।। গোলাম হোসেন ।।
সতেরো মার্চ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। বর্তমান বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় উনিশ শ’ বিশ সালের সতেরো মার্চ খ্যাতিমান মহাপুরুষ বিস্ময়ে বিস্ময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেন। দুনিয়ার বুকে তিনি দৃশ্যমান ছিলেন পঞ্চান্ন বছর চার মাস সাতাশ দিন। তারমধ্যে কারাগারে ছিলেন বারো বছর দশ মাস দুই দিন। তার কায়া অদৃশ্য হলেও তাঁর ছায়া, তাঁর কর্ম, তাঁর বীরত্ব, তাঁর অলৌকিকতা, তাঁর সততা, তাঁর একাগ্রতা, তাঁর সাহসিকতা, তাঁর কন্ঠস্বর বেঁচে আছে বাংলার মানুষের অন্তরে।
বাংলার শ্যামল প্রকৃতি এবং বাংলার মাটি ও মানুষের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে অগনিত মানুষের হৃদয়াসনে। ক্ষণজন্মা এই মহাপুরুষের ক্ষয় নেই। তিনি অক্ষত, অজেয়, দুর্বার, তিনি বিস্ময়ে বিস্ময়। আজ দুই হাজার পঁচিশ সালের মার্চ মাসে তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে আমার এই লেখা। আজ তাঁকে ছোট করা হচ্ছে, তাঁর নাম নিশানা মুছে দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে, ঢাকায় তিনি যেখানে বসবাস করতেন ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বরের বাড়ি, যেই বাড়িটিকে তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে জণগনের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়ে “বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর” করা হয়েছিল, সেই বাড়িটি তথা যাদুঘরটি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে। তাঁর নামে নামকরণ করা সকল প্রতিষ্ঠানের নাম বদলে ফেলা হয়েছে, বিভিন্ন স্থানে নির্মিত তাঁর ম্যুরাল বা স্ট্যাচু ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে, কিছু অর্বাচিন ছেলে-মেয়ে বলছে, তাঁকে ‘জাতির পিতা’ মানি না। ইংরেজ রক্তে আবির্ভূত কিছু বাংলাদেশী বলে, তিনি স্বাধীনতা চাননি, বাংলাদেশ চান নি, ভাষা আন্দোলনে জড়িত ছিলেন না, তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন নি, তিনি পতাকা উড়ান নি, তিনি পাকিস্তানিদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন।
তাঁদের এমন মন্তব্যে আমরা বিস্মিত হচ্ছি না। কারণ ১৯৫৭ সালে এই বাঙালির মগজে সিরাজের ভাবমূর্তিতে ছিলেন মীরজাফর আর মীরজাফরের ভাবমূর্তিতে ছিলেন সিরাজ। সিরাজুদ্দৌলার যেদিন মৃত্যু হয়েছিল, সেদিন সিরাজুদ্দৌলার লাশ আনন্দভরে বিশ্বাসঘাতক পরিচয় দিয়ে সাড়া মুর্শিদাবাদ ঘুরানো হয়েছিল। তারপরের বাস্তবতা আমরা সবাই জানি যে, মীরজাফর একটি গালির নাম, সিরাজ একটি আদর্শের নাম, একটি দেশপ্রেমিকের নাম। ইংরেজ রক্তের ধারাবাহিকতায় কারো জন্ম হলেও মীরজাফর নাম রেখেছে এমন কাউকে খুঁজে পাবেন না, সিরাজ নামের অনেক মানুষ পাবেন। আজ যেসকল ছাত্র-যুবকরা ইতিহাস জানতে আগ্রহী নন বা ইতিহাসের বিকৃত রূপ জেনেছেন, একদিন অবশ্যই তারা সঠিক ইতিহাস জানবেন এবং সঠিক ইতিহাস জানতে আগ্রহী হবেন।
আজকে যারা বঙ্গবন্ধুকে হেয় করার হীন চেষ্টা করছেন, ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়েও তাদের বা তাদের বাপ-দাদার নাম ছিলো না, অদূর ভবিষ্যতেও তাদের বা তাদের বাপ-দাদার নাম থাকবে না, তাদের মধ্যে কারো নাম থাকলেও মীরজাফর হিসেবে থাকবে। ইতিহাসের সত্যটা জানুন, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রাত সন্ধ্যায় কিস্তানের শাসক ইয়াহিয়া খানের ভাষণ রেডিও বেতারে সম্প্রচার হয়েছে, সেখানে তাঁর কণ্ঠে শুধু একটি নামই শোনা গিয়েছে, শেখ মুজিব, শেখ মুজিব। সেদিন জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে ইয়াহিয়া বলছিলো, “মুজিব ইজ এ ট্রেইটর টু দ্য নেশন, দিজ টাইম হি উইল নট গো আনপানিসড”। কত লোক স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন, কত লোক পতাকা উড়িয়েছেন, কত লোক প্রাণ দিয়েছেন, কত লোক দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, কাউকেই ইয়াহিয়া চিনতেন না, কারো নাম জানতেন না, নরাধম ইয়াহিয়ার খাতায় একটিই নাম ছিলো ‘শেখ মুজিব’। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গোটা বিশ্ব মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে যখন ভাষণ দিতে দাঁড়ালেন, তাঁর কন্ঠে যখন উচ্চারিত হলো, ‘ভায়েরা আমার’, সেই ডাকে যেই সম্মোহন সৃষ্টি হয়েছিল, বাঙালির মধ্যে যেই আবেগ সৃষ্টি হয়েছিল, বঙ্গবন্ধুর প্রতি বাঙালির সেই আবেগ দেখে গোটা বিশ্ববাসী বিস্মিত হয়েছিল। ইতিহাসে এমন মহাপুরুষের আবির্ভাব খুব কমই হয়। এ কারণে গর্বের জাতি বাঙালি জাতি, তাঁরা বঙ্গবন্ধুর মতো একজন মহান নেতাকে পেয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশকে নেলসন মেন্ডেলা কোনদিন বাংলাদেশ বলেন নি, তিনি বলতেন, শেখ মুজিবের দেশ, মুজিবের বাংলাদেশ।