
।। আলমগীর শাহরিয়ার ।।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা যখন ভর্তি হই তখন ভিসি ছিলেন অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ। বর্তমানে ইউজিসির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করা প্রফেসর ফায়েজ বিএনপি ঘরানার রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট সজ্জন একজন শিক্ষক ছিলেন। সুন্দর ও সাবলীলভাবে কথা বলেন। তাঁর কথার মধ্যে একটা ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে আওয়ামীলীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে। সেবার তরুণ ভোটারদের ভোট নির্বাচনে বিপুল প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। পরে জানুয়ারি মাসেই ভিসি হিসেবে নিয়োগ পান আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক (আবু আহসান মোহম্মদ সামসুল আরেফিন সিদ্দিক)। আরেফিন স্যারকেই আমরা ক্যাম্পাসের পুরোটা সময় ভিসি হিসেবে পেয়েছিলাম এবং স্যার সম্ভবত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সময় ভিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সেমিস্টের ফার্স্ট ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা কয়েকজন মার্কস নিয়ে বিভাগে ঝামেলায় পড়েছিলাম এবং স্যারের শরণাপন্ন হই। স্যার দুই তিন দিন ঘুরিয়ে বিষয়টি আবার ডিপার্টমেন্টের হাতেই ছেড়ে দেন। হস্তক্ষেপ করলে এটা সমাধান যোগ্য ছিল। কিন্তু স্যার সময়ক্ষেপণ করে সমাধান দেননি। আমরা কজন একটু সাফার করি। এসব ব্যক্তিগত বিষয় পরে আর মনে রাখেনি। এজন্য স্যারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধও কোনোদিন কমেনি। কারণ ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতি দিয়ে গুণী মানুষের সমগ্র সত্তা ও অর্জনকে মূল্যায়ন করা সমীচীন নয়।
২০১৬ সালের জুলাইয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর একটি প্রকাশনায় বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে নিয়ে অতিশোয়োক্তি, মিসইনফরমেশন এবং বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাসে অবিসংবাদিতভাবে স্বমহিমায় একটি লেখায় তুলে না ধরায় অনুষ্ঠানেই বিষয়টি কারও কারও নজরে আসে এবং আরেফিন স্যার তখনই ম্যাগাজিনটির সকল কপি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশনা দেন। কিন্তু অতিউৎসাহী কিছু ছাত্রলীগ কর্মী (এরাও সেদিন ছদ্মবেশী গুপ্ত শিবির ছিল কিনা কে জানে) উপাচার্য ভবন ঘেরাও করে মিছিল দেয়। ভিসির গাড়ি ভাংচুর করে। গেইটে তালা দিয়ে তাঁকে কিছু সময় অবরুদ্ধ করে রাখে। সেদিন মিছিলের স্লোগান ছিল এরকম, “ভিসি তুই রাজাকার/ এই মুহূর্তে গদি ছাড়। আরেফিন তুই বেরিয়ে আয়/ … ” ইত্যাদি অশ্রাব্য কিছু শব্দও ছিল। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের দায়িত্বে তখন সোহাগ-জাকির কমিটি। তারা উপাচার্যের বাসভবনে এসে পরে বিষয়টি মিটমাট করেন। যাকে তাকে রাজাকার এবং শিবির ট্যাগিংয়ের একটি বাজে উদাহরণ সৃষ্টিতে আরেফিন স্যারও বঞ্চিত হননি! অথচ প্রকৃত শিবিরদের অনেকে ছাত্রলীগের ভেতরেই ঘাপটি মেরেছিল। পাঁচ আগস্ট পট পরিবর্তন না হলে হয়তো সহসা এদের স্বরূপ জানা যেত না।
বিএনপি-জামাত চারদলীয় জোটের সময় আমরা যখন কলেজে পড়ি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সমিতির নেতৃত্বে এবং ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক নানা প্রতিবাদ সমাবেশের যে ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশ হতো শারীরিক উচ্চতার জন্য আরেফিন স্যারকে মিছিলে, মানববন্ধনে আলাদা করে চিহ্নিত করা যেত। পৃথিবীর অনেক বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষকদের মতো তারও রাজনৈতিক দর্শনগত স্পষ্ট পক্ষপাত ছিল। তিনি আওয়ামীলীগের রাজনীতির সমর্থক ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীল দলের শিক্ষকদের ব্যানারে একটা লম্বা সময় ধরে গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছিলেন। বারবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন ও জঙ্গি উত্থানে দেশটি মুমূর্ষু হলে পরে ১/১১ নাটকীয় ঘটনা প্রবাহের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অকুতোভয় সাহস এবং শিক্ষকদের আপসহীন অবস্থান এবং কারাবরণ – তিনোদ্দীন অর্থাৎ ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দীন-ইয়াজুদ্দিনের আরেক অন্তর্বর্তী ছলনার ছায়াসামরিক শাসন থেকে জাতিকে মুক্তি দেয়। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের যাত্রাপথকে প্রসন্ন করে। আরেফিন সিদ্দিক সেইসব গণতান্ত্রিক আন্দোলনের খুব চেনা মুখ ছিলেন।
১ কোটি ২৫ লাখ টাকা!
