীকার্য। আর্থিকভাবেও অর্থ দান করেছিলেন প্রবাসী সরকারের মুক্তিযুদ্ধ ফান্ডে।শেষে এসে একটা মজার তথ্য দিই। সৈয়দ মুজতবা আলী এবং আবু সয়ীদ আইয়ুব সপ্তম শ্রেণীতে সিলেটে একসঙ্গে পড়েছিলেন ও। যদিও পরের বছরই তাঁকে কলকাতায় নিয়ে যায় তাঁর পরিবার। ঐ একবছর বিশেষ এক কারনে আইয়ুবকে সিলেটে পাঠিয়েছিলো তাঁর পরিবার। বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই তাঁর প্রতি।