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধু সর্বস্তরের জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। স্বাধীনতা ঘোষণার অব্যবহিত পর পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে তাকে গ্রেপ্তার করে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে আটক রাখা হয়। দীর্ঘ নয় মাস কারাভোগের পর ১৯৭২ সালের ৭ই জানুয়ারি দিবাগত রাত অর্থাৎ ৮ই জানুয়ারির প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে লন্ডনগামী বিমানে তুলে দেওয়া হয়। সকাল সাড়ে ৬টায় তিনি লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছান।
পরের দিন ৯ই জানুয়ারি ব্রিটেনের বিমান বাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে করে দেশের পথে যাত্রা করেন, দিল্লী হয়ে তিনি ১০ই জানুয়ারি ঢাকা ফেরেন। ১৯৮০ সালের মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি-তে বঙ্গবন্ধু পরিষদ আয়োজিত সভায় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের তদানীন্তন বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মাদ হোসেন বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেন, “১৯৭২ সালের ৮ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বৃটেন আসেন, আমি তখন বিদেশের এক হোটেলে বসে টেলিভিশনের পর্দায় সেই দৃশ্য দেখছিলাম, একটি চিত্র আমার চোখের সামনে আজো ভাসছে, বঙ্গবন্ধু লন্ডনে পৌঁছান, বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ্ তখন লন্ডনের বাইরে, খবর পেলেন শেখ মুজিব এসেছেন, ছুটে এলেন সমস্ত কর্মসূচি বাতিল করে দিয়ে, শেখ মুজিব তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসছেন ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে, গাড়ি যখন এসে ১০ নং ডাউনিং স্ট্রীটে থামল, বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ্ নিজে গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে রইলেন যতক্ষণ শেখ মুজিব গাড়ি থেকে বেরিয়ে না এলেন।” এইতো বিশ্বের কাছে বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পূর্বেই ৯ই জানুয়ারি দিল্লীতে যখন ইন্দিরা গান্ধীর সাথে কথা হলো, তিনি বললেন, আপনার ভারতের সৈন্য আমার দেশ থেকে কবে ফেরত আনবেন, ইন্দিরা গান্ধী বললেন, আপনি যেদিন বলবেন, সেদিনই। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ১৭ই মার্চ। জানিনা এক সপ্তাহ সময় বেঁধে দিয়েছিলেন, না-কি তাঁর জন্মদিনের দিন বাংলাদেশকে ভারতের সৈন্যমুক্ত দেখতে চেয়েছিলেন। এইতো বঙ্গবন্ধু। মাথা উঁচু বিশ্ব নেতৃত্বের সামনে দাঁড়িয়েছেন। তিনিই প্রথম বাঙালি, যিনি জাতিসংঘের অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দিয়েছেন, বিশ্বের কাছে তিনিই শ্রেষ্ঠ বাঙালি। আজ বঙ্গবন্ধুকে খাঁটো করা হয়, যারা করেন তাঁরা ইতিহাস বিকৃত করেন বা হীনমন্যতায় ভোগেন।
আমি কাউকে ছোট করবো না। প্রত্যেকের প্রতি সম্মান থাকবে, যার যার প্রাপ্য সম্মান দিতে কৃপণতা করা মনুষ্যত্ব নয়। বঙ্গবন্ধুকে সম্মান দিতে যারা কৃপণতা করেন, তাদের উদ্দেশ্যে বলবো, দেশের ইতিহাসের কষ্টি পাথরে যুগের শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসাবে বঙ্গবন্ধুর নাম অংকিত থাকবে। তিনি মহাপুরুষ, তিনি মহানায়ক, তিনি লৌহমানব, তিনিই বাংলার অবিসংবাদিত নেতা। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, যতদিন বাংলা ভাষা থাকবে, যতদিন বাংলা থাকবে, যতদিন বাংগালী থাকবে, যতদিন পদ্মা-মেঘনা-গৌরি-যমুনা বহমান থাকবে, যতদিন ব্রহ্মপুত্র-ধলেশ্বরী-করতোয়া কীর্তনখোলা নদীর দুই তীরে মানুষ বেঁচে থাকবে, যতদিন এ দেশের মানুষের হৃদয়ের উত্তাপ থাকবে, ততদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নাম মানুষের হৃদয়ের মনিকোঠায় চির জাগরূক থাকবে। ইতিহাসের রাখালরাজা মহাপুরুষ বিশ্ব শান্তির অগ্রদূত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি। সার্থক জন্ম তোমার বঙ্গবন্ধু, যেই মাসে জন্মেছো, সেই মাসেই বাংলার মানুষের মুক্তির ডাক দিয়েছো, সেই মাসেই বাংলার অবিসংবাদিত নেতা হয়েছো, বাঙালির হৃদয়ের মণিকোঠায় চিরন্জীব হয়েছো, তোমাকে লাল সালাম।
লেখক পরিচিতি: রাজনৈতিক কর্মী