স্বাধীনতা দিবসে সুনামগঞ্জ শহরের ডিএস রোডে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের নির্মাণ করা পুরাতন শহীদ মিনারের তালা ভেঙে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা। এই ঘটনার ছবি ও ভিডিও সামাজিকযোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রচার হওয়ায় সমালোচনার ঝড় বইছে।
আজ বুধবার সকাল সাড়ে ১০টায় শহীদ মিনারের গেটের তালা ভেঙে ভিতরে প্রবেশ করে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেন মুক্তিযোদ্ধারা। এর আগে মঙ্গলবার রাতে স্বাধীনতার প্রথম প্রহরে শহীদ মিনারে তালাবদ্ধ দেখে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
আজ বুধবার সকালেও তালাবদ্ধ থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা ও সাধারণ মানুষ। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ১৯৭১ সালে সুনামগঞ্জ মুক্ত হয় ৬ ডিসেম্বরের। বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বরের আগেই শহরের ডিএস রোডের (দেওয়ান সাহেব রোডের) এই শহীদ মিনারটি নিজ হাতে নির্মাণ করেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। তৎকালীন মেজর মোতালিবের (সাব-সেক্টর কমান্ডার) নির্দেশনায় মুক্তিযোদ্ধা-সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী তাৎক্ষণিক এই শহীদ স্মৃতি ফলকটির নকশা তৈরি করে দেন।

সুনামগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের নির্মিত এটিই বাংলাদেশের প্রথম শহীদ মিনার। সুনামগঞ্জ শহরে মুক্তিযুদ্ধ এবং ভাষা আন্দোলনের আর কোনো স্মৃতি ফলক না থাকায় এই একটিই হয়ে ওঠে একাত্তরের স্মৃতিফলক এবং বায়ান্নের ভাষা শহিদদের শ্রদ্ধা জানানোর শহীদ মিনার। তবে এটি সুনামগঞ্জের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নামেই বেশি পরিচিত।
গত কয়েক বছর আগে সুনামগঞ্জ কোর্ট চত্বরে একাত্তরের শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়। এরপর থেকে জাতীয় দিবসে পুরাতন এবং নতুন এই দুটি শহীদ বেদীতেই পুস্পস্তবক অর্পণ করা হয়। কিন্তু এই বছর মহান স্বাধীনতা দিবসে পুরাতন শহিদ মিনারের প্রবেশ গেট তালাবদ্ধ থাকে। অনেকেই ভোরে শ্রদ্ধা জানাতে এসে বাধ্য হয়ে কোর্ট চত্ত্বরের স্মৃতিফলকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পরে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা পুস্পস্তবক অর্পণ করতে গিয়ে গেটে তালাবদ্ধ দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে তালা ভেঙে শহীদ মিনারে প্রবেশ করে শহীদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানান।
এ সময় জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার হাজী নুরুল মোমেন, সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মজিদ, যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাড. কাউসার আলম, বীর মুক্তিযোদ্ধা সাইফুর রহমান সামছু, বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রশিদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা ওয়াজ কুরুনি, বীর মুক্তিযোদ্ধা মুজিবুর রহমান, বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহেনুর পাশা, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মুস্তফাসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা উপস্থিত ছিলেন।
জাসদ নেতা সালেহীন চৌধুরী শুভ তালাবদ্ধ শহিদ মিনারের একটি ছবি দিয়ে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘প্রতিবছর রাত ১২টা ১ মিনিটে এখানেই শ্রদ্ধা অর্পণ করি, কখনও শহীদ মিনার তালাবদ্ধ থাকেনি। আজ তালাবদ্ধ কেন?
শহীদ মিনার তালাবদ্ধ রাখার বিষয়ে বিএনপি নেতা ও উন্নয়ন সংগঠক একে কুদরত পাশা ফেসবুকে লিখেছেন, ‘স্বাধীনতা দিবসেও শহিদ মিনার তালাবদ্ধ।’
জেলা উদীচীর সহসভাপতি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘মহান স্বাধীনতা দিবসে শহীদ মিনারের গেটে তালা দেওয়া দেখে আশ্চর্য্য হয়েছি। এই প্রথম কোনো স্বাধীনতা দিবসে শহীদ মিনারে ফুল দিতে গিয়ে গেটে তালাবদ্ধ দেখে ফিরে এলাম। পরে কোর্ট চত্বরে স্মৃতি ফলকে গিয়ে পুস্পস্তবক অর্পণ করেছি। গেটে কেন তালা দিয়ে রাখা হলো খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। রেওয়াজ অনুযায়ী এই শহীদ মিনারেই ফুল দিতে আসেন মুক্তিযোদ্ধারা। পরে তালা ভেঙে শহীদ মিনারে প্রবেশ ছাড়া উপায় ছিল না তাদের।’
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মজিদ বলেন, ‘মহান স্বাধীনতা দিবসে শহীদ মিনারে তালা দিয়ে রেখে তারা দায়িত্বহীন কাজ করেছেন। আমাদের নিজ হাতে নির্মিত সুনামগঞ্জের এই শহীদ মিনার। স্বাধীনতা দিবসে তালা দেয়া দেখে খুবই মর্মাহত হয়েছি। আমরা বাধ্য হয়েই তালা ভেঙ্গে শহিদ মিনারে প্রবেশ করে শহিদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছি।’
জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার নূরুল মোমেন বলেন, ‘সকালে ফুল দিতে গিয়ে দেখি শহীদ মিনারের গেটে তালা দেওয়া। স্বাধীনতা দিবসে শহীদ মিনার তালা দেয়া এটি মেনে নেয়া যায় না। তাই মুক্তিযোদ্ধাগণ ক্ষুব্দ হয়ে তালা ভেঙে শহীদ মিনারে প্রবেশ করে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। শুনেছি আমাদের আগে অনেকেই শহীদ মিনারে ফুল দিতে এসে গেটে তালা দেয়া দেখে ফিরে গেছেন। শহীদ মিনারটি বর্তমানে পৌর প্রশাসনের দায়িত্বে রয়েছে। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। এটি গুরুত্বের সাথে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।’
সুনামগঞ্জ পৌরসভার বর্তমান প্রশাসক জেলা স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক মো. রেজাউল করিম যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানানো হয়। আর স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধা জানানো হয়। স্বাধীনতা দিবসে স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দেওয়া হবে, তাই পুরাতন শহীদ মিনার বন্ধ রাখা হয়। সবাইকে জানাতে হবে স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে শ্রদ্ধা জানানোর স্থান ‘স্মৃতিস্তম্ভ’।