ভদ্রবেশী শিক্ষিত দস্যু ও ডাকাত অর্থাৎ হোয়াইট কলার ক্রিমিনালে ছেয়ে যাওয়া দেশে ১ কোটি ২৫ লক্ষ টাকার মায়া ত্যাগ করা সহজ কথা নয়। যে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের কুকীর্তি নিয়ে ‘গাভী বৃত্তান্ত’, ‘মহব্বত আলীর একদিন’-এর মত উপন্যাস লেখা হয় সেদেশে অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক এক কোটি পঁচিশ লাখ টাকার মায়া ত্যাগ করেছিলেন নীরবে! মানুষ হিসেবে একজন আরেফিন সিদ্দিকির নিশ্চয়ই অনেক ত্রুটি ছিল, সীমাবদ্ধতা ছিল, রাজনৈতিক বিভাজনের খড়্গ কৃপাণে হয়তো অনেকে আহত হয়েছেন। তবু উচ্চ নৈতিকতার একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন তিনি নীরবে। নীরবে বললাম কারণ তিনি বিষয়টির প্রচার চান নি এবং গণমাধ্যম এ নিয়ে প্রশ্ন করলেও এড়িয়ে গেছেন।
১ কোটি ২৫ লাখ না নেবার বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের একটি অধিবেশনে ওঠে আসে। তারপর অর্থগৃধনু সমাজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ তোলপাড় হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের বার্ষিক অধিবেশনের বাজেট উপস্থাপনের সময় কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক কামাল উদ্দীন এই বিষয়টি সিনেট সদস্যদের নজরে এনেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত বিশেষ করে উপাচার্য, প্রো-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষসহ অন্যান্যরা বিভিন্ন পর্যায়ের সভাসমূহের জন্য ‘সিটিং এলাউন্স’ পান এবং তা সানন্দে গ্রহণ করেন। এর পরিমাণ তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার পর্যন্ত। কোনো কোনও ক্ষেত্রে অ্যালাউন্সের পরিমাণ আরও বেশি হয়। ভিসি হিসেবে দায়িত্ব পালনের সাড়ে সাত বছরের মেয়াদকালে ‘সিটিং অ্যালাউন্স’ বাবদ প্রায় ১ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা জমা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ সাশ্রয় করতে এই টাকাটা তিনি গ্রহণ করেননি। একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে কতোটা ধারণ করলে, কতোটা ভালোবাসলে সীমাহীন লোভী একটা সমাজে এমন উদাহরণ ও উদারতা দেখানো যায়? অফিস আওয়ারের বাইরেও রাত দেড়টা, দুইটায় গেলেও যার বাসভবনের দ্বার শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকতো তিনি আরেফিন সিদ্দিক। আজীবনের কর্মস্থল সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে আরেফিন সিদ্দিকির লাশটি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে নিতে সায় দেয়নি বর্তমান অন্তর্বর্তী-সরকারের নিয়োগ করা উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে আরেফিন স্যার তাঁর জীবনে অগুনিত বার গেছেন। অনেকের জানাজায় স্যারকে সেখানে উপস্থিত থাকতে দেখেছি। সেখানে তাঁর একটি জানাজা হতে পারতো না? এমনকি তাঁর শিক্ষক সমিতির উদ্যোগে একটি স্মরণসভার আয়োজন হতেও দেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ক্ষমাহীন এই অনুদারতা। একাডেমিক যোগ্যতায়, ব্যক্তিত্বের বিভায়, সদাচার, সদ্ভাব ও সহিষ্ণুতায় উজ্জ্বল শিক্ষার্থীবান্ধব একজন শিক্ষক আরেফিন স্যারকে সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপার থেকে অন্তিম শ্রদ্ধা ও অভিবাদন জানাই। তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।
লেখক: কবি ও গবেষক alo.du1971@gmail.com