।। এএসএম শরিফুল হাসান।।
জুলাই রায়ট বা আন্দোলনের পর দেশে উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিতর্কিত করের অন্তবর্তী সরকারের একটি সিদ্ধান্ত তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে। রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের স্মরণে নির্মাণাধীন একটি ঐতিহাসিক ভাস্কর্যের কাজ বাতিল করেছে সরকার। এই স্থানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তর্জনী উঁচানো ব্রোঞ্জের ভাস্কর্যসহ অন্যান্য পরিকল্পনা বাদ দিয়ে একটি স্মৃতিফলক তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই পদক্ষেপকে অনেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ৭১-এর ইতিহাসকে অবমাননার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছেন।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি ঐতিহাসিক স্থান। এখানে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন, যা জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেছিল। এরপর একই স্থানে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে, যা বাংলাদেশের বিজয়কে চিরস্থায়ী করে। এই গৌরবময় ইতিহাসকে দৃশ্যমান করতে ২০১৮ সালে শুরু হয়েছিল ভাস্কর্য নির্মাণের প্রকল্প। কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থানের পর ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে অন্তর্বর্তী সরকার এই প্রকল্পের মূল নকশা পরিবর্তনের পথে হাঁটছে।
সরকারের যুক্তি, এই ভাস্কর্য নির্মাণ “জুলাই চেতনার” সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম সমকালকে বলেছেন,
“ভাস্কর্যগুলো ভাঙচুর করা হয়েছে। আমরা ভাস্কর্যগুলো আর নির্মাণ করছি না। আমাদের মনে হয়েছে, এটি জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।”
তবে এই যুক্তি অনেকের কাছে অগ্রহণযোগ্য। জুলাই আন্দোলন যদি মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধিকারের গৌরবময় ইতিহাসকে অস্বিকার করার জন্য হয়ে থাকে তাহলে আপনাদের এই সিন্ধান্ত যুক্তিযুক্ত হয়। যেভাবে বঙ্গবন্ধুর ভাষ্কর্য সহ মুক্তিযুদ্ধের হাজারো ভাষ্কর্য ভাঙ্গা হয়েছে, মুজিবনগরের সকল চিহ্ন মুছে ফেলা হয়েছে, তাতে এই সন্দেহ থেকেই যায়। সেটা ছিল আন্দোলনকারীদের অবস্থান, বর্তমানের এই সিন্ধান্তের মাধ্যমে কি অন্তবর্তিকালীন সরকার তাদের সেই সিন্ধান্ত দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছেন? নয়তো কেন ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের প্রতীককে কেন অস্বীকার করা হচ্ছে? এটি কি জাতির শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রয়াস নয়।
প্রকল্পের অংশ হিসেবে ১৯৭২ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণের স্মরণে ইন্দিরা মঞ্চ নির্মাণের পরিকল্পনাও বাতিল করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত চার উপদেষ্টার মতামতের ভিত্তিতে নেওয়া হয়েছে, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন ফারুক-ই-আজম, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, আদিলুর রহমান খান ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তাঁরা প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে এই পরিবর্তনের সুপারিশ করেন।
২০১৮ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের কাজ এ বছরের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। দুই দফা মেয়াদ বাড়ানোর পর এখন ব্যয় না বাড়িয়ে নতুন নকশায় আরও এক বছর মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু ভাস্কর্যের পরিবর্তে স্মৃতিফলক তৈরির এই সিদ্ধান্ত কতটা ইতিহাসকে সম্মান জানায়, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। একটি স্মৃতিফলক কি সেই গৌরবময় আত্মসমর্পণের দৃশ্যকে জীবন্ত করতে পারবে? বঙ্গবন্ধুর উঁচানো তর্জনী, যা মুক্তির প্রতীক, তা কি কেবল কয়েকটি লেখায় সীমাবদ্ধ থাকার যোগ্য?
জুলাই অভ্যুত্থানের পর ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে অরাজকতা দেখা দিয়েছে, তাকে “ইসলামি উগ্রবাদীদের” কাজ বলে চিহ্নিত করা যায়। ইসলামে ভাষ্কর্য হারাম, এই ফতোয়া অনেক অনেক বছর ধরে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠা লাভ করছে। যদিও জুলাই পরবর্তি সময়ে দেখা যায়, ক্ষোভের জায়গা শুরু বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, এমনকি জাতীয় চারনেতাও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।
কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার এই ঘটনাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে ৭১-এর প্রতীকগুলোকে কেন মুছে ফেলছে? এটি কি জাতির গৌরবময় ইতিহাসকে অস্বীকারের একটি প্রচেষ্টা নয়? জুলাই চেতনা ও ৭১-এর চেতনাকে একে অপরের বিপরীতে দাঁড় করানো কতটা যুক্তিযুক্ত?
আপনারা কি একবারও ভেবে দেখেছেন লাখো স্টেক হোল্ডারের জুলাই আন্দোলনের বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাসের সেটকহোল্ডার কতোজন? আপনারা কি তাদের মতামত নিয়েছেন? যেইভাবে মতামতের ভিত্তিতে সংস্কারের চেষ্টা করছেন, সেই মতামতের ভিত্তিতে কি এই সিন্ধান্ত নিয়েছেন?
ইতিহাসবিদ ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নাগরিকদের মতে, এই সিদ্ধান্ত জাতির শিকড়ের প্রতি অবিচার। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের অস্তিত্বের ভিত্তি, আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান তার প্রতীক। অন্তর্বর্তী সরকারের এই পদক্ষেপকে অনেকে “ইতিহাস থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া” হিসেবে দেখছেন। প্রশ্ন উঠছে—জুলাইয়ের নামে ৭১-কে অস্বীকার করে আমরা কোন পথে এগোচ্ছি?
অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট